জেমস আব্দুর রহিম রানা:
যুগ যুগ ধরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য ঐতিহ্য ধারণ করে আছে সৈয়দপুর শহরের ইসলামবাগ এলাকা। এখানে সীমানা প্রাচীরের একপাশে অবস্থান করছে চিনি মসজিদ, কারবালার স্মৃতিবিজড়িত ঈমামবারা ও অন্যপাশে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের গ্রেভইয়ার্ড বা কবরস্থান। প্রায় দু’শ’ বছর ধরে ধর্মীয় সম্প্রীতির এই ঐতিহ্য ধরে রেখেছে সৈয়দপুর শহরের উত্তরাংশে অবস্থিত ইসলামবাগ মহল্লার এই স্থানটি। এ নিয়ে আজ পর্যন্ত কোনো সংঘাত বা প্রশ্ন ওঠেনি কখনও। বরং বিপরীতমুখী ধর্মাবলম্বীদের সহ-অবস্থানের কারণে এক ধরনের গর্ব রয়েছে এলাকাবাসীর মধ্যে।
এ প্রসঙ্গে ফাদার মি. নিকোলাস গোমেজ বলেন, ব্রিটিশ ভারতে সৈয়দপুরে উপমহাদেশের অন্যতম বৃহত্তম রেলওয়ে কারখানা স্থাপিত হওয়ায় কর্মকর্তা-কর্মচারী হিসেবে বহু শ্বেতাঙ্গ ইউরোপিয়ানের আগমন ঘটে। তারা বাস করত সৈয়দপুর রেলওয়ে স্টেশনের পশ্চিমাংশ রেলওয়ে কলোনি ও শহরের দক্ষিণাংশে, যা সাব-অর্ডিনেট কলোনি (সাহেবপাড়া) ও রেলওয়ে অফিসার্স কলোনি হিসেবে এখনও পরিচিত। মৃত্যুর পর ওইসব ইউরোপিয়ান কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সমাহিত করার জন্য শহরের ইসলামবাগ এলাকায় রেলওয়ে লাইনের পাশে প্রায় দেড় একর জায়গাজুড়ে স্থাপন করা হয় খিস্টান কবরস্থান।
তিনি আরও বলেন, সে সময় রোমান ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট এ দুই ধারার খ্রিস্টানদের বসবাস ছিল সৈয়দপুর শহরে। তাদের উপাসনার জন্য পৃথক পৃথক গির্জাও প্রতিষ্ঠা করা হয় এখানে। এর মধ্যে রোমান ক্যাথলিকদের গির্জাটি রেলওয়ে স্টেশনের কাছে ও প্রোটেস্ট্যান্টদের গির্জাটির অবস্থান রেলওয়ে হাসপাতালের সামনে। প্রতি রোববার এখানকার খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা উপাসনালয়ে মিলিত হন। সকাল-সন্ধ্যা এখনও ঘণ্টা বাজে এই গির্জা দুটিতে।
সরেজমিন দেখা গেছে, কয়েকটি কবরের এপিটাফে (স্মৃতিফলক) উল্লেখ রয়েছে সতেরো শতকের বিভিন্ন তারিখ। অনেকগুলো কবর মূল্যবান মার্বেল পাথর ও কংক্রিটে ঢালাই করা। তাতে খোদাই করা ঠিকানাসহ মৃত ব্যক্তির নাম লেখা রয়েছে। ফাদার নিকোলাস অভিযোগ করেন, অধিকাংশ কবরের মূল্যবান পাথর ইতোমধ্যে চুরি হয়ে গেছে। ঐতিহ্যবাহী এই কবরস্থানটির দীর্ঘদিন খাদেমের দায়িত্ব পালন করেছেন একজন মুসলমান। ইসমাইল হোসেন নামে ওই খাদেম এক সময় রেলওয়ে কারখানায় চাকরি করতেন। অবসরের পর তিনি খাদেমের দায়িত্ব নেন। তার দায়িত্ব পালনে ধর্মীয় ভেদরেখার কোনো প্রশ্ন ওঠেনি।
সূত্র জানায়, ঠিক একই সময়ে কবরস্থানের দেওয়াল ঘেঁষে গড়ে তোলা হয় সৈয়দপুর তথা এ অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী চিনি মসজিদ। মসজিদের পাশেই হাসান-হোসেনের ইমামবারা। প্রতিবছর ১ থেকে ১০ মহররম পর্যন্ত হাজারো মুসলিম নর-নারী ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালন করেন এই স্থানে।
চিনি মসজিদ কমিটির সভাপতি সাবেক কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র হিটলার চৌধুরী ভলু বলেন, ছেলেবেলা থেকে ইসলামবাগ মসজিদ ও খ্রিস্টান কবরস্থানকে ঘিরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি দেখে আসছি। প্রবীণদের কাছে শুনেছি, একই স্থানে ভিন্নধর্মাবলম্বীদের দুটি স্থাপনা থাকলেও কখনও কোনো সংঘাত বা সম্প্রীতির অভাব ঘটেনি। সহ-অবস্থানে থেকে যার যার ধর্ম বিশ্বাস মতে অনুষ্ঠানাদি পালন করে আসছে। তার মতে, ইসলামবাগের এই সম্প্রীতি শুধু সৈয়দপুরে নয়, সারা বাংলার উদাহরণ হয়ে আছে।