অধ্যাপক শামসুল হুদা লিটনঃ
বাংলাদেশ তথা ভারতীয় উপমহাদেশের একজন শীর্ষস্থানীয় আলেমেদ্বীন হলেন হজরত মাওলানা আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী। তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী দেশবরেণ্য একজন ইসলামিক ব্যক্তিত্ব, একজন ইসলামিক চিন্তাবিদ ও স্কলার। তিনি ছিলেন জাতি গঠনের কারিগর, একজন আদর্শ ওস্তাদ, কুরআনের হাফেজ, ইসলামিক সংগঠক এবং আলেম সমাজের অভিভাবক। মুসলিম সমাজের গর্ব ও অহংকারের প্রতীক আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী আজ আর আমাদের মাঝে নেই। আজ ১৯ আগস্ট, ২০২১ বৃহস্পতিবার চলে গেছেন না ফেরার দেশে। তিনি চলে গেলেও আমাদের সামনে রয়েছে তাঁর বর্নাঢ্য কর্মময় জীবন ও আদর্শ। তাঁর কর্মময় জীবন আমাদের প্রেরণা, আগামী প্রজন্মের প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে ইনশাআল্লাহ।
জুনায়েদ বাবুনগরীর সংক্ষিপ্ত জীবনীঃ
জন্মঃ
জুনায়েদ বাবুনগরী ১৯৫৩ সালের ৮ অক্টোবর চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি থানার বাবুনগর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আবুল হাসান ও মাতা ফাতেমা খাতুন। হারুন বাবুনগরী তার নানা। মায়ের দিক দিয়ে তার বংশধারা হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. এর সাথে মিলিত হয়।
শিক্ষাজীবন:
৫ বছর বয়সে তিনি আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া আজিজুল উলুম বাবুনগরে ভর্তি হন। এখানে তিনি মক্তব, হেফজ ও প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। কুরআনের হেফজ শেষ করার পর আজহারুল ইসলাম ধর্মপুরীর কাছে তিনি পুরো কুরআন মুখস্থ শুনিয়েছিলেন। এরপর তিনি ভর্তি হন দারুল উলুম হাটহাজারী মাদরাসায়। ১৯৭৬ সালে হাটহাজারী মাদরাসা থেকে দাওরায়ে হাদীস (মাস্টার্স) পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন।
হাটহাজারী মাদরাসায় তার উল্লেখযোগ্য শিক্ষকগণের মধ্যে রয়েছেন: আব্দুল কাইয়ুম, আহমদুল হক (মুফতি), আবুল হাসান, আব্দুল আজিজ, শাহ আহমদ শফীসহ প্রমুখ খ্যাতিমান ব্যক্তিবর্গ।
উচ্চশিক্ষাঃ
তিনি ১৯৭৬ সালে উচ্চ শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে পাকিস্তানে গমন করেন ।পাকিস্তানের করাচি শহরে অবস্থিত জামিয়া উলুমুল ইসলামিয়ায় তাখাচ্ছুছাত ফিল উলুমুল হাদিস তথা উচ্চতর হাদিস গবেষণা বিভাগে ভর্তি হন। ২ বছর হাদিস নিয়ে গবেষণা সম্পন্ন করে তিনি আরবি ভাষায় ‘সীরাতুল ইমামিদ দারিমী ওয়াত তারিখ বি শায়খিহী’ (ইমাম দারিমী ও তার শিক্ষকগণের জীবন বৃত্তান্ত) শীর্ষক অভিসন্দর্ভ জমা দেন। এই অভিসন্দর্ভ জমা দেওয়ার পর তিনি জামিয়া উলুমুল ইসলামিয়া থেকে হাদিসের সর্বোচ্চ সনদ লাভ করেন।
জামিয়া উলুমুল ইসলামিয়ায় তার উল্লেখযোগ্য শিক্ষকগণের মধ্যে রয়েছেন: মুহাম্মদ ইউসুফ বিন্নুরী, ইদ্রিস মিরাঠী, আব্দুল্লাহ ইউসুফ নোমানীসহ প্রমুখ। পাশাপাশি তিনি ওয়ালী হাসান টুঙ্কির কাছে সুনান আত-তিরমিজী ও মুহাম্মদ ইউসুফ বিন্নুরীর কাছে সহীহ বুখারী দ্বিতীয় বারের মত অধ্যয়ন করেন।
কর্মজীবন:
১৯৭৮ সালের শেষের দিকে তিনি দেশে ফিরে বাবুনগর মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে তার কর্মজীবনের সূচনা হয়। বাংলাদেশের মাদরাসা সমূহের সর্বপ্রথম বাবুনগর মাদরাসায় তিনি উচ্চতর হাদিস গবেষণা বিভাগ চালু করেন। ২০০৩ সালে তিনি দারুল উলুম হাটহাজারী মাদরাসায় যোগ দেন। পরবর্তীতে তিনি হাটহাজারী মাদরাসার সহকারী পরিচালক নিযুক্ত হন। ২০২০ সালের ১৭ জুন মাদরাসা কমিটি সহকারী পরিচালকের দায়িত্ব থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়। তার স্থলে মাদরাসার জ্যেষ্ঠ শিক্ষক শেখ আহমদকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি হাটহাজারী মাদরাসার শাইখুল হাদীস এবং শিক্ষাসচিবের দায়িত্ব পালন করেন।
ইসলামিক সংগঠনঃ
তিনি হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের প্রথমে মহাসচিব ও পরে আমীরের দায়িত্ব পালন করেন। চট্টগ্রাম নূরানী তালীমুল কুরআন বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং মাসিক মুঈনুল ইসলামের প্রধান সম্পাদক, মাসিক দাওয়াতুল হকের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
তাসাউফ:
শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করে আধ্যাত্মিক দীক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে ১৯৭৮ সালে তিনি আব্দুল কাদের রায়পুরীর উত্তরসূরী আব্দুল আজিজ রায়পুরীর নিকট বায়’আত গ্রহণ করেন। রমযান মাসে তিনি রায়পুরীর খানকায় অবস্থান করে কিছুকাল তার সান্নিধ্যে ছিলেন।
বাংলাদেশে তিনি যাদের কাছে খেলাফত পেয়েছেন: হুসাইন আহমদ মাদানির দুই শিষ্য- আব্দুস সাত্তার, ফতেয়াবাদ, শাহ আহমদ শফী, রাঙ্গুনিয়া। আবুল হাসান আলী নদভীর শিষ্য সুলতান যওক নদভী
পরিবার:
তিনি ৫ মেয়ে ও ১ ছেলের জনক। ছেলের নাম মুহাম্মদ সালমান।
রচনা:
আরবি, উর্দু ও বাংলায় তার রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ত্রিশটি। দারুল উলুম নাদওয়াতুল উলামার আরবি পত্রিকা আল বাসুল ইসলামি, দারুল উলুম দেওবন্দের মাসিক পত্রিকা আদ দায়ী, দারুল উলুম হাটহাজারীর মাসিক আল মুঈনসহ বিভিন্ন সাময়িকীতে অসংখ্য প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন তিনি।
বইসমূহ :
সীরাতুল ইমামিদ দারিমী ওয়াত তারিখ বি শায়খিহী (১৯৭৮)
বিশ্ববরেণ্যে মুহাদ্দিসগণের দৃষ্টিতে ইমাম আবু হানিফা রহ.
তালিমুল ইসলাম (আরবি)
বাড়াবাড়ি ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত,
ইসলামে দাড়ির বিধান,
তাওহীদ ও শিরক: প্রকার ও প্রকৃতি,
মুকাদ্দিমাতুল ইলম : তাফসীর, হাদীস, ফিকাহ, ফতোয়া
দারুল উলুম হাটহাজারীর কতিপয় উজ্জ্বল নক্ষত্র
আকাবিরে দেওবন্দের সিলসিলায়ে সনদ,
জুনায়েদ বাবুনগরীর রচনাসমগ্র,
ইলমে হাদীসের ভূমিকা,
খুতবার ভাষা,
মহাগ্রন্থ আল কুরআন ও বিশ্বনবী মুহাম্মদ (স.),
ইসলাম আওর সায়েন্স,
নাস্তিক মুরতাদের শরয়ী বিধান,
জাল হাদীস,
সূরা ফাতিহা,
মুকাদ্দামায়ে তানযীমুল আশতাত,
খতমে নবুয়ত ও কাদিয়ানী সম্প্রদায়,
সিয়াম সাধনা ইতেকাফ ও ঈদ মোবারক,
মিলাদ কিয়াম ও সুন্নাত বিদআত।
বক্তৃতা সংকলনঃ
হক বাতিলের লড়াই,
সুশিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড,
ইলমে দ্বীনের গুরুত্ব ও ফজীলত,
ইসলাম বনাম সমকালীন মতবাদ,
প্রচলিত জাল হাদীস: একটি তাত্ত্বিক আলোচনা,
ইসলামের দৃষ্টিতে গান-বাজনা।
সম্পাদক ও প্রকাশক: রফিকুল ইসলাম
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-১৩১০