
নুরুল ইসলাম,কক্সবাজার
সত্য কেবল বন্দুকের মুখে হারায় না—হারায় প্রচারের ভাষায়, বিকৃত তথ্য আর বিভ্রান্তির কুয়াশায়।
বিপ্লব একটি সভ্যতার অংশ প্রতি শত বছর ঘটে একটি বিপ্লব। এই বিপ্লব হয় শিল্প বিপ্লব, স্বৈরাচার পতনের বিপ্লব, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের বিপ্লব। এটা সভ্যতার অন্যতম উপাদান। একটি বিপ্লব সমাজে বিদ্যমান রাজনৈতিক, সামাজিক, বা অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দ্রুত এবং মৌলিক পরিবর্তন করার প্রয়াস থেকে হয়ে থাকে।
বিপ্লব সাধারণত সহিংসতা, ব্যাপক পরিবর্তন, এবং বিদ্যমান ব্যবস্থার উৎখাত দ্বারা চিহ্নিত করা হয়।
বিপ্লব সাধারণত রাজনৈতিক নিপীড়ন, অর্থনৈতিক বৈষম্য, সামাজিক অবিচার, বা সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা।
জর্জ অরওয়েলের ‘অ্যানিমেল ফার্ম’ আমাদের দেখায় কীভাবে বিপ্লবের নামে জন্ম নেয় আরেক স্বৈরতন্ত্র। নেপোলিয়ন ও স্কুইলারের মাধ্যমে গড়ে ওঠে এক ছদ্ম-সমতার শাসনযন্ত্র, যেখানে ‘সব প্রাণী সমান, কিন্তু কিছু প্রাণী অন্যদের চেয়ে বেশি সমান’—এই বাক্য হয়ে দাঁড়ায় ক্ষমতার নিষ্ঠুর সারাংশ।
অরওয়েল বিশ্বাস করতেন, বিপ্লব টিকে থাকে নৈতিকতা ও জবাবদিহির ওপর। সেগুলোর অভাবেই বিপ্লব হারায় তার প্রাণ আর জন্ম নেয় নেপোলিয়নের মতো নতুন শাসক—যে ইতিহাসকে নিজের মতো লিখে নেয়। এ জন্যই ‘অ্যানিমেল ফার্ম’ কেবল অতীতের ব্যঙ্গ নয়, বরং ভবিষ্যতের জন্য একটি তীক্ষ্ণ সতর্কবার্তা।
অরওয়েল আমাদের শেখান, প্রশ্নহীন আনুগত্য, প্রচারনির্ভর শাসন আর নেতার পূজা—এসবই বিপ্লবের আদর্শকে গ্রাস করে। এই উপন্যাস ইতিহাসের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আমাদের বলে—যে বিপ্লব প্রশ্নকে ভয় পায়, সে শেষমেশ নিজ সন্তানদেরই গ্রাস করে।
‘অ্যানিমেল ফার্ম’ বাস্তব না হয়েও বাস্তবতার এক নির্মম প্রতিবিম্ব যা প্রতিনিয়ত আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
জর্জ অরওয়েল ১৯৪৫ সালে প্রকাশিত সাহিত্যিক প্রতিবাদের ‘অ্যানিমেল ফার্ম’ বিপ্লব ও বিপ্লব পরবর্তী ঘটনার অনন্য দলিল। এক পশু খামারে বিপ্লবের গল্প দিয়ে তিনি যেভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের স্তালিন যুগের বিকৃতি, বিশ্বাসঘাতকতা ও স্বৈরতন্ত্রের বাস্তবতা তুলে ধরেছেন, তা একদিকে সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ, অন্যদিকে ইতিহাসের বেদনাবাহী পাঠ। যা সাম্রাজ্যবাদের নির্মম রূপ—ক্ষমতার নির্দয় প্রয়োগ, মানুষের অসম্মান আর শোষণের বিভীষিকা তাঁকে গভীরভাবে নাড়া দেয় এবং একজন লেখক হিসেবে তাঁকে ঠেলে দেয় আত্মজিজ্ঞাসার পথে। উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র—নেপোলিয়ন, স্নোবল, বক্সার—তাদের প্রতিটিই আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের বাস্তব রাজনৈতিক চরিত্রের প্রতীক। বিপ্লব যেভাবে স্বপ্ন থেকে বিভীষিকায় রূপ নেয়, সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি কীভাবে ক্ষমতাধরের ভাষায় হারিয়ে যায়—এই অনবদ্য রূপক একমাত্র অরওয়েলই তৈরি করে বুঝিয়ে দিয়েছে তার পশুর খামার বইটির মধ্য দিয়ে।
অ্যানিমেল ফার্ম- ও বিপ্লবের বাস্তব রূপান্তর
একটি পশুর খামার যেখানে পশুরা বিদ্রোহ করে, নিজের স্বাধীনতা বুঝে নিবে, নিজ থেকে শাসক নিয়ে তারা পরিচালিত হবে। মানুষের শাসন ফেলে দিয়ে ঘোষণা করে স্বাধীনতা। শুরু হয় একটি নতুন সময়—স্বপ্নের, সমতার, মুক্তির। যেখানে তাদের স্বপ্ন বুনতে শুরু করে সবাই। কিন্তু সময়ের প্রবাহে সেই স্বপ্ন রুপান্তর হয় দু:স্বপ্নে, পরিণত হয় বিভীষিকায়। বিপ্লবী নেতারা হয়ে ওঠেন নতুন শাসক, যারা পুরনো শাসনের চেয়েও নির্মম, ও ধূর্ত। বেড়ে যায় অসমতা।
জর্জ অরওয়েলের অন্যতম কালজয়ী হৃদয়গ্রাহী বাক্য—‘সব প্রাণী সমান, কিন্তু কিছু প্রাণী আরও সমান’— এটি শুধু যেন একটি ব্যঙ্গ নয়, এটি বর্তমান সভ্যতার জন্য একটি গভীরতর রাজনৈতিক সত্য। যা আজও আমাদের এ বাক্য অনুসরন করে তোলে বিশ্বের বহু প্রান্তে, যেখানে বিপ্লবের, নতুন বন্দোবস্তের নামে চলছে শোষণের পুনরাবৃত্তি।
‘অ্যানিমেল ফার্ম বা পশুর খামার' কেবল একটি রূপক উপন্যাস নয়— এ যেন বিপ্লব ও বিপ্লবের পরবর্তী ঘটনার এক অন্যান্য উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে রয়ে যাবে আমাদের জন্য। এটি ইতিহাসের এক নির্মম প্রতিচ্ছবি। বিপ্লবের আদর্শ কীভাবে একনায়কত্বে রূপ নেয়, কীভাবে জনগণের নামে স্বার্থপর গোষ্ঠী ক্ষমতা কুক্ষিগত করে, অরওয়েল সেটিই তুলে ধরেছেন শূকর আর পশুদের গল্পের মধ্য দিয়ে।
জর্জ অরওয়েলের ‘অ্যানিমেল ফার্ম’ শুধু বিপ্লব বা স্বৈরতন্ত্রের একটি প্রতিচ্ছবি নয়, এটি এক বিস্তৃত চরিত্রমালা—যারা বাস্তব ইতিহাসের শক্তিধর ও দুর্বল, আদর্শবাদী ও ষড়যন্ত্রী, নির্যাতক ও নির্যাতিত চরিত্রদের প্রতীক হয়ে উঠেছে। উপন্যাসের চরিত্রগুলোর সঙ্গে সোভিয়েত রাজনীতির বাস্তব চরিত্রের তুলনাও গভীর তাৎপর্য বহন করে।
ওল্ড মেজর,নেপোলিয়ন,স্নোবল,স্কুইলার,বক্সার,কুকুর দল,মি. জোনস ছিলেন উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র। —
ওল্ড মেজর ছিলেন এক আদর্শবাদী, যিনি পশুদের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখান, বিদ্রোহের প্রেরণা দেন।
পশুর খামার ও চব্বিশ বিপ্লব:
অরওয়েলের পশুর খামারে পশুরা যেমন নিজের অধিকার, স্বাধীনতার জন্য ওল্ড মেজরের স্বপ্নে বিভোর হয়ে ঐক্যবদ্ধ বিদ্রোহ করে মালিক মি. জোন্স কে বিতাড়িত করে। ২০১৮ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত বাংলাদেশ ছাত্র আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় অধিকার আদায়ে ছাত্র আন্দোলনে সকল শোষিত জনগণ তাদের আন্দোলনে সাড়া দিয়ে অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে পতনের আন্দোলন করে। রিক্সা চালক থেকে ছাত্র জনতা সবাই এক প্লাটফর্ম হয়ে আন্দোলন করে পতন করে স্বৈরাচার আওয়ামী সরকারের। সংঘটিত হল একটি অন্য এক বিপ্লব। স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত তুমি কে আমি কে রাজাকার,রাজাকার। এ যেন এক নতুন বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। ছিলনা কোন রাজনৈতিক দলের সম্পৃক্ততা, এ যেন পুরো বাংলাদেশ। ছাত্র জনতা মিলে এক কাতারে এসে রাজনৈতিক দলের সম্পৃক্ততা ছাড়া পতন হয়।ছাত্র জনতার দূর্বার আন্দোলনে পরাজিত হয়ে দেশ ছাড়ে ফার্মের মালিকের মত অসহায় আত্মসমর্পণ করে পালিয়ে যায়। অভিভাবকহীন দেশের ক্ষমতার পট পরিবর্তনের বাংলাদেশ পেল এক জীর্ণশীর্ণ বাংলাদেশ যার প্রতিটি অংগ যেন ব্যাথায় ব্যথিত। অর্থ থেকে শুরু করে সব সেক্টর যেন যুদ্ধ বিদস্ত। শুরু হল নতুন বাংলাদেশের যাত্রা যেখানে থাকবেনা কোন স্বৈরাচার, থাকবেনা কোন অনাচার প্রতিষ্ঠিত হবে স্বাধীনতা, বুঝিয়ে নিবে নিজের অধিকার। পথচলা শুরু হল নতুন বাংলাদেশের নতুন সরকারের। শুরু হল আন্দোলন, প্রতিদিন কোন না কোন আন্দোলন। অস্থির হয়ে পড়েছে রাজনৈতিক দল জনগণের অধিকার নির্বাচন, নির্বাচন। বিড়াল হল বাঘ, বাঘ হল ইদুর। সংকিত বিপ্লবের নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র জনতা। শুরু হল নতুন বাংলাদেশ বিনির্মানে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ রাজনৈতিক দলের অস্থিরতা। নেতৃত্ব নিয়ে শুরু হল হালচাল। নেই কোন দেশের প্রতি মমত্ববোধ, জনগণের প্রতি ভালবাসা। বিক্রি হচ্ছে বিপ্লব, হারিয়ে গেছে বিপ্লবের মূল লক্ষ্য। সৃষ্টি হল বিভেদ। হারিয়ে যাচ্ছে আস্থা জড়িয়েছে দলীয় স্বার্থ। দেশের চেয়ে বড় দলের স্বার্থ এ নীতিতে বিপ্লব বিক্রি হয়ে বিভাজিত হয়ে পড়েছে যা পশুর খামার বিপ্লবের মত প্রাপ্য অধিকার না পেয়ে শ্রেনী বিভাজনের মাধ্যমে খড়কে পড়েছে। সরে যাচ্ছে মৌলিক বিষয় থেকে। বিপ্লবীদের বিভিন্ন অপবাদের তকমা লাগিয়ে শাস্তি ভূগতে হবে এমনকি মৃত্যু দন্ডে দন্ডিত হবে। মুরগীর মত বসন্তে বাচ্ছা ফুটানোর জন্য নিজের ডিম বিক্রি করতে দিবে না।
এভাবে অরোয়েলের পশুর খামারের মত চরিত্র আমাদের বিপ্লবের প্রতিটি দলে ফুটে উঠেছে। বিশৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত ও আইন শৃঙ্খলা কর্মকাণ্ডে অস্থির দেশ। নেই কোন নিরাপত্তা। বৈষম্য, নিজের আত্মতুষ্টি যেন বিপ্লবের পরের ধাপ। সাম্য, অধিকার নামে মাত্র থাকলেও বাস্তবে তা নিছক বিনোদন। বিপ্লব মানে যেন জনগনের দৃষ্টি গোচর করে এক শ্রেনীর ক্ষমতা পরিবর্তন করা। জনগণের জীবন যেন খেলনার সামগ্রী। কখনোই মানোন্নয়নে কাজ না করে নিজের ভাগ্যের পরিবর্তন করাই যেন রাজনৈতিক দলের বিপ্লব।
কোনো এক খামারে পশুপাখিরা তাদের মানব মালিকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। তারা নিজেদের একটি সমতাবাদী সমাজ গড়ার লক্ষ্যে মানব প্রভুদের খামার থেকে তাড়াতে সক্ষম হয়। তেমনি বিপ্লব মানে কোন এক শক্তি রাষ্ট্রের স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ক্ষমতার পট পরিবর্তন করে শাসকের পরিবর্তন হয়।
প্রথমে সবকিছু শান্তিপূর্ণভাবে চললেও, শূকররা যেমন বুদ্ধিমত্তা ও ক্ষমতা দেখিয়ে ধীরে ধীরে নেতৃত্ব গ্রহণ করে। তাদের মধ্যে শক্তিশালী ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী শূকর নেপোলিয়ন ক্ষমতা দখল করে। তেমনি রাজনৈতিক দল কৌশলে তাদের ক্ষমতার আকাঙ্খা ধীরে ধীরে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে।
সাম্য থেকে স্বৈরাচার: অরওয়েল তার গল্পের শুরুতে পশুপাখিদের জন্য কিছু নীতি তৈরি করা হয়, যেমন "সকল প্রাণী সমান", কিন্তু শূকররা ধীরে ধীরে সেই নীতিগুলোকে নিজেদের সুবিধার্থে বদলে দেয় এবং পশুপাখিদের উপর নিজেদের অত্যাচার শুরু করে। তেমনি বিপ্লবের পরবর্তী সরকার জনগণের মৌলিক অধিকার নিয়ে কথা বললেও নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর সুবিধা ব্যাতিত আর কিছুই নেই।
স্তালিন যুগের প্রতিফলন:এই উপন্যাসে শূকররা যেমনি ক্ষমতাধর ও কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠে জোসেফ স্তালিনের শাসনামলে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছিল ঠিক তেমনি এক শ্রেনীর এলিট সমাজ ক্ষমতা ও ক্ষমতার কর্তৃত্ববাদী হয়ে স্তালিনের মত ক্ষমতার স্বাদ নিয়ে প্রয়োগ করে বিপ্লবের যোদ্ধারা ও সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে রাখে।
উপন্যাসের শেষে, শূকরগুলো মানুষের আচরণ একিভুত হয়ে ওঠে, তাদের এবং মানুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য রইলনা।
এটি ক্ষমতা, শোষণ, সাম্য ও বৈষম্যের মতো বিষয়গুলো তুলে ধরে, যা দেখায় কীভাবে বিপ্লবের মূল আদর্শ ক্ষমতার অপব্যবহারের ফলে নষ্ট হয়।
সম্পাদক ও প্রকাশক: রফিকুল ইসলাম
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-১৩১০