চিকিৎসা জগতের একটি চমৎকার জীবন রক্ষাকারী ঔষুধ হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক। নিঃসন্দেহে, এ ঔষুধ আবিষ্কারের ফলে মাইক্রোবিয়াল সংক্রামক রোগ থেকে লক্ষ কোটি মানুষের জীবন রক্ষা করেছে। কিন্তু সময়ের প্রেক্ষাপটে মানুষের অসাবধানতাবশত যত্রতত্র নিয়ম না মেনে এই অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার এখন মানুষেরই মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠছে।
১৯২৭ সালে লন্ডনের সেন্ট মেরি হাসপাতালে কর্মরত অণুজীব বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার ফ্লেমিং এর পেনিসিলিন আবিষ্কার এর মধ্য দিয়ে প্রথম আধুনিক আন্টিবায়োটিক যুগের সূচনা হয়।
অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের নীতি হল রোগীকে একটি সঠিক ডোজের, সংশ্লিষ্ট ব্যাকটেরিয়া সংবেদনশীল এবং পর্যাপ্ত সময় ধরে যাতে সংক্রমণ সম্পূর্ণরূপে নির্মূল হয় এমন অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া। কিন্তু নীতি না মানায়, রোগীদের অবহেলায় ডোজ সম্পূর্ণ না করায় ধীরে ধীরে ব্যাকটেরিয়াগুলো এসব অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে উঠছে। ফলে, এসব ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে সাধারণ রোগেই আবার মৃত্যুহার বেড়ে যাবে। এই মাইক্রোবিয়াল’স গুলো চিকিৎসা বিজ্ঞানে “সুপার বাগস” এবং এই প্রক্রিয়াটিকে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। মানুষ, প্রাণী এবং উদ্ভিদে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালের অপব্যবহার এবং অতিরিক্ত ব্যবহার ওষুধ-প্রতিরোধী রোগজীবাণুগুলির বিকাশের প্রধান চালিকাশক্তি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ২০১৯ সালে ব্যাকটেরিয়াজনিত অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (এআর) বিশ্বব্যাপী ১.২৭ মিলিয়ন মৃত্যুর জন্য সরাসরি দায়ী ছিল এবং ৪.৯৫ মিলিয়ন মৃত্যুর কারণ ছিল। অধিকন্তু, আমেরিকার রোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (এআর) কে বিশ্বব্যাপী জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি জরুরি হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তথ্যানুযায়ী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, প্রতি বছর ২.৮ মিলিয়নেরও বেশি অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল-প্রতিরোধী সংক্রমণ ঘটে। বাংলাদেশের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট এর প্রকাশিত প্রতিবেদনে ২০১৭ থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত দেশব্যাপী অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স সার্ভিইল্যান্স এর ফলাফলে ৭০,০০২ জন রোগীর মধ্যে ৪৪,৩১৬ জন কোন একটি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্স ব্যাকটেরিয়া দ্বারা অসুস্থ হয়েছে। যেটি বর্তমানে বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি মারাত্মক হুমকি হয়ে দাড়িয়েছে।
এছাড়াও AMR আধুনিক চিকিৎসার অনেক অর্জনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে। এটি সংক্রমণের চিকিৎসা করা কঠিন করে তোলে এবং অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতি এবং চিকিৎসা - যেমন সার্জারি, সিজারিয়ান সেকশন এবং ক্যান্সার কেমোথেরাপি - আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। মানব স্বাস্থ্যে এএমআর মোকাবেলার অগ্রাধিকারের মধ্যে রয়েছে সমস্ত সংক্রমণ প্রতিরোধ করা, যার ফলে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালের অনুপযুক্ত ব্যবহার হতে পারে; মানসম্পন্ন রোগ নির্ণয় এবং সংক্রমণের উপযুক্ত চিকিৎসার সর্বজনীন অ্যাক্সেস নিশ্চিত করা; এবং কৌশলগত তথ্য এবং উদ্ভাবন, উদাহরণস্বরূপ এএমআর এবং অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ব্যবহার/ব্যবহারের উপর নজরদারি, এবং নতুন ভ্যাকসিন, ডায়াগনস্টিকস এবং ওষুধের জন্য গবেষণা ও উন্নয়ন।
পরিশেষে, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স মোকাবিলায় আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে। অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার বন্ধ করতে হবে, চিকিৎসার প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অ্যান্টিবায়োটিক প্রেসক্রাইব করলে তা সঠিকমাত্রায় কোর্স সম্পূর্ণ করতে হবে। পাশাপাশি, সামাজিক সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। ভবিষ্যৎ মহামারী থেকে আগামী প্রজন্মকে রক্ষা করতে হলে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকসহ সামষ্টিক পদক্ষেপ এর কোন বিকল্প নেই।
লেখকঃ
মোঃআবু হাসনাত আব্দুল্লাহ
প্রভাষক
জনস্বাস্থ্য বিভাগ
জার্মান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ
সম্পাদক ও প্রকাশক: রফিকুল ইসলাম
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-১৩১০