প্রিয় বাবা,
আমার সালাম নিবেন। আশা করি যেখানেই আছেন ভালো আছেন।
দীর্ঘ এক বছর হয়ে গেলো আপনাকে দেখি না। হয়তো চাইলেই আর দেখা করতে পারবো না। আপনার কাছে আপনার জীবনের চেয়েও যদি কোনো দামী কিছু থাকে, জানি সেটা আমিই। আর সব বাবা মায়ের কাছেই তাদের সন্তান তাদের জীবনের চেয়ে বেশি দামী। আপনার কাছে আমার একটু বিশেষ গুরুত্ব আছে আর সেটারও কারণ আছে। বিয়ের ১৬ বছর পর যদি কেউ বাবা হতে পারে তাহলে এই আনন্দ সে ছাড়া পৃথিবীর কারো বুঝা সম্ভব নয়। আর আমারো মন্দ কপাল, না হয় আমার জন্মের ১ -২ বছর পর আপনি ব্রেন স্টোক কেন করেছিলেন? আপনার অসুস্থতার জন্য হয়তো সব বাবার মতো আমাকে নিয়ে আপনি খেলতে পারেননি। কিন্তু তাও যা করেছেন একজন পেরালাইসিস আক্রান্ত বাবা হয়ে, তা আমার বলে বুঝানো সম্ভব নয়।সব মা তাদের সন্তানের টয়লেট পরিস্কার করেন এটা সাধারণ। কিন্তু আজকাল খুব কম বাবাই থাকে যারা নিজ ইচ্ছায় নিজের সন্তানের টয়লেট হাতে নেয়। জীবনে এমন কিছু নাই যা আমি চেয়ে পাই নাই আপনার কাছ থেকে।
আপনি পেরালাইসিস, হার্ট এট্যাক, ব্রেন স্ট্রোক, ডায়াবেটিসসহ আরো অনেক রোগেই আক্রান্ত হয়ে যান। আপনি আমার কাঁধের উপর হাত রেখে রাস্তায় হাটতেন আর আমি মাঝে মাঝে খুব বিরক্ত হতাম। তখনো বুঝতে পারিনি যে বাবা একটা সন্তানের কাছে কী? এখন বুঝি।
যদি কখনো বাসায় আসতে দেরি হতো আপনি যখন ফোন করে জানতে চাইতেন বাবা তুমি কই? বাসায় আসো তাড়াতাড়ি। তখন বুঝতে পারতাম, বাবা যার নাই তার মোবাইলে তো এমন বাবা নামের কেউ ফোন করে খোঁজ নেয় না। তখন নিজেকে খুবই ভাগ্যবান মনে করতাম, এজন্য যে আমার আর কিছু না থাকলেও বাবা-মা আছে।
বাসায় যখন ফিরতাম তখন আপনার রুমে উঁকি মেরে দেখতাম যে আপনি কি করেন?তখন এক রকম শান্তি লাগতো যা তখন পুরোপুরি না বুঝলেও এখন অনুভব করি যখন বাসায় ফিরে আপনার রুমে নিজের অজান্তেই আপনার চেয়ারের দিকে তাকিয়ে দেখি কেউ বসা নেই।
বাবা আপনি কি জানেন এগুলো আমি কেন লিখতে বসছি? কোনো এক প্রতিযোগিতায় আপনাকে নিয়ে লিখে পুরস্কার পাওয়ার জন্য! বাবা এমন হতো পুরস্কার হিসেবে আমি আপনাকে একটিবার দেখার সুযোগ পেতাম তাহলে হয়তো আমার জন্য সেরা পুরস্কার পেয়ে যেতাম।
রাতে ঘুমানোর সময় পিঠে হাত বুলিয়ে দেওয়া, কোনো কিছু খাওয়ার সময় ডাক দেওয়া যে আমি পাইছি কিনা আমার ইচ্ছেমতো, আপনার চেহারাটা দেখে শান্তি পাওয়া,আপনার মুখে বাবা ডাক শোনা এসব আমার সাথে এখন আর কেউ করে না, বাবা।
আপনাকে আমি বাবা কখনো বলি নাই, সবসময় বলতাম আব্বু। আব্বু তোমাকে নিয়ে কিছু ভাবলে বা লিখলে আমার মতো কঠিন মানুষের চোখ থেকেও পানি বের হয়ে আসে আর আমি এখনো এটা লিখার সময় কান্না করছি আর হাত দিয়ে চোখ মুছতেছি যাতে আমার আম্মু না বুঝতে পারে। আগে কবরস্থান এ কারো সাথে গেলে একটা ভয় কাজ করতো আর এখন আপনার কবর জিয়ারত করতে করতে কবরস্থানটাও খুব পরিচিত হয়ে গেছে। এখন যেন ভয়টাকে নিজের অজান্তেই হারিয়ে ফেলছি।
সবাই যখন তার বাবাকে নিয়ে আলোচনা সমালোচনা করে তখন আমি ভাবি আমি আমার আব্বুতো বেঁচেই নেই। তাহলে আমি কি নিয়ে কথা বলবো? তখন নিজের চোখের পানি আড়াল করার জন্য তাদের সেখানে রেখেই আমার চোখের পানি ফেলার জায়গা খুঁজে নিতে হয়। যেখানে আল্লাহ ছাড়া আর কেউ দেখবে না।
আব্বু আপনাকে নিয়ে আর লিখতে চাই না, কারণ চোখের পানি মুছে আমার জন্য লিখাটা কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আল্লাহ আপনার সমস্ত গুনাহ মাফ করে দিয়ে আপনাকে জান্নাত দান করুক আর আর আপনি আপনার সন্তানদেরকে যেভাবে লালন পালন করেছেন আল্লাহ আপনাকে তেমনি রাখুক।
ইতি
আপনার বড় ছেলে
আলআমীন আহমেদ (অভি)
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ইকবাল/এসএফ/ঢাকা।