রফিকুল ইসলাম জসিম:
ঈদুল আজহা মুসলিমদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসব, যেটি কোরবানি বা ত্যাগের আদর্শকে কেন্দ্র করে উদযাপিত হয়। পাঙাল একটি ঐতিহাসিক ও সংস্কৃতিগত ভাবে স্বতন্ত্র মুসলিম সম্প্রদায়, ঈদুল আজহাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা, ধর্মীয় আবেগ ও সামাজিক ঐক্যের সঙ্গে পালন করে থাকেন। নিচে এই উদযাপনের নানা দিক তুলে ধরা হলো:
ঈদের কয়েকদিন আগ থেকেই পাঙাল পাড়াগুলোতে ঈদের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে। পরিবারের সবাই ঘরদোর পরিষ্কার করে, নতুন পোশাক তৈরি করা হয়, বিশেষ করে সাদা পাঞ্জাবি ও ফেইজটুপি পুরুষদের জন্য, এবং মেয়েদের জন্য রঙিন সালওয়ার-কামিজ বা হিজাব। যারা কোরবানি দিতে ইচ্ছুক ও সামর্থ্য রাখেন, তারা পশু কেনার প্রস্তুতি নেন। গরু, ছাগল স্থানীয় হাট থেকে ক্রয় করা হয়, এবং বাচ্চারা খুব আগ্রহ নিয়ে পশুগুলোর যত্ন নেয়।
ঈদুল আজহার দিন সকালে পাঙাল মুসলিমরা পাঙ্খাবি (ঈদের জামাতের স্থান, অনেক সময় খোলা মাঠ) বা স্থানীয় জামে মসজিদে জমায়েত হন। নামাজের পূর্বে “তাকবিরে তাশরিক” ধ্বনিত হয়:
আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়ালিল্লাহিল হামদ। নামাজ শেষে খতিব সাহেব কোরবানির তাৎপর্য ও ইব্রাহিম (আঃ)-এর ত্যাগের ইতিহাস ব্যাখ্যা করেন। ঈদের খুতবার শেষে সবাই কোলাকুলি করেন ও একে অপরকে শুভেচ্ছা জানান।
নামাজের পরপরই কোরবানির পশু জবাই করা হয়। পাঙাল সমাজে কোরবানির জন্য ইসলামি বিধি কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয়। পশু জবাইয়ের পর গোশত তিন ভাগে ভাগ করা হয়—এক ভাগ গরীবদের, এক ভাগ আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের, এবং এক ভাগ নিজের পরিবারের জন্য।
বিশেষ করে মণিপুরী পাঙাল অধ্যুষিত এলাকায় কোরবানির মাংস বিতরণ এক ধরনের সামাজিক সংহতির উপলক্ষ। গরীব-মিসকিনদের মধ্যে বিতরণে কোনো কৃপণতা থাকে না। অনেক পরিবার দরিদ্র প্রতিবেশীদের ঘরে মাংস পৌঁছে দেন।
ঈদের দিন পাঙাল পরিবারের রান্নাঘরে চলে বিশেষ আয়োজন। গরুর মাংস দিয়ে রান্না করা হয। এছাড়াও ঈদের দুই-তিন দিন আগে থেকেই পাঙাল বাড়ির ঘরে ঘরে পিঠা তৈরি শুরু হয়। চালের গুঁড়া দিয়ে তৈরি গোলাকার এই পিঠা দুই ধরনের হয়ে থাকে। এর একটি বানানো হয় চালের গুঁড়ার সঙ্গে নানা পদের মসলা মিশিয়ে। এর নাম ‘মরোই তল’।
এটি মাংস দিয়ে, নানা রকম ভর্তা দিয়ে খাওয়া হয়ে থাকে। অপরটি বানানো হয় চালের গুঁড়ার সঙ্গে চিনি বা গুড় মিশিয়ে, এর নাম ‘চিনি তল’। পিঠার সঙ্গে সেমাই, নুডলস, শরবত ইত্যাদিরও আয়োজন থাকে। ঈদের এই সময় একে অপরের বাড়ি যান। তখন প্রতিবেশীকে এই পিঠা দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। এ ছাড়া মেহমান এলে তাঁদেরও এই পিঠা দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়ে থাকে। ঈদ উপলক্ষে বাবার বাড়ি থেকে মেয়ের বাড়ি এই পিঠা পাঠানো হয়ে থাকে। মেয়েরাও তাঁদের বাড়ি থেকে বাবা-মায়ের জন্যও এই পিঠা তৈরি করে পাঠান।
ঈদুল আজহার সময় পাঙালদের মধ্যে আত্মীয়তা পুনরুজ্জীবন ঘটে। অনেক দূরের আত্মীয়রাও দেখা করতে আসেন। ঈদের ছুটিকে কেন্দ্র করে পাঙালদের মধ্যে একধরনের পারিবারিক পুনর্মিলনের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে ফুটবল খেলা আয়োজন হয়৷
পাঙালদের ঈদ উদযাপনের মধ্যে মণিপুরী মুসলিম সংস্কৃতির ছাপ স্পষ্ট। এখানকার কোরবানি, নামাজের পরের কোলাকুলি, এবং পাড়া-প্রতিবেশীর সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার রীতি এই উৎসবকে অন্য অঞ্চলের মুসলিমদের থেকে কিছুটা আলাদা করে তোলে। অনেক এলাকায় পাঙাল মুসলিমদের নিজস্ব দোয়া ও কাওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীদের মিলে ঈদের বিশেষ বয়ান ও ইসলাহি আলোচনা হয়।
পাঙাল মুসলিমদের জন্য ঈদুল আজহা শুধুমাত্র কোরবানি ও ধর্মীয় আচার পালনের একটি দিন নয়, এটি সামাজিক সংহতি, আত্মত্যাগ, ও পারস্পরিক সৌহার্দ্যের প্রতীক। এই উৎসবের মধ্য দিয়ে ধর্মীয় অনুশাসনের পাশাপাশি পাঙালদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও সামাজিক সম্পর্কের রূপও প্রতিফলিত হয়।