বিদেশে উচ্চশিক্ষা সে তো অনেক টাকার ব্যাপার! আমার বাপের এত টাকা নাই ভাই। আমার দ্বারা হবে না। হ্যা, বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ব্যাপারে এখনো অনেক বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের এবং আপামর জনসাধারণের মাথায় ধারনাটি গেঁথে আছে। বর্তমান বিশ্ব বিশ্বায়নের যুগে অবস্থান করছে। আর এই বিশ্বায়নের যুগে থেমে নেই শিল্প উন্নয়ন থেকে শুরু করে গ্রামীণ উন্নয়ন। আর শিক্ষার উন্নয়ন সেখানে বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রতি বছর লাখ লাখ শিক্ষার্থী নিজ দেশের সীমানা পেরিয়ে ছুটছে অন্য দেশে, আন্তর্জাতিক শিক্ষায় নিজেকে এবং নিজের দেশকে মেলে ধরতে। আর এই দৌড়ে বাংলাদেশর অবস্থান ঠিক সন্তোষজনক পর্যায়ে নেই বললেই চলে। আর এসবের পেছনে আছে সুনির্দিষ্ট কিছু কারণ,
লোক কথা : আমাদের সমাজের বেশিরভাগ মানুষই মনে করেন বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে অনেক টাকার প্রয়োজন। এই ভেবে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীদের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পিছিয়ে আসে উচ্চ শিক্ষায় নিজেকে মেলে ধরা থেকে। কিন্তু বাস্তব প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন।কারণ বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের টাকা নয় তাদের দক্ষতার উপরে ভিত্তি করেই দেয়া হয় যোগ্য শিক্ষার্থীদের।
গতবাধা সামাজিকতা : বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া কম-বেশি প্রতিটি শিক্ষার্থীকে তার শিক্ষাবর্ষের চতুর্থ বছরে এসে একটি প্রশ্নের উত্তর প্রায়ই দিতে হয়, আর তা হলো, পাশ করে বের হওয়ার পর সে কী করতে চায়?
আমাদের দেশের সামাজিক ব্যবস্থায় আমরা ছোটবেলা থেকে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ খুব কমই পেয়ে থাকি। ডাক্তার বাবা-মায়েরা চান তাদের সন্তানেরা ডাক্তার হোক, সরকারি কোনো বড় ইঞ্জিনিয়ার চান তার ছেলে-মেয়ে ছোটবেলা থেকেই ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ার বড় স্বপ্ন দেখুক, কেউ চান তার ছেলে-মেয়ে তার মতো ব্যবসায়ী হোক, আর সাম্প্রতিক সময়ের বিসিএস এর তুমুল চাহিদার যুগে এখন অনেক বাবা-মা চান তাদের ছেলে-মেয়েরা বিসিএস ক্যাডার হোক।
শিক্ষার মান : বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে শিক্ষার মানটাও খুব দরকার। আর বাংলাদেশের শিক্ষার মান এখনো আন্তর্জাতিক মানের স্তরে পৌঁছাতে পারেনি যার দরুন বাংলাদেশ এর শিক্ষার্থীরা প্রখর মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও
পিছিয়ে পড়েছে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ থেকে।
গবেষণায় অপ্রতুলতা : বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল স্তরে গবেষণা কে প্রাধান্য দেওয়া হয়। প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয় “Research by Education” নীতিতে বিশ্বাসী। সেখানে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে রিসার্চ নেই বললেই চলে। এখানে “Teaching by Education” নীতি মেনে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা করতে হয়। এই বৈশ্বিক ভিন্নতা ও গবেষণার অপ্রতুলতা বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।
সঠিক তথ্যের অভাব : নিজের দেশ পেরিয়ে অন্য দেশে লেখাপড়া করতে যেতে প্রতিটা শিক্ষার্থীদের অনেক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে অগ্রসর হতে হয়।আর এসব প্রক্রিয়ার জন্য দরকার বিশাল তথ্য, উপাত্ত। আমাদের দেশের বেশির ভাগ শিক্ষার্থী এসব তথ্য সমন্ধে উদাসীন। এজন্য মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও অনেক শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষায় নিজেকে মেলে ধরতে পারে না সঠিক তথ্যের অভাবে।
মূলত এসবের কারনে বর্তমান সময়ে বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে বাংলাদেশর প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয় বা সন্তোষজনক অবস্থায় পৌঁছাতে পারে না। কিন্তু বাংলাদেশের ও ব্যপক সম্ভবনা আছে আরো এগিয়ে যাবার। অনেকেই খুব অল্প বয়সেই সন্তানদের বিদেশে পাঠান লেখাপড়ার জন্য। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পড়াশোনার জন্য বিদেশে যাওয়ার ঘটনা ঘটে সাধারণত উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোনার পর। অবশ্য কেবল আন্ডারগ্র্যাজুয়েট পর্যায়েই নয়, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট বা ডক্টরেট (পিএইচডি) করতেও বিদেশে যান অনেকে। যা হোক, এ কথা সবারই জানা, শিক্ষার ক্ষেত্র সব সময়ের জন্যই সম্প্রসারণশীল। শিক্ষার ক্ষেত্র কখনোই নির্দিষ্ট গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকে না। দেশ-কাল-জাতি-সংস্কৃতি প্রভৃতির মধ্যে বিস্তৃতিই শিক্ষার মৌলিক ক্ষেত্র ও সীমানা হিসেবে বিবেচিত হয়। কেউ যদি প্রসারিত দৃষ্টিভঙ্গি ও বিচিত্র দক্ষতায় নিজেকে সমৃদ্ধ করতে চান, তবে দেশের বাইরে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই।বাংলাদেশের শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা গ্রহনের উদ্দেশ্যে বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইউনেস্কোর হিসেব অনুযায়ী, ২০১৯ সালে আমাদের দেশ থেকে বিদেশে পড়তে যাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৬০০০০ এর কাছাকাছি। আমাদের অনেকেরই ধারনা খুব মেধাবী এবং আর্থিক সচ্ছলতা না থাকলে বিদেশে পড়তে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু এই ধারনাটি সম্পূর্ণ সঠিক নয়। কেউ কেউ উপযুক্ত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সঠিক দিক নির্দেশনার অভাবে কিভাবে কি করতে হবে তা বুজে উঠতে পারেননা।শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্র কখনই নির্দিষ্ট সীমায় বন্দী থাকেনি। দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত যেমন শিক্ষার শেষ নেই, তেমনি শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রেও বিস্তৃতি ঘটেছে দূর-দূরান্তে। মানুষকে বিচিত্র দৃষ্টিভঙ্গি ও দক্ষতায় সমৃদ্ধ করেছে। বিদেশে উচ্চশিক্ষা ব্যক্তিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে সক্ষম। বিদেশে পড়া ছাত্রদের বুদ্ধিমত্তা ও মননশীলতা অধিকতর সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। নিজের গণ্ডি টপকিয়ে সামগ্রিক ও সাবলীল দৃষ্টিভঙ্গিতে ভাবতে শেখায়। স্বাধীনভাবে জীবনযাপন, অধিক দক্ষভাবে চিন্তা ও সৃষ্টিশীল কাজের ক্ষমতা অর্জিত হয়। আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি সম্পর্কেও ধারণা অর্জন সম্ভব হয়। তাই দেখা যায়, বিদেশে থাকার অভিজ্ঞতা অত্যন্ত মূল্যবান, এমনকি কখনো কখনো তা ব্যক্তির সামগ্রিক জীবনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে।
আগে গড়ুন নিজেকে :
চ্যালেঞ্জিং পেশায় সফল হওয়ার জন্য জরুরি সৃষ্টিশীল গুণ। আর সেই গুণ কমবেশি সবার মাঝেই থাকে। দরকার হয় গুণগুলোকে শানিত করার মাধ্যমে নিজেকে গড়ে তোলা। বিদেশে পড়তে যাওয়ার ক্ষেত্রেও দরকার হয় তেমনি কিছু গুণের। এক্ষেত্রে প্রথম প্রস্তুতি হতে পারে পড়াশোনার মাধ্যমে নিজেকে প্রস্তুত করা। আপনি যে কোর্সের জন্যই বিদেশে যান না কেন, আপনার সিজিপিএ যত ভালো হবে ভর্তির সুযোগ এবং স্কলারশিপের সুযোগ ততই সহজে মিলে যাবে। শুধু পড়াশোনাই নয়, ইচ্ছুক শিক্ষার্থীকে এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটির সঙ্গ
শুধু পড়াশোনাই নয়, ইচ্ছুক শিক্ষার্থীকে এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটির সঙ্গেও জড়িত থাকা প্রয়োজন। সেটা হতে পারে ডিবেট, ম্যাথ অলিম্পিয়াড, ফিজিক্স অলিম্পিয়াডের মতো বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া। স্বেচ্ছাসেবকের কাজও হতে পারে। তাছাড়া নাচ, গান, খেলায় পারদর্শী হওয়া, ছবি তোলা, বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারা বাইরে পড়তে যাওয়ার জন্য সহায়ক। পড়াশোনার পাশাপাশি পার্টটাইম চাকরি করার অভিজ্ঞতাও একটা ভালো কোয়ালিফিকেশন। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, বিদেশে পড়তে যাওয়ার ক্ষেত্রে ইংরেজিতে দক্ষতার পাশাপাশি অবশ্যই অপর ভাষা জানতে হবে। সেটি হতে পারে, জার্মান, ফ্রেঞ্চ কিংবা চাইনিজ। ভাষা জানা থাকলে এই দেশগুলোতে বৃত্তি পাওয়া অনেক সহজ। আর সত্যিকারের শিক্ষাটা কাজে আসবে এখানেই। আর এসব ভেবে শিক্ষার্থীদের প্রস্তত হতে হবে আগামী বিশ্বের জন্য। এভাবে সফলতার দ্বার উন্মোচন হবে বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য।এই ব্যপক সম্ভবনা কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যাওয়া শুধু সঠিক পরিকল্পনা ও সময়ের ব্যাপার মাত্র
মারুফ হাসান
শিক্ষার্থী : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়