———-
শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বলতে গেলে প্রথমে যে প্রশ্নটা আসে সেটা হচ্ছে, শিক্ষা বলতে কী বোঝায়?
ভিন্ন ভিন্ন মানুষের উত্তরও হয় ভিন্ন ভিন্ন।তবে ‘শিক্ষা’র আসল সংজ্ঞাটা কী?
‘শিক্ষা’র সংজ্ঞা নিয়ে কথা বলার আগে আমাদের জানতে হবে যে শিক্ষার প্রভাবটা আমাদের জীবনে কতটুকু।বর্তমান সমাজের দিকে তাকালেই তা বোঝা যায়। পিইসি, জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি তথা পাবলিক পরীক্ষায় সিংহভাগ বা শতভাগ পাশসহ জিপিএ ৫ প্রাপ্তির যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা দেখা যায় তা হয়তো আমাদেরকে খাতা-কলমে শিক্ষিত প্রমাণ করে কিন্তু এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা আমাদের করে তোলে শঙ্কিত।সচেতন মহলকে চিন্তা করতে বাধ্য করে দেশের ভবিষ্যত নিয়ে।
জিপিএ ৫ পাওয়াটা অবশ্যই আনন্দের কিন্তু এটা অর্জনের জন্য অসংগতিপূর্ণ চর্চা চিন্তার বিষয়।কেননা এই জিপিএ ৫ নামক সোনার হরিণ আমাদেরকে একটা সমাপ্তিহীন প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দিচ্ছে।সারা বছর বই খাতার সঙ্গে যোগাযোগ না থাকা ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলেও সে বলবে তার জিপিএ ৫ প্রয়োজন,নয়তো তার জীবন নষ্ট হয়ে যাবে।এর অর্থ কী দাঁড়ায় তবে?ছেলেটার জিপিএ ৫ চাওয়াটা অপরাধ? নাহ,অপরাধ না।কিন্তু সে যে নিজের যোগ্যতা মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ সেটা স্পষ্ট।বিনা পরিশ্রমে সর্বোচ্চ ফল প্রত্যাশা অপরাধ এবং এই অপরাধে অপরাধী আজ আমাদের দেশের সিংহভাগ শিক্ষার্থী।
মোতাহের হোসেন চৌধুরী তার “জীবন ও বৃক্ষ” প্রবন্ধে বলেছেন,”সৃজনশীল মানুষের প্রাপ্তি ও দানে পার্থক্য দেখা যায় না।যা তার প্রাপ্তি তা-ই তার দান”।যদি ইন্টারমিডিয়েটের কোনো শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞেস করা হয় যে, এই উক্তি কোন প্রবন্ধ থেকে নেয়া হয়েছে।তারা খুব ঝটপট এর উত্তর দিয়ে দিতে পারবে।কিন্তু যদি জিজ্ঞেস করা হয় এই উক্তির দ্বারা লেখক কী বোঝাতে চেয়েছেন তবে তাদের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমলেও আমি আশ্চর্য হবো না! আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ব্যর্থতা এখানেই।এই শিক্ষাব্যবস্থা আমাদেরকে পড়তে শেখায়,শিক্ষা দেয় না।আমাদেরকে কখনো স্ব মূল্যায়নে মানসিকতা গঠন করতে সহযোগিতা করে না।খাতায় সর্বোচ্চ নাম্বারটাই এখানে মূখ্য।মস্তিষ্কে কী আছে তা অদৃশ্যই রয়ে যায়।
স্ব মূল্যায়ন বলতে আমরা কী বুঝি? একটা ছাত্রকে যদি বলা হয় নিজের খাতা নিজে মূল্যায়ন করতে,সে হয়তো নিজেকে সর্বোচ্চ নাম্বার দিবে।কিন্তু সর্বোচ্চ নাম্বার দেয়ার আগে তার মাথায় কি প্রশ্নটা আসবে,যে সে এই সর্বোচ্চ নাম্বারের যোগ্য কিনা? আবার ধরি,একজন শিক্ষার্থী দেশপ্রেম সম্পর্কিত একটা রচনা পাঠ করলো কিন্তু রচনায় দেশপ্রেমের যে সকল উদাহরণ রয়েছে,সেগুলো পড়ে সেই শিক্ষার্থী কি নিজের সেভাবে গড়ে তোলার চেষ্টা করবে?নাকি রচনা পাঠ শেষে পরীক্ষার খাতায় লিখে নাম্বার পাওয়াটাই এখানে মূল উদ্দেশ্য?
স্ব মূল্যায়ন হচ্ছে নিজেকে যাচাই করতে পারা।নিজের দোষ গুণ বিশ্লেষণ করতে পারা।কোনো বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করে প্রতিক্রিয়া করাটাই স্ব মূল্যায়নের মূল বক্তব্য।কিন্তু এই বক্তব্য কি শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে? নাকি শেখানো হচ্ছে ভালো রেজাল্ট মানেই ভালো চাকরি আর সুন্দর ভবিষ্যত! প্রশ্নটা নিজেকেই করতে শিখতে হবে।
অনেকে এখন জিজ্ঞেস করতে পারেন যে নিজেকে মুল্যায়নে ব্যর্থতার সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থার সম্পর্ক কোথায়? সম্পর্ক রয়েছে।সেটা অনুধাবনের জন্য বুঝতে হবে “শিক্ষা”র সংজ্ঞা।
সংজ্ঞায় যাওয়ার আগে চলুন একটা উদাহরণ দিয়েই শুরু করা যাক।ধরুন একদল চোর গ্রামে বাড়ি বাড়ি চুরি করে বেড়ায়।এরপর একদিন ধরা পড়ে গণপিটুনি খেয়ে তাদের ‘শিক্ষা’ হয়ে গেলো তারপর থেকে তারা আর চুরি করে না।
উক্ত উদাহরণে “শিক্ষা”র সংজ্ঞাটা স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়! কাজটা নেতিবাচক হলেও “শিক্ষা”কে যেখানেই বসানো হোক না কেনো সেটা ইতিবাচিকই শোনাবে।
এখন আমরা যদি এখান থেকে ‘শিক্ষা’কে সংজ্ঞায়িত করি,তবে দাঁড়ায়, ‘কোনো ঘটনা বা উদ্দীপকের মাধ্যমে নিজের আচরণের কাঙ্ক্ষিত এবং স্থায়ী পরিবর্তন’।কিন্তু আমাদের সমাজের চিত্রপটে ভিন্নতা দেখতে পাই। যে যত বড় দুর্নীতিবাজ,সে তত শিক্ষিত।এটা কি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ব্যর্থতার কথা জানান দেয় না? আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যে একজন শিক্ষার্থীর মূল্যবোধে প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ সেটা জানান দেয় না? একটা গাধাও যদি নিয়মিত চেষ্টা করে হয়তো ঘোড়ার সঙ্গে দৌড়াতে পারবে তাই বলে কি আমরা যুদ্ধে গাধা নিয়ে যাবো?
২য় শ্রেণীর একটা শিশুকেও আজ ৮০% মার্ক্স না পেলে ‘গর্দভ’ বলা হচ্ছে।যার ফলে দেখা যাচ্ছে সিংহভাগ শিক্ষার্থী শুধুমাত্র জিপিএ ৫ এর জন্যই ‘শিক্ষিত’ হচ্ছে।কিন্তু আচরণের সেই কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আর হচ্ছে না।এরা ফিজিক্স বইটা খুলছে জিপিএ ৫ এর জন্য,নিউটন অথবা আইনস্টাইনের দেয়া তত্ত্ব জানার জন্য নয়।এরা জানে বইয়ের কোথায় কিভাবে পড়তে হবে কিন্তু এরা জানে না বইটা থেকে কী শিখতে হবে! এরা রবীন্দ্রনাথ,নজরুল শুধু পড়েই যায় কিন্তু তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে না। আর এভাবেই প্রতি বছর হাজারো নামে মাত্র শিক্ষিত শিক্ষার্থী চাকরির বাজারে মুখ থুবড়ে পড়ে।আর যারা চাকুরি পাচ্ছে তাঁরা নিজেদের স্বার্থে দেশকে বিক্রি করতেও দ্বিধা করছে না। কেননা এদের দেশপ্রেম বাংলা পরীক্ষার খাতাতেই সীমাবদ্ধ।যার ফলে একদিকে যেভাবে বাড়ছে দেশের বেকারত্ব,ঠিক তেমনভাবে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে অন্ধকার পথে।আলো দেখাবে কে?
সমস্যা চিহ্নিত করার তুলনায় সমাধান বের করা অধিক কষ্টের।তাই হয়তো আপনার মনে প্রশ্ন জাগবে এসবের সমাধান কী? কিভাবে বাঁচানো যায় আমাদের মাতৃভূমিকে? খুব সহজ।স্ব মূল্যায়ন বা নিজেকে মূল্যায়ন করা শিখতে হবে।কোনো রচনা বা প্রবন্ধ পড়ে ভাবতে হবে,তুলনা করতে হবে।নিজের শক্তি ও দূর্বলতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে।আর এই ধারণা তৈরি করে দিতেই শিক্ষার জন্ম।শিক্ষা এমন হবে যা আমাদের ভাবতে শেখাবে,বিশ্লেষণ করতে শেখাবে,শুধু মুখস্থ করা নয়।আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এমন হওয়া উচিত যেন শিক্ষার্থীরা ফিজিক্স বই আগ্রহ নিয়ে বসে।যেন নিউটন,আইন্সটাইনের তত্ত্ব জানতে পারে।তারা যেন আগ্রহ নিয়ে বাংলা পড়ে, যেন রবীন্দ্রনাথ,নজরুল সমাজের যে অবস্থা তুলে ধরেছে তা উপলব্ধি করতে পারে।যেন ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে এই সমাজে।
———-
তানভীর রহমান
শিক্ষার্থী,আরবী বিভাগ,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সদস্য,বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম