বাংলাদেশের বসবাসরত একমাত্র মুসলিম ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী মণিপুরী পাঙাল সম্প্রদায়ের মধ্যে হাফেজ ক্বারী মাওলানা কাউকাব উদ্দিন ও হাফেজ ক্বারী মাওলানা যোবায়ের আহমদ কোরআনের হাফেজ হয়েও মাদরাসায় পড়াশুনার পাশাপাশি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ হতে, অনার্স (সম্মান) এবং মাস্টার্সে ঈর্ষণীয় ফলাফল করায়। তাদের মেধার কৃতিত্বের মাধ্যমে মুসলিম মণিপুরি সমাজে মাদ্রাসা পড়াশোনা চর্চাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তরুণ দুই মেধাবী হাফেজ শিক্ষার্থীর জীবনের কয়েকটি ধাপে মুখোমুখি হয়েছিলেন ব্যতিক্রমী সব অভিজ্ঞতার কথা। তাদের জীবনের গল্প লিখেছেন রফিকুল ইসলাম জসিম।
হাফেজ ক্বারী মাওলানা মোঃ কাউকাব উদ্দিন ১৯৯৪ সালে ফেব্রুয়ারী মাসের প্রথম দিনে মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার তিলকপুর গ্রামে একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম মণিপুরি (পাঙাল) পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মাওলান তমিজ উদ্দিন সিলেটের গহরপুর মাদরাসার শিক্ষক ছিলেন এবং চিৎলিয়া নাজির হাসান ইসলামিয়া দাখিল মাদরাসা সহকারী হিসেবে শিক্ষকতা পেশায় ছিলেন। এছাড়াও জাঙ্গলিয়া জামে মসজিদে ২০ বছর যাবত ইমাম ও খতিবের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১০ সালে অবসর গ্রহন করে ২০১২ সালে তিনি মৃত্যুবরন করেন। হাফেজ কাউকাব সহ চার ভাইবোন। তাদের মধ্যে তিনি তৃতীয় এবং বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে কর্মরত মো: হেলাল উদ্দিন তার অগ্রজ।
হাফেজ ক্বারী মাওলানা কাউকাব উদ্দিন রানীর বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে ২০০২ সালে আদমপুর বাজার হাফিজিয়া মাদরাসায় ভর্তি হন। ২০০৮ সালে সেখান থেকে তিনি পবিত্র কোরআন শরীফ হিফজ সম্পন্ন করেন। একই বছরের ইত্তেহাদুল কুররা বাংলাদেশ ক্বারিয়ানা সনদ পরিক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছেন৷ এরপর ২০০৯ সালে সফাত আলী সিনিয়ার ফাযিল মাদরাসায় নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে ২০১১ সালে দাখিল (SSC)পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং একই বছর দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্ট থেকে ক্বারীয়ানা ছাদিছ পরিক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়। পড়াশোনা পাশাপাশি ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত রানীর বাজার মদিনা মসজিদে ইমাম ও খতিবের দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি৷ ২০১৩ সালে একই প্রতিষ্ঠান সফাত আলী সিনিয়র ফাযিল মাদরাসা থেকে আলিম (HCS) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ২০১৬ সালে ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া এর অধীনে সালে ফাযিল (বি এ)পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। অন্যদিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ২০১৪ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে ভর্তি হয়ে ২০১৮ সালে অনার্স (সম্মান) ও ২০১৯ সালে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ থেকে এম এ পরীক্ষায় ঈর্ষণীয় ফলাফল অর্জন করেন৷ এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমী থেকে ২০১৭ সালে প্রশিক্ষন গ্রহন করে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ লাভ করেন৷ এরপর ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় এর অধীনে মৌলভীবাজার টাউন কামিল মাদরাসা হতে ২০১৯ সালে হাদিস বিভাগ থেকে কামিল পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ছাত্রজীবনে তিনি বাংলাদেশ মণিপুরি মুসলিম মাদরাসা ছাত্র কল্যান পরিষদ এর সাবেক সহ সভাপতি ও বাংলাদের মুসলিম মনিপুরি ছাত্র কল্যান পরিষদ এর ক্রীড়া সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
রফিকুল ইসলাম জসিম : কোরআনের হাফেজ হয়েও আলীয়া মাদ্রাসায় কীভাবে পড়াশোনা শুরু করলেন?
হাফেজ মাওলানা কাউকাব উদ্দিন : আমার বাবা কওমী মাদরাসায় পড়াশুনা করেছেন এবং আলীয়া মাদরাসায়ও পড়েছেন এবং নাজির হাসান ইসলামিয়া দাখিল মাদরাসায় শিক্ষকতা করেছেন। আমি হিফজ পড়াকালীন অবস্থায় আমি প্রতিদিন বাবাকে নিয়ে বাবার মাদরাসা দিয়ে আমি আমার হিফজ ক্লাসে যেতাম। এবং আমার ক্লাস শেষ করে বাবাকে বাইকে করে বাড়িতে নিয়ে আসতাম। তখন দেখতাম বাবার অনেক ছাত্র আলীয়া মাদরাসায় পড়াশুনা করে দ্বীনের অনেক খেদমত করতেছে এবং দেশের বিভিন্ন সেক্টরে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতেছে। তখন থেকেই হিফজে পড়াশুনা করা অবস্থায় আমার আলীয়া মাদরাসায় পড়াশুনা করার আগ্রহ তৈরি হয়।
রফিকুল ইসলাম জসিম : আপনার পড়াশোনা সাফল্যের পেছনে কারা অনুপ্রেরণা দিয়েছিল ?
হাফেজ মাওলানা কাউকাব উদ্দিন : এ সবকিছুতে যার সবচেয়ে বড় অবদান তিনি হলেন আমার বড় ভাই মো হেলাল উদ্দিন। এবং আমার মা।আমার বড় ভাই যিনি আমাকে আমার বাবা মারা যাওয়ার পর আমার বাবার অভাব বুঝতে দেইনি। আমার পড়াশুনার যত কিছু প্রয়োজন ছিল, আর্থিক দিক এবং মানষিক দিক দিয়ে সব দিক থেকে আমি আমার বড় ভাই এর অবদান চিরকৃতজ্ঞ থাকবো।এবং আমার যা কিছু অর্জন আমি আমার মা-বাবা এবং ভাই এর প্রতি উৎসর্গ করলাম৷
হাফেজ ক্বারী মাওলানা যোবায়ের আহমদ ১৯৯৬ সালে ২৫ ডিসেম্বর মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার ভানুগাছ বাজারে একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম মণিপুরি (পাঙাল) পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পরিবারের ৬ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। পিতা: হোসেন আহমদ,দাদা বিশিষ্ট কাপড় ব্যবসায়ী মরহুম হাজী তোরাব আলী।
হাফেজ ক্বারী মাওলানা যোবায়ের আহমদ প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় দক্ষিণ কুমড়াকাপন বায়তুল আমান জামে মসজিদে মক্তব শিক্ষার মাধ্যমে, পরবর্তীতে ভানুগাছ বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন। পরে ঐতিহ্যেবাহী আদমপুর বাজার হাফিজিয়া মাদরাসা হতে ২০০৮ সালে হিফজ সম্পন্ন করেন। এরপর ২০০৯ সালে সফাত আলী সিনিয়ার ফাযিল মাদরাসায় অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে ২০১২ সালে দাখিল (SSC) এবং ২০১৪ সালে একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে আলিম (HCS) পরীক্ষায় A+ উত্তীর্ণ হয়। এরপর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ হতে, অনার্স (সম্মান) এবং মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। পাশাপাশি সফাত আলী সিনিয়র ফাযিল মাদরাসা হতে ২০১৭ সালে ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়,কুষ্টিয়া এর অধীনে ফাযিল (বি,এ) সম্পন্ন করেন এবং ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় এর অধীনে ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি প্রতিষ্ঠান মৌলভীবাজার টাউন কামিল মাদরাসা হতে ২০২০ সালে হাদিস বিভাগ থেকে কামিল(মাস্টার্স) সম্পন্ন করেন। এছাড়াও ২০০৬ সালে দারুল ক্বিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাষ্ট হতে ক্বারীয়ানা সম্পন্ন করেন, ২০১৭ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমি, সিলেট হতে ৪৫ দিনের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেন, ২০১৯ সালে সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে ৬ কম্পিউটার প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেন।
রফিকুল ইসলাম জসিম : হাফেজ ও মাদ্রাসাশিক্ষার্থী হাওয়া সত্বেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে চান্স পেলেন ?
হাফেজ ক্বারী মাওলানা যোবায়ের আহমদ: আলিম পাস করার পর আমাদের আগের ব্যাচের বড় ভাইরা যখন পাবলিক ইউনিভার্সিটির জন্য পরিক্ষা দিয়েছে বলে জানতে পারি তারপর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগ্রহ সৃষ্টি হয়। আলিম পরীক্ষার পর শ্রীমঙ্গলে ইউনিভার্সিটি কোচিং-এ ভর্তি হয়। আর মাদ্রাসা ব্যকরাউন্ড হওয়ায় পরিবারের ইচ্ছে ছিলো ইসলামিক সাবজেক্ট নিয়ে পড়ি, তাই শুধুমাত্র কুষ্টিয়া ইসলামি ইউনিভার্সিটি আর চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটিতে আবেদন করেছিলাম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স হয়ে যাওয়ায় কুষ্টিয়ায় আর পরীক্ষা দেওয়া হয়নি৷ আমার লেখাপড়া সম্পন্ন করার পিছনে পরিবারের অনেক ত্যাগ আছে। তাই আমি আমার পরিবারের সবার প্রতি কৃতজ্ঞ, তাঁরা আর্থিক এবং মানষিক ভাবে সাপোর্ট না দিলে আমার উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করা স্বপ্নই থেকে যেতো।