রফিকুল ইসলাম জসিম : ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, বিশেষ করে আসাম ও মণিপুর সীমান্তবর্তী অঞ্চল এক সময় ছিল ইসলামি শিক্ষার দিক থেকে অত্যন্ত পশ্চাৎপদ। ঠিক এই প্রেক্ষাপটে আবির্ভূত হন মণিপুরী মুসলিম সমাজের গর্ব, আলেম, সমাজসংস্কারক ও আধ্যাত্মিক সাধক হাফেজ আকবর আলী (রহ.)। তাঁর একান্ত প্রচেষ্টা ও ঐকান্তিক উদ্যোগে ১৮৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্যতম প্রাচীন ইসলামি শিক্ষাকেন্দ্র দারুল উলুম বাঁশকান্দি।
শিক্ষাজীবনের শুরু ও আধ্যাত্মিক পথচলা
আসামের কাছাড় জেলার বাঁশকান্দি গ্রামে জন্মগ্রহণকারী হাফেজ আকবর আলী (রহ.) শৈশবেই কোরআন হিফজ করেন এবং প্রাথমিক ধর্মীয় শিক্ষা লাভ করেন। জ্ঞানের প্রতি গভীর আগ্রহ তাঁকে নিয়ে যায় পবিত্র মক্কা শরীফে, যেখানে তিনি মহান আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব হযরত ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রহ.)-এর কাছে তিন বছর তাসাউফের শিক্ষা গ্রহণ করেন। এই আত্মশুদ্ধির শিক্ষাই ছিল তাঁর ভবিষ্যৎ জীবনের দিকনির্দেশনা।
বাঁশকান্দি মাদ্রাসার সূচনা ও প্রসার
মক্কা থেকে ফিরে এসে তিনি লক্ষ্য করেন, তাঁর এলাকার মানুষ ধর্মীয় অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত। এ অবস্থায় স্থানীয় এক ছোট্ট মসজিদের পাশে মাত্র তিনটি খরের ঘরে দারুল উলুম বাঁশকান্দি প্রতিষ্ঠা করেন। শুরুতে তিনি একাই পাঠদান করতেন—কোরআন, হাদিস, ফিকহ, আরবি ভাষা ও তাসাউফ ছিল তাঁর পাঠক্রমের মূল বিষয়।
পরবর্তীকালে হাকীমুল উম্মত হযরত আশরাফ আলী থানভী (রহ.)-এর খলিফা, হযরত মাওলানা আহমদ আলী বদরপুরী (রহ.)-এর সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠানটি ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয় এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের একপ্রকার দেওবন্দে পরিণত হয়। এখান থেকে বেরিয়ে আসেন শত শত আলেম, হাফেজ ও মুফতি, যাঁরা আজও দেশ-বিদেশে ইসলামের খেদমতে নিয়োজিত।
দাওয়াতি চেতনা ও সমাজ সংস্কার
হাফেজ আকবর আলী (রহ.) ছিলেন বিশুদ্ধ ইসলামি আকিদার প্রবক্তা। তিনি বিদআত, কুসংস্কার ও অজ্ঞতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। তাঁর মতে, “নফসকে শুদ্ধ না করলে সমাজ শুদ্ধ হবে না।” তাই তিনি আত্মশুদ্ধি, তাকওয়া, নামাজ, পর্দা ও ইখলাসের ওপর জোর দেন এবং মানুষকে এসবের প্রতি আহ্বান করেন।
হাফেজ আকবর আলী (রহ.)-এর অনন্য অবদান
হাফেজ আকবর আলী (রহ.) ছিলেন কেবল একজন শিক্ষক নন, বরং সমাজ গঠনের এক দূরদর্শী কারিগর। তাঁর অনন্য অবদানের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য:
ইসলামি শিক্ষার আলো জ্বালানো: ১৮৯৭ সালে দারুল উলুম বাঁশকান্দি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে উত্তর-পূর্ব ভারতে ইসলামি শিক্ষার বিস্তারে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন।
তাসাউফ ও আত্মশুদ্ধির প্রসার: আত্মিক জাগরণ, ইখলাস ও আধ্যাত্মিক শৃঙ্খলা প্রচারে অনন্য অবদান।
আলেম তৈরির কেন্দ্র: তাঁর প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা থেকে গড়ে ওঠে হাজারো আলেম ও ইসলামি নেতা।
বিদআতবিরোধী আন্দোলন: ধর্মীয় কুসংস্কার ও ভ্রান্ত বিশ্বাস দূর করে সুন্নাহভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা।
সমাজ সংস্কারমূলক কর্মসূচি: নামাজ, তাকওয়া, পর্দা, ও দাওয়াতি চেতনার পুনর্জাগরণ ঘটানো।
ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার
দারুল উলুম বাঁশকান্দি আজ কেবল একটি মাদ্রাসা নয়; এটি একটি ঐতিহাসিক আন্দোলনের প্রতীক, একটি আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের ধারক। এখান থেকে তৈরি হওয়া আলেমরা শুধু উত্তর-পূর্ব ভারত নয়, বরং সারা উপমহাদেশে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন।
হাফেজ আকবর আলী (রহ.) ছিলেন এক ব্যতিক্রমধর্মী আলোকবর্তিকা, যিনি মণিপুরী মুসলিম হয়েও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ইসলামি শিক্ষার এক অবিচল ভিত্তি স্থাপন করেন। তাঁর দাওয়াত, শিক্ষা ও আত্মশুদ্ধির মিলনে গড়ে ওঠা বাঁশকান্দি আজও ইসলামের খেদমতে নিবেদিত হাজারো প্রাণের প্রেরণাস্বরূপ।
সংক্ষেপে বলা যায়, হাফেজ আকবর আলী (রহ.) ছিলেন এক আধ্যাত্মিক বিপ্লবের সূচনাকারী, যিনি প্রান্তিক সমাজ থেকে উঠে এসে সমগ্র অঞ্চলের ইসলামি ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায় রচনা করে গেছেন।
লেখক : মণিপুরী মুসলিম গণমাধ্যমকর্মী
তথ্যসূত্র
১. দারুল উলুম বাঁশকান্দি: ইতিহাস ও অবদান, সম্পাদক: মাওলানা আব্দুল করিম কাসেমী, প্রকাশক: দারুল উলুম বাঁশকান্দি, ২০১০।
২. মণিপুরী মুসলিমদের ঐতিহাসিক রূপরেখা, লেখক: মো. ইমরান আহমদ, পিএইচডি গবেষণা, গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়।