মোঃ আরফাত হোসেন(আরেফিন)
টেরীবাজার,চট্টগ্রাম ।
রমজান এবং ঈদের কেনাকাটাকে সামনে রেখে আনা দুই হাজার কোটি টাকার কাপড় নিয়ে শঙ্কিত নগরীর প্রসিদ্ধ কাপড়ের ব্যবসাকেন্দ্র টেরীবাজারের ব্যবসায়ীরা। এসব কাপড় বাজারের দুই হাজার ব্যবসায়ীর দোকানে এবং গুদামে রাখা আছে। পথেও রয়েছে বিপুল পরিমাণ কাপড় ও পোশাক। করোনা পরিস্থিতিতে এসব কাপড়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় ব্যবসায়ীরা। কাপড়গুলো কী অবস্থায় আছে? কখন খোলা যাবে? এর উত্তর অজানা। পুঁজি নিয়ে শঙ্কার পাশাপাশি পনের হাজারের বেশি কর্মচারীর বেতন-ভাতা যোগানোও কঠিন হয়ে উঠেছে। আবার কারো কারো কাছে বেতন-ভাতার চেয়ে এই মুহূর্তে কর্মচারীদের বাঁচিয়ে রাখাটাই কঠিন হয়ে উঠেছে। পহেলা বৈশাখ, রমজান এবং ঈদের ব্যবসা করতে পুঁজির পুরোটা বিনিয়োগ করা ব্যবসায়ীদের অবস্থা খুবই নাজুক। সরকারের বিশেষ প্রণোদনায় আনা না হলে এসব ব্যবসায়ীর অনেকেই দেউলিয়া হয়ে যাবেন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। চট্টগ্রামের টেরীবাজার দেশের প্রসিদ্ধ একটি কাপড়ের বাজার। বিভিন্ন ধরনের কাপড়ের পাইকারি ও খুচরা এই বাজারে ৮২টি মার্কেটে দুই হাজারেরও বেশি দোকান আছে। ছোট-বড় মিলে এসব দোকানে বিনিয়োগ রয়েছে অন্তত দুই হাজার কোটি টাকার। দোকানগুলোতে কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় পনের হাজার। প্রতি মাসে কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ কমপক্ষে পনের কোটি টাকা ব্যবসায়ীদের পরিশোধ করতে হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, টেরীবাজারে বছর জুড়ে ব্যবসা-বাণিজ্য চলে। তবে সবচেয়ে জমজমাট ব্যবসা চলে ঈদ এবং রোজাকে সামনে রেখে। গত কয়েক বছর ধরে পহেলা বৈশাখও টেরীবাজারে ব্যবসার বড় অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। টেরীবাজারের কাপড় এবং পোশাকের সত্তর শতাংশ আসে দেশের বিভিন্ন কারখানা থেকে। ত্রিশ শতাংশ আমদানি করা হয় ভারত ও পাকিস্তান থেকে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, পুরো বছর কোনো রকমে ব্যবসা করা হয়। মুনাফা এবং পরিচালন ব্যয় মোটামুটি কাছাকাছি থাকে। খুব বেশি পুঁজিও খাটাতে হয় না। কিন্তু ঈদের ব্যবসা সামনে রেখে যার যা আছে সব টাকা বিনিয়োগ করা হয়। ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া হয়। বন্ধু-বান্ধব থেকে ধার করা হয়। ব্যবসার পার্টনার হিসেবে নেয়া হয় টাকা। মুনাফা দেয়ার কথা বলেও যোগাড় করা হয় অর্থ। ব্যবসায়ীরা যে যেখান থেকে পারেন টাকা যোগাড় করে পুঁজি বিনিয়োগ করেন। শবে মেরাজের পর থেকে ব্যবসা জমতে শুরু করে। শবে বরাত কিংবা রোজার আগ পর্যন্ত অধিকাংশ ব্যবসা হয়ে যায়। রোজায় অনেকেই কেনাকাটা করেন। এভাবে শবে মেরাজ থেকে ঈদের কেনাকাটা পর্যন্ত প্রতিটি দোকানই জমিয়ে ব্যবসা করে। এর মধ্যে পহেলা বৈশাখের ব্যবসাও জমে ওঠে।
টেরীবাজারের ব্যবসায়ীরা শবে মেরাজের আগেই সব কাপড় দোকান ও গুদামে নিয়ে আসেন। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ভারত এবং পাকিস্তান থেকে কয়েকশ কোটি টাকার কাপড় আনা হয়েছে। এলসির মাধ্যমে ব্যাংকিং চ্যানেলে আনা এসব কাপড়ের মূল্য পরিশোধ হয়ে গেছে। বিদেশি কাপড়গুলো কিছু দোকানে, কিছু গুদামে, কিছু ঢাকা এয়ারপোর্টে, কিছু বেনাপোল কিংবা কলকাতায় আটকা পড়ে আছে। দেশীয় কারখানা থেকে কেনা কাপড়গুলোও এভাবে দোকান, গুদামসহ পথে-ঘাটে রয়েছে। এসব কাপড়ের কী অবস্থা, কাপড়গুলো ঠিকঠাক আছে কিনা, নাকি ইঁদুর বা উইপোকায় কাটছে তা নিয়েও কেউ কেউ শঙ্কায় আছেন। তারা বলেছেন, আমাদের দোকান প্রতিদিনই খুলতাম। ঝাড়মোছ করতাম। এখন প্রায় এক মাস দোকান ও গুদাম বন্ধ। কী হচ্ছে বুঝতে পারছি না।
করোনা পরিস্থিতিতে গত ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করায় টেরীবাজারের ব্যবসায়ীদের সব আয়োজনই মুখ থুবড়ে পড়ে। পহেলা বৈশাখ কিংবা ঈদের জন্য আনা পোশাক বিক্রি করতে পারেননি। টেরীবাজারের একজন ব্যবসায়ীও তাদের কেনা কাপড়গুলো গোছানো কিংবা ব্যবসা করার সুযোগ পাননি।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, সব টাকা দিয়ে কাপড় এনেছি। কাপড় বিক্রি করতে পারলে হাতে টাকা আসত। এখন চোখে-মুখে অন্ধকার দেখছি। পরিস্থিতি এত ভয়াবহ যে, কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দেয়া কঠিন হয়ে উঠেছে।
টেরীবাজারের ব্যবসায়ীরা বলেন, সরকারের বিশেষ প্রণোদনায় যদি আমাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, আমরা যদি স্বল্প সুদে কিছু ঋণ পাই, তাহলেই কেবল এই দুর্যোগ মোকাবেলা করতে পারব। আমাদের পক্ষে কর্মচারীদের বেতন দেয়া এবং তাদের বাঁচিয়ে রাখা কঠিন হয়ে উঠেছে। সরকারের সহায়তা না পেলে ব্যবসায়ীদের অনেকেই দেউলিয়া হতে পারে।
নগরীর ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র টেরীবাজারের অবস্থা শোচনীয় উল্লেখ করে টেরীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আলহাজ্ব আবদুল মান্নান বলেছেন, অবর্ণনীয় এক দুর্ভোগে পড়েছেন টেরীবাজারের ব্যবসায়ীরা। একেবারে অচেনা সমস্যা। এর আগে কোনোদিন এই ধরনের পরিস্থিতি হয়নি। এখন ব্যবসা দূরে থাক, পুঁজি হারিয়ে দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম হচ্ছে।
আবদুল মান্নান আরোও বলেন, প্রায় দুই হাজার ব্যবসায়ীর চোখে ঘুম নেই। পনের হাজারেরও বেশি কর্মচারীর বেতন-ভাতা যোগাতে গিয়ে নতুন সংকটে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখাটাই কঠিন হয়ে পড়েছে।
টেরীবাজারের দোকানগুলোতে অন্তত দুই হাজার কোটি টাকার পোশাক ও কাপড় রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এক টাকাও বিক্রি হয়নি। কোনো ব্যবসায়ীর হাতে টাকা নেই। কী করে কী করবেন তা কেউ বলতে পারছেন না। সমিতির অফিসে বৈঠকের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের চোখের পানি এবং কান্নায় পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। কারো মাঝে স্বস্তি নেই।
শত শত কোটি টাকা ব্যাংক লোন নিয়ে ব্যবসায়ীরা পুঁজি বিনিয়োগ করেছেন। কোনো কোনো ব্যবসায়ী এসএমই, টার্ম লোন এবং ওডি মিলে চার-পাঁচটি ব্যাংক থেকেও টাকা নিয়েছেন। যে যত পেরেছেন কাপড় এবং পোশাক এনেছেন। আনার প্রক্রিয়া চালিয়েছেন। একেকটি দোকানে বিশ-পঞ্চাশ কোটি টাকার পণ্য তোলা হয়েছে। কিন্তু সবই আটকা পড়েছে। এখন তারা দিনে এনে দিনে খাওয়ার অবস্থায় পড়েছেন। কারো পকেটে টাকা না থাকায় কর্মচারীদের খাবারের যোগান দেয়াই কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, কর্মচারীদের অনেকেই মেসে থাকেন। তাদের খাবারের যোগান দোকান মালিক দিয়ে থাকেন। এমন দুর্দিনে একেকজন ব্যবসায়ীকে যেখানে নিজের পরিবার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে, সেখানে কোনো কোনো ব্যবসায়ীকে বিশ-পঞ্চাশ জন কর্মচারীকে রেগুলার খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হচ্ছে।