জাহেদুর রহমান সোহাগ
মানুষ সমাজবদ্ধ প্রাণী। মতের ভিন্নতা তার স্বাভাবিক গুণ, কারণ একই সমাজে বসবাস করেও প্রত্যেক ব্যক্তি আলাদা চিন্তা ও বিশ্বাস পোষণ করে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আজ সেই ভিন্নমতকে আমরা শত্রুতা হিসেবে গ্রহণ করছি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আজ এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে কোনো ব্যক্তির মত, বিশ্বাস বা দলীয় অবস্থান একটু ভিন্ন হলেই তাকে অবজ্ঞা, অপমান, এমনকি মৃত্যু টার্গেটে পরিণত করা হয়।
এক সময় যুক্তি দিয়ে আমরা কথা বলতাম, সম্মান দিয়ে মতামত শুনতাম। আজ সেই জায়গায় এসেছে কটু বাক্য, ঘৃণা আর দলান্ধ মন্তব্য। ফেসবুক যেন এক ধরনের ভার্চুয়াল যুদ্ধক্ষেত্র—যেখানে যুক্তির নয়, বরং মিথ্যা, গুজব ও অপমানের বিস্তার ঘটে। এই ভার্চুয়াল সংঘাত বাস্তব সমাজেও রূপ নেয় প্রতিহিংসায়, যা সমাজকে ধীরে ধীরে অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
সম্প্রতি গাজীপুরের পুবাইলে মাওলানা রইজ উদ্দিনকে গণপিটুনির মাধ্যমে হত্যা করা হয়। অভিযোগ ছিল, তিনি একজন কিশোরকে বলাৎকার করেছেন—যা প্রমাণ হওয়ার আগেই তাকে গাছে বেঁধে মারধর করা হয়, সেই দৃশ্য ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। মাওলানার মৃত্যু হয় পুলিশের হেফাজতে। সামাজিকভাবে এই ঘটনা শুধু একটি ব্যক্তির মৃত্যু নয়, এটি ন্যায়বিচারের চরম লঙ্ঘন এবং মানবাধিকারের অবমাননা।
মাওলানা রইজ উদ্দিন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত আকিদাহ ঘরানার অনুসারী ছিলেন। আমরা দেখেছি, ঘটনাটি প্রকাশ পাওয়ার পর ধর্মীয় মতভেদ ও গোষ্ঠীগত বিদ্বেষও সামাজিক মাধ্যমে দানা বাঁধে। প্রশ্ন হলো—একজন মানুষ কোন দলের, কোন বিশ্বাসের—সেটা বড়, না তার জীবন? তিনি একজন পিতা, একজন স্বামী, একজন মুসলমান, সর্বোপরি একজন মানুষ ছিলেন। তাহলে শুধু মতাদর্শের ভিন্নতার কারণে তার জীবন এত অমূল্য হয়ে উঠল কেন?
এটাই প্রথম ঘটনা নয়। আমরা বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদকেও হারিয়েছি একইভাবে—শুধু “শিবির সন্দেহে” সহপাঠীদের নির্যাতনে। যেখানে দেশের সেরা মেধাবীদের তৈরি হওয়ার কথা, সেখানে যদি ভিন্নমতের প্রতি সহিষ্ণুতা না থাকে, তবে সমাজে আমরা কীভাবে সহাবস্থান আশা করব?
এইসব ঘটনা আমাদের জানান দেয়, সমাজে আজ সহনশীলতার ঘাটতি চরমে। ভিন্নমত, ভিন্ন বিশ্বাস কিংবা ভিন্ন দলের প্রতি সম্মানবোধ বিলুপ্ত প্রায়। বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাওয়ার কারণে অনেকেই নিজেদের হাতে “বিচার” তুলে নিচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া যেন হয়ে উঠেছে একমাত্র বিচারক। অথচ আমরা ভুলে যাচ্ছি, সভ্যতা গড়ে উঠেছে সংলাপ, নিয়ম ও মানবিকতার ভিত্তিতে—not mobs, not hashtags.
আমাদের প্রয়োজন এখনই থামা। ভিন্নমতকে দমন করে নয়, বরং শ্রদ্ধা দিয়ে, যুক্তি দিয়ে, সহনশীলতা দিয়ে আমরা একটি সভ্য ও ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ গড়ে তুলতে পারি। দলমত যা-ই হোক, জীবনের চেয়ে কিছুই বড় নয়। সমাজে শান্তি ও নিরাপত্তা তখনই ফিরে আসবে, যখন আমরা বিশ্বাস করব—প্রতিপক্ষও মানুষ, সে-ও আমার মতোই অনুভব করে, ভালোবাসে এবং বাঁচতে চায়।
আজ সময় এসেছে ঘৃণার রাজনীতি, বিভক্তির সংস্কৃতি ও দলান্ধতার ঊর্ধ্বে ওঠার। প্রয়োজন সত্যিকার অর্থে মানবিক একটি সমাজ নির্মাণের। যেখানে বিশ্বাস থাকবে, সহানুভূতি থাকবে, আর থাকবে জীবনকে সম্মান করার শিক্ষা।