অধ্যাপক শামসুল হুদা লিটনঃ
একজন হক্কানি আলেম মুসলিম সমাজের পথপ্রদর্শক। একজন আলেম নক্ষত্রের সমতুল্য। ইসলামের জ্ঞানের আলোতে ওরা উজ্জ্বল করে পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্র । এর মধ্যে অনেকেই থাকেন স্বভাবগতভাবে প্রচারবিমুখ। ডামাডোলের এই যুগে এসব মহান জ্ঞানী -গুণীরা যেন নিজেদের আরো বেশি গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু এসব প্রতিভাবান প্রচারবিমুখ ব্যক্তিরাই হলো সত্যিকার আলোকিত মানুষ। ওরাই নীরবে জ্ঞানের আলোতে আলোকিত করে সমাজকে। ওর নিরলস ভাবে ইসলামী শিক্ষা বিস্তার করে যাচ্ছেন। ওরা সৎ ও আদর্শের মূর্ত প্রতীক। এমন এক প্রচারবিমুখ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী মহান ইসলামিক ব্যক্তিত্ব হলেন হযরত মাওলানা নুরুল হক সাহেব। এ ধরনের ওস্তাদ ও ইসলামিক স্কলারকে নিয়ে কিছু লেখা আমার পরম সৌভাগ্যও বটে।
মাওলানা নুরুল হক সাহেব এর বর্নাঢ্য জীবনঃ
জন্মঃ ভাওয়াল অঞ্চলের বিখ্যাত আলেমেদ্বীন মাওলানা নুরুল হক ১৯৪০ সালে গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার জামালপুর ইউনিয়নের বালুয়াভিটা ভাঙ্গিবাড়ী গ্রামে সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা মোঃ হানিফ ছিলেন শিক্ষানুরাগী সমাজ সচেতন ব্যক্তি ও মমতাময়ী মা ফলেকা বেগম ছিলেন একজন মহীয়সী নারী।
শিক্ষা জীবনঃ তিনি শৈশবে পূর্ব পুরুষের প্রতিষ্ঠিত স্থানীয় মক্তবে ভর্তি হন। মক্তবের পড়ালেখার মাধ্যমেই ইসলামিক শিক্ষা জীবনের শুভ সূচনা হয়। পরে জামালপুর বালুয়া ভিটা ইসলামিয়া হাফিজিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। এই মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন মাওলানা মোহাম্মদ আলী চাদপুরী। ভালো ছাত্র হিসেবে অল্প দিনেই তিনি মহান এই ওস্তাদজীর প্রিয় ছাত্র হয়ে উঠেন। তিনি কয়েক বছর যুগশ্রেষ্ঠ আলেম মাওলানা ইব্রাহিম সাহেবের নিজ গ্রামে প্রতিষ্ঠিত ডেমড়া আফজালুল উলুম মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন। এখানেও তিন ওস্তাদ সিরাজুল ইসলাম রায়পুরীর স্নেহধন্য হন। পরে তিনি ওস্তাদদের পরামর্শে ১৯৫৭ সালে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী লালবাগ জামিয়া কুরআনিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখানে তিনি ৮ বছর লেখাপড়া করেন। ১৯৬৪ সালে হাদীস শাস্ত্রে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেন। লালবাগ জামিয়া কুরআনিয়া মাদ্রাসায় পড়ার সময় তিনি সরাসরি ওস্তাদ হিসেবে পেয়েছিলেন দেশের শীর্ষ স্থানীয় আলেমেদ্বীন, বুজুর্গ ও পীরে কামেল হযরত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (রাঃ), মাওলানা মোহাম্মদ উল্লাহ হাফেজ্জ্বী হুজুর (রাঃ),সায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক (রাঃ) ও শায়খুল হাদীস মাওলানা হেদায়েতুল্লাহ সাহেবদের মতো জমানার শ্রেষ্ঠ আলেমদের। পাশাপাশি তিনি আলীয়া মাদ্রাসায়ও লেখা পড়া করেন। তিনি ১৯৬৮ সালে কাপাসিয়ার বেগুনহাটি মাদ্রাসা থেকে প্রথম বিভাগে আলিম ও ১৯৭০ সালে খিরাটি ফাজিল মাদ্রাসা থেকে প্রথম বিভাগে ফাজিল পাস করেন। এবং ১৯৭৬ সালে কালীগঞ্জ উপজেলার দুর্বাটি মদিনাতুল উলুম কামিল মাদ্রাসা থেকে কৃতিত্বের সাথে আবারো হাদীস শাস্ত্রে সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভ করেন।
অধ্যাপনা জীবনঃ একজন অতি মেধাবী ছাত্র হিসেবে শিক্ষকতাকেই তিনি নিজ পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তিনি ১৯৬৫ সালে মনোহরদী উপজেলার শেখেরগাও ফাজিল মাদ্রাসায় আরবী প্রভাষক হিসেবে ৭ মাস কাজ করেন। ১৯৬৭- ১৯৬৮ সালে প্রায় দুই বছর নিজ এলাকার জামালপুর বালুয়াভিটা ইসলামিয়া মাদ্রাসায় মোহতামিমের (প্রধান শিক্ষক) দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৮ সালের শেষ দিকে কাপাসিয়া উপজেলার ঐতিহ্যবাহী বেগুনহাটি ফাজিল মাদ্রাসায় আরবি সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি একই মাদ্রাসায় দীর্ঘ দুই যুগের বেশি সময় উপাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৪ সালে উপাধ্যক্ষ হিসেবেই বর্নাঢ্য কর্মময়জীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
হজ্জব্রত পালনঃ তিনি প্রথম হজ্জব্রত পালন করেন ১৯৬৮ সালে। এর পর ২০০৪, ২০১৩ ও ২০১৮ সালে মোট ৪ বার পবিত্র হজব্রত পালন করেন। বর্তমানে তাঁর বয়স ৮১ বছর। এখনো তিনি প্রতিদিন সকালে প্রায় দুই ঘন্টা সময় স্থানীয় একটি কওমী মাদ্রাসায় হাদিস শরীফে থেকে দরছ প্রদান করে যাচ্ছেন। পারিবারিক জীবনে তাঁর ২ ছেলে, ২ মেয়ে রয়েছে।
মাওলানা নুরুল হক সাহেব একজন অতি উচুমানের মেধাবী শিক্ষক ও হক্কানি আলেম । তাঁর অনেক ছাত্র দেশ বিদেশে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছেন। এই মহান শিক্ষকের সংস্পর্শে এসে আলোর পথ পাওয়া অনেক ছাত্র আজ আপন মহিমায় সমুজ্জ্বল। মহান আল্লাহ যেন তাঁকে দীর্ঘায়ু দান করেন।
লেখকঃ
শামসুল হুদা লিটন
অধ্যাপক, সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গবেষক