রওশান আরা বাঁশি :
আমার ছোট বেলার ঈদ ছিল রঙিন প্রজাপতি পাখনায় ভর করা উচ্ছল চঞ্চল আনন্দের বন্যা। ছিলো অন্যরকম অনুভুতি । এখন যেমন ঈদের দশ পনেরো দিন আগ থেকে শুরু হয়ে যায় কেনাকাটার দৌড় ঝাপ -- তখন এ ব্যস্ততা ছিলোনা। বাবা পুলিশে চাকুরি করতেন।নিয়ম শৃংখলা পছন্দ করতেন। আমরাও তা মেনে চলতাম।
ঈদ আসলে ঈদের আনন্দে ঘর পরিস্কার,কাপড় কাঁচা,উঠান পরিস্কার নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। ঈদের আনন্দ আমেজ মনে লেগেই থাকতো। ঈদের দিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠতাম। কে কার আগে গোসল করব-- এ প্রতিযোগিতা ছিল। নতুন কাপড় পড়ে মায়ের হাতের সেমাই,বিন্নি চালের গুড়ো দিয়ে তৈরি করা মজাদার পিঠা থাউ তল(গুড় মিশ্রিত তেলের পিঠা),মারোই তল (নানান মসলা দিয়ে তৈরি পিঠা)চিনি তল(চিনি,মসলা মিশ্রিত পিঠা)খেতাম।ঐতিহ্যবাহী এ পিঠা ছাড়া ঈদ যেন চলেই না। মুরুব্বিদের সালাম করতাম। নতুন কাপড় নতুন জুতোর তেমন কম্পিটিশন ছিলনা। বাবা যা কিনে দিতো তাতেই খুশি হতাম।
রোজা ঈদে কেনা নতুন জামা কাপড় দিয়ে কোরবানি ঈদও চলে যেতো।দল বেঁধে এ-বাড়ি ও-বাড়ি ঘুরে বেড়াতাম। গ্রামে যে বাড়িতে বছরে একবারও যাওয়া হত না,ঈদের দিন সে বাড়িতেও যেতাম। প্রত্যেক বাড়ি যেন নিজের বাড়ি-নিজের ঘর। কেহ খালি মুখে ফিরাতেন না। পাড়া প্রতিবেশীর আতিথেয়তার মধ্যে এতটাই আন্তরিকতা ও স্নেহ ছিল --খুউব ভাল লাগতো। কোন কোন বাড়িতে কলা পাতায় খাওয়াত--বার বার থালা বাটি ধোওয়ার ঝামেলা এড়াতে এ ব্যবস্থা। আমরা বেশ খুশি মনে খেতাম।
ঈদের আগের দিন সন্ধ্যা বেলা চাঁদ দেখার আনন্দ ছিল অন্য রকম। সবাই মিলে ফাঁকা মাঠে দাঁড়িয়ে বা উচুঁ গাছের ফাঁকে চাঁদকে মেঘের আড়াল থেকে খুঁজে বের করতাম। যে আগে চাঁদ দেখতে পেতো তার নাম উপস্হিত সবার মুখে মুখে থাকতো। খুব মনে পড়ে আমার মায়ের হাতে কাজ করা সেই সাদা টেবিল ক্লথ আর বাবার সখ করে কেনা সেই পিতলের ফুলদানি। প্রতি ঈদে ট্রাঙ্ক থেকে বের করে ঘর সাজাতাম। ঝকঝকে মাজা পিতলের ফুলদানিতে নানা রকমের টাটকা ফুল সাজিয়ে রাখতাম। এতে ঈদের আনন্দ আমেজ নতুনত্ব খুঁজে পেতাম। ঈদের আগের দিন বাবার প্রিয় ফিলিপস রেডিওতে শুনতাম সেই চিরচেনা গান "রমজানেরই রোযার শেষে এলো খুশির ঈদ" যা- আনন্দের মাত্রা বাড়িয়ে দিত দ্বিগুণ। খুব মনে পড়ে বাবার সাথে গ্রামের মসজিদে ঈদের জামাতে যেতাম।আমরা ছোটরা মসজিদের বাইরে বসে থাকতাম আর দুষ্টুমি করতাম। মনে পড়ে ঈদের দিন গ্রামের মুরুব্বী মা,খালা,চাচী দাদী,নানীরা ঈদের খুৎবা শুনার জন্য মসজিদের একটু দূরে দল বেঁধে আড়ালে বসে থাকতো।ঈদের মোনাজাতে শরীক হতেন। আমার বাবা ছিলেন অত্যন্ত বন্ধু বৎসল মানুষ। ঈদের দিন বাড়িতে আত্মীয় স্বজনরা বেড়াতে আসতো। তাদের সাথে বাবা প্রাণ খুলে গল্প করতেন। এক সাথে বসে খেতেন । খাবার টেবিলে মার কাজে সাহায্য করতাম। আমার খুব ভালো লাগতো।
আজ স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কেন যেনো চোখ ছল ছল করে উঠলো। দু'দিন পরেই ঈদুল ফিতর কিন্তু এবারের ঈদে কারও মুখে হাসি নেই। ঘর বন্দী বেদনাময় ঈদ পালন করতে যাচ্ছি তবুও সান্ত্বনা যে অন-লাইনে সবার সাথে যোগাযোগ রাখতে পারছি। সবাইকে ঈদ মোবারক।
সম্পাদক ও প্রকাশক: রফিকুল ইসলাম
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-১৩১০