মুহাম্মদ রমিজ উদ্দিন
অনার্সে ভর্তি হয়েছি তখন। মাধ্যমিকের একজন শিক্ষকের কাছে গেলাম সেদিন। স্যারের পা ছুঁয়ে সালাম করার জন্য স্যারের সামনে বসে পড়ি। এ কি করছো রমিজ! এই বলে, স্যার দ্রুত টেনে তুলে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর হাসিমুখে আলাপ। টি-স্টলে স্যারের পাশে বসে গল্প করতে করতে, চা নাস্তা খাওয়া। স্যার তো কোনোমতেই বিল দিতে দিবে না আমাকে। যখন ক্লাসে স্যারকে দেখতাম তখন অনেক কড়া মেজাজের একজন মানুষ ভেবে ভয় পেতাম। কিন্তু, স্যারের ভিতরে এতো মায়া মমতা, স্নেহ ও বন্ধুপ্রীতি আছে তা এ সময় স্যারের সঙ্গ না পেলে জানার সুযোগ হতো না কোনোদিন।
স্যার শিক্ষাদানের পাশাপাশি এতো স্নেহ করতেন অামার মনে হয়, সারা জীবন চেষ্টা করলেও ঋণ শোধ করা যাবে না। কিভাবে শোধ করবো? শিক্ষকের জ্ঞানের স্টোররুম থেকে অামার ক্ষুদ্র তলিতে জমা হওয়া একটি শব্দের প্রতিদান দেয়া যাবে এমন কিছু অাজও আবিষ্কৃত হয়নি পৃথিবীতে। প্রতিদান দেয়ার সাধ্য তো নাই। বড় হওয়ার পর যখন শিক্ষকের পা ছুঁয়ে সালাম করতে পারি তখন কিছুটা তৃপ্তি পাই। গর্ববোধ করি। কিন্তু স্যার তো এটাও করতে দিবেন না। বরং বুকে টেনে নিয়ে অারো ঋণি করে দিলেন।
আমরা তখন চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। ক্লাস টিচার যিনি ছিলেন তিনি খুব কড়া মেজাজের। ক্লাসে সারাক্ষণ হুমকি ধামকির মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হতো স্যারের সময়। স্যার যে কয়েকটি কাজ বেশি করতেন তাহলো
• প্রহার করা
• রাগের স্বরে বকাঝকা করা
• গম্ভীর ভাব নিয়ে চলাফেরা করা।
একদিন শুনলাম স্যারের হাত ভেঙে গেছে। এ দুঃসংবাদ শুনে আমরা কেবল হাই হুতাশ করছি। ক্লাসমেটদের কেউ একজন প্রস্তাব করলো, 'চল, স্যারকে দেখে অাসি।' যে প্রস্তাব সেই কাজ। পরের দিন কিছু ফলমূল নিয়ে চলে যায় স্যারের বাসায়। আমরা স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। স্যারের এ কি অাচরণ! স্যারের ব্যান্ডেজ মোড়ানো ভাঙ্গা ডান হাতটি গলায় ঝুলছে। বাম হাত দিয়ে ঝেড়ে পরিষ্কার করে আমাদেরকে বসার আসন করে দিলেন। স্যার নিজে আমাদের সামনে টি টেবিলে বসে পড়লেন। তারপর কৈফিয়ত দেয়ার মতো করে হাত ভাঙার কারণ বর্ণনা করে যাচ্ছেন। আমরা কেবল মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি। কি ব্যাপার! স্যার এতো অমায়িক? স্যার, এই এক হাতেই নাস্তার ট্রে এনে জন জন করে নাস্তা তুলে দিলেন। নিজে গিয়ে বাজার করে দুপুরে খাবারের ব্যবস্তা করলেন। শিক্ষকদের ক্লাস রুমের আচরণ আর বাস্তব জীবনের আচরণে যে বিরাট এক তফাৎ আছে তা সেদিনই ভালো করে বুঝেছি ।
আমার একজন শিক্ষকের বাসায় লজিং করতাম। উনি ছিলেন অধ্যাপক। স্যার এতো কঠিন শাসনের ব্যক্তি ছিলেন যে, উনার নাম শুনলে সবাই ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়তো। বারান্দা দিয়ে স্যার হেঁটে গেলে পাশে ক্লাস ভর্তি শিক্ষার্থীরা থাকা সত্ত্বেও ক্লাসরুমের অবস্থা হতো পিনপতন নিরবতা। এতো ভয়ংকর একজন শিক্ষক ছিলেন উনি। যেদিন প্রথম স্যারের বাচ্চাদের পড়ানোর জন্য গেলাম সেদিনই আমার আক্কেলগুড়ুম হলো। স্যার নিজেই অামার জন্য ভাত তরকারি ট্রে নিয়ে অাসছেন। আমি তো পুরোই স্তম্ভিত। ভয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। কাঁপুনির স্বরে বললাম, স্যার আপনি কেন কষ্ট করে এসব করতে যাবেন? স্যার তখন অামাকে স্বাভাবিক করার জন্য হাসিমুখে এমন একটি কথা বললেন, তার প্রত্যুত্তরে অামার বলার মতো কোনো ভাষা ছিল না। স্যার বললেন, 'রমিজ ক্লাসে আমি তোমার শিক্ষক। সেখানে তুমি আমাকে রেস্পেক্ট করবা। আর এখানে তুমি আমার শিক্ষক; আমার সন্তানের শিক্ষক মানে আমার শিক্ষক। এখানে আমি তোমাকে রেস্পেক্ট করবো।' এ কথার প্রত্যুত্তরে কি বলার অাছে বলুন তো। বরং আমার জীবনের জন্য শিক্ষা হলো স্যারের এ বাণি। প্র্যাক্টিক্যাল শিক্ষা।
বিশ্ববদ্যালয়ের এক অধ্যাপাকের বাসায় আমাদের ডাক পড়েছিল। আমি আর আমার বন্ধু যায়। স্যার আমাদেরকে ডাকলেন তেমন কোনো ভারি কাজের জন্য নয়। বরং সঙ্গ দেয়ার জন্য। স্যার একটি কাজে যাচ্ছেন আমরা সঙ্গ দিবো। সেদিনও স্যার বাসায় বসিয়ে এতো সুন্দর করে অালাপ করলেন এবং অাপ্যায়ন করালেন যেন অামরা কোনো শিক্ষার্থী নয়, স্যারের পরিচিত কোনো সঙ্গী। ফেরার সময় তো স্যার আমাদেরকে সিএনজিতে তুলে দিয়ে সিএনজির ভাড়া মিটিয়ে দিলেন। শহরের এ মাথা তো তেমাথা পাবলিক বাসে গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে ঘুরে বেড়ানো স্বভাবের এ সময় স্যার যখন অাদর আপ্যায়ন শেষে সিএনজিতে তুলে দিলেন সেদিনও শিক্ষককে ভিন্ন পরিচয়ে চিনার সুযোগ হয়েছে আমার।
শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, রাজনীতিবিদ, মসজিদের ইমাম, গাড়ির ড্রাইভার, কৃষক, শ্রমিক, ব্যবসায়ী, চাকুরীজীবী যেটা বলেন না কেন এরা সবাই মানুষ। আর এসব মানুষের পেশা। মানুষকে আমি দুভাগে ভাগ করেছি।
১. ভালো মানুষ।
২. খারাপ মানুষ।
আমি পেশাকে খারাপ বলতে পারি না। পেশা খারাপ হতে পারে না। বরং মানুষগুলো খারাপ হয়। সেসব খারাপ মানুষ প্রত্যেক পেশায় থাকে। মসজিদের ইমাম সাহেবের মধ্যেও খারাপ মানুষ থাকে। মাদ্রাসার হুজুরদের মধ্যেও খারাপ মানুষ থাকে। এসব গুটিকয়েক খারাপ মানুষের জন্য অামরা পুরো পেশাকে কিংবা সেই পেশাধারী সবাইকে ঢালাওভাবে খারাপ বলতে পারি না। বরং ব্যক্তি বিশেষে দোষারোপ করবো।
তেমনি শিক্ষকের মধ্যেও কিছু খারাপ স্বভাবের ব্যক্তি আছে। এমন খারাপ শিক্ষকের মুখোমুখি যে হয়নি তা কিন্তু নয়। তবে মুল কথা হচ্ছে, শিক্ষকদের খারাপ গুণ বর্ণনা করতে চাই না। কারণ, শিক্ষকদের খারাপ গুণ দেখলেও কখনো তা গ্রহণ করার মানসিকতা লালন করিনি। শিক্ষকদের ভালো গ্রহণ করার চেষ্টা করেছি এবং যতদিন বাঁচি ভালো গুণই বর্ণনা করে যাবো। কারণ, শিক্ষক কখনো খারাপ হতে পারে না। বরং শিক্ষকদের মধ্যে গুটিকয়েক খারাপ স্বভাবের ব্যক্তি থাকতে পারে। এটি অস্বাভাবিক নয়।
শিক্ষকের পেশাটা অন্য অাট দশটির পেশার চেয়ে ভিন্ন। এখানে টাকা পয়সার চেয়ে অাত্মসম্মানের অাদান প্রদান হয় বেশি। তাই এটিকে মহান পেশা বলে।
অাজকে মহান শিক্ষক দিবস। আজকের শিক্ষিক দিবসে সশ্রদ্ধ সালাম জানায় সেসব মহান পেশাধারী শিক্ষদের যারা জ্ঞানের প্রদীপ হাতে সকাল সন্ধা ঘুরে বেড়ায়। বিনা শর্তে, বিনা লাভে জ্ঞান বিলি করে। জ্ঞান বিলি করে মাধুর্য পূর্ণ অাচরণ দিয়ে। জ্ঞানের অালো ছড়ায় নিজেদের আদর্শ দিয়ে।
জয় হোক শিক্ষকের।
জয় হোক শিক্ষার।
সম্পাদক ও প্রকাশক: রফিকুল ইসলাম
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-১৩১০