ঢাকামঙ্গলবার , ৫ নভেম্বর ২০২৪
  1. সর্বশেষ
  2. বিশেষ সংবাদ

বাবা, জংলিটা তোমায় খুব মিস করে

প্রতিবেদক
নিউজ ভিশন
২১ জুন ২০২০, ১০:৫১ পূর্বাহ্ণ

Link Copied!

নাফিসা তাবাসসুম মিথিলা।
আমার আব্বু। অন্যান্যদের আব্বুর মতন সকালে উঠে কাজে যেতেন না। সারাদিন কাজ করে  রাতে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে হাঁক দিয়ে আমায় আদর করতেন না। অথবা মাঝরাতে বাড়ি ফিরে ‘ঘুমন্ত আমি’র কপালে চুমো এঁকে নিজে ঘুমোতে যেতেন না। পড়তে বসাতেন না, স্কুল ছুটির সময় রোজ আমায় আনতে যেতেন না। মন খারাপ করলে বা কোনো কিছুর আবদার থাকলেও, আমারও কখনও আব্বুর গলা জড়িয়ে ধরে আহ্লাদ করা হয়নি। বলা বাহুল্য, ‘বাপের শাসন’ও পাইনি কখনও। আমার আব্বু তো আর সবার আব্বুর মতন ছিল না। উনি ‘পাগল’ ছিলেন। বিদ্রুপার্থে-পাগলা। ভদ্দলোকের ভাষায় বললে- ‘মানসিক ভারসাম্যহীন’ ছিলেন আমার আব্বু। হিতাহিত জ্ঞান ছিল না একেবারে, তা নয়। সমস্ত জ্ঞানই প্রায় ছিল, তবে এলোমেলা। ভালোবাসা বোঝার আর ভালোবাসার জ্ঞান, সৃষ্টিকর্তার সব সৃষ্টিতেই থাকে বলে বিশ্বাস করি। আব্বুর মধ্যে তার কমতি তো ছিলই না, বরং বেশিই ছিলো।

ছোট বেলা আমার চুল সবসময় আলুথালু থাকত বলে, আব্বু আমাকে ‘জংলি’ বলে ডাকতেন! পান খাওয়ার জন্য দাদার কাছ থেকে দৈনিক যে সামান্য টাকা তিনি পেতেন , তার মধ্যে আমারও ভাগ ছিল বৈকি! পান কেনার পর বা বাকিতে পান খেয়ে আমার জন্য প্রায়ই ১টাকার অ্যালপেনলিবে কিনে আনতেন।

প্রতিবেশী, আব্বুর শিক্ষকবৃন্দ, দাদা-দীদার কাছে শুনেছি- আব্বু ছোট্ট বেলায় তুখোড় ছাত্র ছিলেন। মানসিক স্থবিরতা হারানোর পরও তাই কাগজকে ছাড়তে পারেননি। ফেলে দেয়া কাগজের টুকরেতে তো বটেই, কখনও কখনও আমার জরুরি কাগজেও না বুঝেই লেখালেখি করতেন। অনর্থক লেখালেখি নয়, ঠিকানা বা কয়েক লাইনের কবিতা। জরুরি কাগজ খোয়ানোয় চটার ভানও করেছি বহুবার। তবে সত্যি বলতে গেলে আমার আব্বুর এসব অভ্যেস আমার কেমন যেন সয়ে গেছিল! রাগ হতো না!

আর কোনো ভাই-বোন নেই আমার। তাই আমার ‘শিশুপ্রায় আব্বু’র সাথেই লুকোচুরি খেলতাম রোজ। দীদা আমাকে খাইয়ে দিলে আব্বুর হিংসাও হত। আমরা ঝগড়া করতাম ভাই-বোনের মত, খুনসুটি করতাম, খেলতাম…আরও কত কী! স্কুলের সাময়িক পরীক্ষার সময় বাসায় কিছু না বলেই মাঝেমধ্যে আব্বু আমাকে পরীক্ষা শেষে স্কুল থেকে বাড়ি আনতে যেতেন। সেখানে অন্যান্য শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের মধ্যে যাঁরা আব্বুর পরিচিত বা ছোটবেলার বন্ধু, তাঁদের সাথে গল্প করার সময় গলার স্বর হয়ত অজান্তেই উঁচু স্কেলে মিলে যেত। তাই বাসায় ফিরে দাদার কাছে বকুনিও খেতেন।

সেই অসুস্থ আব্বু  আমার, ২০১৪ সালের জানুয়ারির ২৫ তারিখ রাতটায়, কনকনে শীতে কুয়াশার জাল পেড়িয়ে  ঘাতক গাড়ির অবস্থান ঠাওর করতে পারেননি। নির্মম সড়ক দুর্ঘটনায় রাস্তাতেই মৃত্যুবরণ করেন তিনি। জন্মানোর সময়ে মাথায় পাওয়া ফরেসেফের আঘাত যেভাবে পরিণত বয়সে এসে তার স্বাভাবিকতা কেড়ে নিয়েছিল, তেমনই ঘাতক গাড়ির চাকাগুলোও নিয়েছিলো তার বেঁচে থাকার স্বপ্ন। আব্বুর শরীরের প্রতিটা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল, সেই দূর্ঘটনায়। সাথের জিনিসপত্র ছাড়া শনাক্ত করার উপায় ছিল না। ‘মন শক্ত মেয়ে’ বলে স্বীকৃত সেই ১৪ বছরের আমিও, ময়নাতদন্তের পর সেলাই করে জোড়া দেয়া আব্বুর সে লাশ দেখে উঠতে পারিনি! সাহস করে এগিয়েছিলাম খাটিয়ার উদ্দেশ্যে পৌঁছাতে পারিনি।

যতটা না আব্বুকে হারিয়েছি, তার চেয়ে বেশি করে হারিয়েছি যেন আমার ‘ভাই’-কে, ‘খেলার সাথী’-কে, আমার প্রিয় ‘বন্ধু’-কে, রাগারাগি, ঝগড়া, খুনসুটি করার একমাত্র সঙ্গীটাকে।

অস্বীকার করব না, বয়সের হিসাবে পরিপক্বতার হিসেবে আমার ছোট্ট মনটাকে এই অস্বাভাবিকতার সত্য বোঝাতে সময় লেগেছে, বেশ সময় লেগেছে। “ওই পাগলটা তোমার বাবা?” এ ধরনের প্রশ্ন, যে প্রশ্নের উত্তর তাঁদের জানা ও কাঙ্ক্ষিত উত্তর পাওয়ার পর তাঁদের কথায় মিশে থাকবে- করুণা, বিদ্রূপ। সেসব প্রশ্নে এলোমেলো হয়ে চুপ করে থাকতাম তখন। এসব মানুষের মুখের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁদের বিদ্রূপকে উল্টো হাসি দিয়ে হারানোর পাঠ শিখতে আমার সময় লেগেছে। এ স্বশিক্ষা অর্জনের পর থেকে আজ অবধি “হ্যাঁ, উনিই আমার আব্বু।” একথা বলতে আমার বিন্দুমাত্র বাধে না।

আব্বু,
তোমার জংলি তোমাকে খুব খুব ভালোবাসে। কারণ সে এটা বোঝে যে তার আব্বু তাকে নিজের সব অস্বাভাবিকতা, সব সীমাবদ্ধতার মধ্যেও ঠিক কতটা ভালোবেসেছে। কতটা মূল্যবান সঙ্গ সে পেয়েছে, তোমার কাছে থেকে। শৈশবের গোল্ডেন মোমেন্টস বলতে আমার মাথায়, মনে, চোখে সবার আগে আসে ড্রয়িংরুমের জানালার পর্দার পেছনে আমি লুকিয়ে আছি আর তোমায় দেখছি। আর আমার অবস্থান জানা সত্ত্বেও খোঁজার অভিনয় করে তুমি বলছ, “জংলিটা কোথায় গেল রে? কোথায়?” তোমার জংলি আর কোনোদিন তোমার সাথে লুকোচুরি খেলবে না, না বাবা?

শিক্ষার্থী, চীনা ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগ,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

 

ইকবাল/এসএফ/ঢাকা।

230 Views

আরও পড়ুন

বুটেক্সে ফুটবল টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন আইপিই

শেরপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হত্যা মামলায় গ্রেফতার ১

বুক রিভিউ:সময়ের ছবি ‘নীরব কোলাহল’

মৌলভীবাজারে সোনার বাংলা আদর্শ ক্লাবের ৬ষ্ঠ মেধা যাচাই প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত

হাওরের জনপদ এখন উচ্চশিক্ষায় আরো এগিয়ে যাবে–ড. মোঃ আবু নঈম শেখ

রাবিতে গ্রীন ভয়েস এর নেতৃত্বে মাহিন-সিরাজুল

ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয় মনিরকে

নাইক্ষ্যংছড়িতে ঝুলন্ত অবস্থায় গৃহবধূর লাশ উদ্ধার !!

আগামী দিনের রাজনীতি হবে তারেক রহমানের নেতৃত্বে নতুন বাংলাদেশ গড়ার রাজনীতি: নাজমুল মোস্তফা আমিন

নাটোরে অস্ত্রসহ আওয়ামীলীগ নেতা ও তার সহযোগী আটক

দুর্লভ নিদর্শনে সমৃদ্ধ এশিয়াটিক সোসাইটি ঐতিহ্য জাদুঘর

রাবিতে ছাত্র উপদেষ্টার আহবানে গাছ থেকে পেরেক অপসারণ