জেমস আব্দুর রহিম রানা:
আমাদের দেশে এখনো এমন মানুষ আছে যাদেরকে আমরা অনেকেই জানিনা। কিন্তু আমাদের সংস্কৃতিতে তাদের অবদান অপরিসীম যারা সমাজের ভিন্নধর্মী মানুষ।
আজ আমরা জানবো তেমনই একজন মানুষ ও তার কর্ম সম্পর্কে, যে নিভৃতে করে যাচ্ছে মানুষের জন্য বিভিন্ন ধরনের বিনোদনে চেতনা ও শিক্ষামূলক কাজ। আর তিনি হলেন লিটন অধিকারী রিন্টু। যার জন্ম বাংলার ভেনিস বরিশালে। বরিশালে রয়েছেন অনেক গুণীজন তাদের মধ্যে আজ আমরা জানবো লিটন অধিকারী রিন্টুকে।
আসলে কে এই লিটন অধিকারী রিন্টু ? কী তার পরিচয়, কী তার কর্ম, কেন তিনি ভিন্ন ধর্মী মানুষ, কী তার সৃজনশক্তি ?
তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বরিশালে শুরু এবং ঢাকা সিটি কলেজে সম্পন্ন।
তার কর্মজীবনের আরম্ভ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, ছবি আঁকার মধ্যে জীবনের সব স্বপ্ন জড়ানো থাকলেও যেহেতু ঘুম ভাঙতো প্রতিদিন বাবার কন্ঠে গাওয়া ‘ভোর হইল ভানু প্রকাশিলো’ অথবা ‘তুমি নিশি ভোরে এসো প্রভু মোর প্রাণে’ গান দিয়ে। তাই সংগীতের শিকড় ছিল অন্তরে।
১৯৭৪ সালে বরিশালে ব্যাপিস্ট চার্চে খ্রিষ্টীয় সংগীত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে যে প্রশংসা ও সাহসের জন্ম হয়েছিল সেখান থেকেই সংগীতের যাত্রা ও মঞ্চে ওঠার পালা শুরু এবং বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীর সাথে একজন বাদ্যযন্ত্রী হিসেবে যুক্ত হওয়া। কিন্তু পরবর্তীতে বড় ভাই স্মিথ আর. অধিকারীর উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় সংগীতের সাথে পেশাগত জীবনে জড়িয়ে যাওয়া।
তার সংগীতের পেশাগত জীবন শুরু হয় গিটার বাজানোর মধ্য দিয়ে। প্রথম কাজ ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ বিমানের জন্য তৈরি একটি জিঙ্গেলে গিটার বাজানো এবং ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে। এরপর ১৯৮০ সালে এভরি হোম কন্টাক্ট থেকে ঢাকা দিলু রোডে প্রথম ক্লাসিকাল গীটার মিউজিক স্কুল শুরু করেন। সেই মিউজিক স্কুল থেকেই গিটারের প্রশিক্ষক হওয়ার যে জীবন, সেই জীবন শুরু এবং ১৯৮২ সালে পরম শ্রদ্ধেয় সুরসম্রাট সমর দাসের অনুপ্রেরণায় ও এনসিসিবি এর সহযোগিতায় জাতীয় পরিষদের বিল্ডিংয়ে আরো একটি ক্লাসিকাল গিটার শেখার স্কুল গড়ে তোলেন। এই দু’টি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতি বছর অনেক মিউজিশিয়ান তৈরি হয়েছে। যাদের মধ্যে অনেকেই এখন সংগীত জগতে কাজ করছে এবং অনেকেই এখন সুরকার যার পেছনে রয়েছে লিটন অধিকারী রিন্টুর অপূরণীয় শ্রম ও ভালোবাসা।
এরপর তার গীতিকার জীবন সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, প্রথম দিকে অর্থাৎ ১৯৭৭ সালের পর থেকে বিভিন্ন খ্রিষ্টীয় সংগীত রচনা করতাম। ১৯৮১ সাল থেকে প্রয়াত শেখ ইশতিয়াক এর উৎসাহে আধুনিক গান লেখা শুরু করি। পরবর্তীতে কুমার বিশ্বজিৎ, হানিফ সংকেত, আলী আকবর রুপু, ফরিদ আহমেদ ও মকসুদ জামিল মিন্টুর উৎসাহে গান রচনাটা বেড়ে যায়। তার গান সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, রেডিও টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রের লেখা গানে কণ্ঠ দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রায় অধিকাংশ প্রথম শ্রেণীর গায়ক গায়িকা এমনকি ভারতের শিল্পীরাও কেউ কেউ।
কিছু আলোচিত গান সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক – গান ও কণ্ঠ শিল্পী:
১। যারে ঘর দিলা সংসার দিলা/
২। প্রেম তো চরের জমি নয়/
৩। কিছুই নাকি দেইনি তোমায়/
৪। জন্মিলে মরিতে হবে এবং
৫। আমার ভালো থাকার কথা শুনে – কুমার বিশ্বজিৎ
৬। একদিন ঘুম ভেঙে দেখি – শেখ ইশতিয়াক
৭। আকাশ হারায় নীল – রবি চৌধুরী
৮। মরণ যদি হয় তোমার প্রেমের আঘাতে – শুভ্রদেব
৯। কখনো জীবন যেন সুরভীত ফুল – রুনা লায়লা
১০। সব চাওয়া কাছে পাওয়া – সাবিনা ইয়াসমিন
১১। মনের মিলন মধুর মিলন – মমতাজ
১২। বাঘের পিছে বাঘ লাগানো – ফকির আলমগীর ও ফেরদৌস ওয়াহিদ
১৩। সাপ এখন বনের চেয়ে বেশি থাকে মনে – ডলি সায়ন্তনী
১৪। পড়েছি লাল শাড়ি – বেবি নাজনিন
১৫। ও মানুষ তুমি মানুষ বাড়াতে পারো – রেনেসাঁ ও সোলস
১৬। যদি কখনো জানতে পারো কোন এক আরোগ্য নিকেতনে পড়ে আছি আমি – তপন চৌধুরী
১৭। শহর এখন বিদেশমুখী – আজম খান ও মমতাজ
১৮। দম ফুরাইলে দেহ ফেলে – খালিদ হাসান মিলু
১৯। ওরে মানুষ আর করবি কত ভুল – এন্ড্রু কিশোর
২০। কি কোরে আমায় তুমি ভুলবে। শিল্পীঃ শাহনেওয়াজ রহমতুল্লাহ
এছাড়াও অনেক গান…
বিগত ও বর্তমানে বিভিন্ন কর্মকান্ড নিয়ে তিনি বলেন, ভারতের মাদ্রাজে (বর্তমানে চেন্নইয়ে) টিভি প্রোডাকশন এর উপর ট্রেনিং নেয়া।
দিল্লিতে রেডিও প্রোগ্রামিং এর উপর প্রশিক্ষণ নেয়া।
বেলজিয়ামের ব্রাসেলস এডুকেশনাল টিভি প্রোগ্রামিং প্রশিক্ষণ নেয়া।
এজি অডিও ভিজুয়াল ডিপার্টমেন্টের ব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত থেকে ছোটদের শিক্ষামূলক টেলিভিশন অনুষ্ঠান তৈরি করা, যা ২০০১ সাল থেকে আজ অবধি মোট তিনটি চ্যানেলে প্রচারিত হচ্ছে সাপ্তাহিকভাবে এবং বিশেষ বিশেষ দিনে।
ক্লাসিকাল গিটার এর একজন প্রশিক্ষক।
বিভিন্ন মিউজিক্যাল রিয়েলিটি শো’র একজন অডিশনস জাজ হিসেবে কাজ করা।
তার এই বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের জন্য, সৃজন শক্তির জন্য তিনি পেয়েছেন –
‘ইউনিসেফ মীনা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড’ মোট তিনবার নমিনেশন আর দুইবার জয়ী হওয়া। এছাড়া ‘এনসিসিবি কর্তৃক প্রদত্ত দিশারী স্বর্ণপদক’।
জয় হোক সংস্কৃতির, জয় হোক ‘সঙ্গীতাঙ্গন’এর।
সম্পাদক ও প্রকাশক: রফিকুল ইসলাম
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-১৩১০