উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণ করেছেন লোক প্রশাসন বিভাগ থেকে। কিছুদিন বেকার থেকে চাকুরি নিয়েছেন বায়িং হাউজে। কিন্তু সৃজনশীল যুবক নিজেকে বেশিদিন আটকে রাখতে পারেননি কর্পোরেট অফিসের ধরাবাঁধা নিয়মে। নেই বড় কোনো আমলা হওয়ার স্বপ্ন। তবে, ‘স্বপ্ন’ একটা আছে। আর তা হলো- বিশ্বমানের একজন ক্যালিগ্রাফার হওয়া।
বলছি, তরুণ ক্যালিগ্রাফি শিল্পী সাজু তাওহীদের কথা। মনের কোণে লালিত স্বপ্ন এখন পূরণ হওয়ার পথে। শিশুকালের সেই শখের আঁকি-বুকিই আজ তাওহীদের পেশা হতে চলেছে। তাইতো বাকি জীবনের স্বপ্ন বুনছেন ক্যালিগ্রাফির হরফের ভাঁজে ভাঁজে। দারুণ ক্যালিগ্রাফি আঁকেন সাজু তাওহীদ। ইতোমধ্যেই মিলেছে কাজের স্বীকৃতিও। অংশ নিয়েছেন তিনটি আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে। ভ্রমণ করেছেন বিভিন্ন দেশ। পেয়েছেন সম্মাননা। তাঁর আঁকা ক্যালিগ্রাফি গিয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। সম্প্রতি তিনি সৌদি আরব সফরে গিয়ে কা’বা ঘরের গিলাফের প্রধান ক্যালিগ্রাফার মুখতার আহমাদ শিকদারের সাথে সাক্ষাত করেন।
তাওহীদের জন্ম ও বেড়ে উঠা চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদায়। লেখাপড়ার শুরুটা গ্রামের মাদ্রাসা থেকে। ২০০৯ সালে দামুড়হুদা ডিএস দাখিল মাদ্রাসা থেকে দাখিল (এসএসসি সমমান) এবং ২০১১ সালে খুলনার দারুল কুরআন সিদ্দিকীয়া কামিল মাদ্রাসা থেকে আলিম (এইচএসসি সমমান) পাস করেন। এরপরে ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগে। সেখান থেকে সম্পন্ন করেছেন বিএসএস (অনার্স) ও এমএসএস ডিগ্রি। একাডেমিক পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে তাওহীদ এখন স্বপ্ন দেখেন পৃথিবীর সেরা ক্যালিগ্রাফার হওয়ার। এই লক্ষ্য নিয়ে প্রচুর সময়ও দিচ্ছেন কাজে।
তাওহীদ বলেন, ‘ছোটবেলার ভালোলাগা থেকে করা আঁকি-বুকিই যে আজ পেশায় পরিণত হবে তা নিজেও ভাবিনি। মাস্টার্স শেষ করে একটা কর্পোরেট হাইজে চাকরি নিয়েছিলাম। কিন্তু সেখানে মন টানলো না। ভাবছিলাম কিভাবে সরকারি চাকুরির পড়া শুরু করবো; কিভাবে লক্ষ লক্ষ প্রতিযোগীর মধ্যে নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তুলবো; তখন জানতে পারি ক্যালিগ্রাফির কথা। যেহেতু আঁকাআকির প্রতি ভালোলাগা একটা ছিলোই; তাই খোঁজখবর নিয়ে ভর্তি হয়ে গেলাম। কোর্স শেষে প্রায় দুইশত শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রথম হলাম।’
কোর্স সম্পন্ন হলে নিজের প্রতিভা আর প্রশিক্ষণের মিশেলে আঁকা কিছু ক্যালিগ্রাফি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করেন তাওহীদ। সেখানে বন্ধুবান্ধব ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের অনুপ্রেরণা পান। এভাবে নতুন নতুন ক্যালিগ্রাফি আঁকেন এবং ফেসবুকে দেন। এরই মধ্যে দু’একটি করে বিক্রি শুরু হয়। পরে নিয়মিত আঁকার পাশাপাশি প্রচারণা চালান অনলাইনে। এভাবে নিজেদের নামের ক্যালিগ্রাফি করিয়ে নিতে অর্ডার করা শুরু করেন অনেকে। চালু হয়ে যায় ব্যবসায়িকভাবে। এখন তিনি পুরোদস্তুর ব্যস্ত কাজ নিয়ে। চাকরির পড়াশোনা বাদ রেখে পুরোটা সময় দিচ্ছেন ক্যালিগ্রাফি শেখা এবং আঁকায়।
সাজু জানান, এখন ক্যালিগ্রাফি এঁকে বিক্রি করে যা টাকা পান; তাতে তাঁর ভালোই চলে। এই পেশায় ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল দেখছেন বলেও জানান তিনি।
তাওহীদ নিজের কাজগুলো নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘কোট নোট আর্ট’ নামের প্রতিষ্ঠান। তিনি প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী। সাজু ইতোমধ্যেই তার সৃজনশীল ক্যালিগ্রাফি নিয়ে একাধিক আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন। চলতি বছরের জুলাইতে আন্তর্জাতিক কুরআন ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনী এবং ফেব্রুয়ারিতে ইন্দো-ইরান আন্তর্জাতিক কলা ও ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনীতে তাঁর শিল্পকর্ম স্থান পায়। এর আগে গত বছরের অক্টোবরে নিউইয়র্ক আন্তর্জাতিক সীরাত প্রতিযোগিতায়ও স্থান পায় তাওহীদের ক্যালিগ্রাফি।
ক্যালিগ্রাফি প্রশিক্ষক মাহবুব মুর্শিদ বলেন, ‘কাজের প্রতি সাজুর বেশ আগ্রহ। জানবার-শেখবার আকাঙ্ক্ষাও আছে। ক্যালিগ্রাফি নিয়ে তার পরিকল্পনার কথা শুনেছি। আমার বিশ্বাস, সে একদিন অনেক বড় ক্যালিগ্রাফার হবে।’
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. মুন্সী মুর্তজা আলী বলেন, সাজু আমার বিভাগের ছাত্র। ক্যালিগ্রাফি নিয়ে সে চমৎকার কাজ করছে। আমিও নিজেও তার ক্যালিগ্রাফি নিয়েছি। ওর জন্য আমরা গর্বিত। আশাকরি, সে দেশে-বিদেশে সুনাম বয়ে আনবে।
ক্যালিগ্রাফি যাত্রা নিয়ে সাজু বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে আর্টের প্রতি প্রবল নেশা ছিলো; তবে ক্যাম্পাসে এসে কিছুটা বাস্তবে রুপ নেয়। বিভাগের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আল্পনা করার সময় রং তুলির সাথে ভালোভাবে পরিচয়। করোনার পর বায়িং হাউজে চাকরির পাশাপাশি কিছু করার জন্যে সব সময় মন টানতো। যা একান্ত নিজের পরিচয় দেওয়ার মত। সেই ভাবনা থেকেই ক্যালিগ্রাফির সন্ধান।’
ক্যালিগ্রাফির চাহিদা নিয়ে তিনি বলেন, পরিবারের প্রিয় মানুষের নাম দিয়ে করা ক্যালিগ্রাফি সবচেয়ে জনপ্রিয়তার শিখরে। এছাড়াও কোরআনের আয়াত দিয়ে অনেক নান্দনিক ক্যালিগ্রাফি করা হয়।’
দেশের প্রায় প্রতিটি জেলাতেই ক্যালিগ্রাফি পৌঁছে গিয়েছে তাওহীদের। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, আয়ারল্যান্ড, তুরস্ক, দুবাই, সৌদি আরব প্রভৃতি দেশেও গিয়েছে।
সাজু বলেন, কর্পোরেট লাইফ ছেড়ে আরবি ক্যালিগ্রাফির মত স্বর্গীয় শিল্পকে বেছে নিয়েছি জীবিকার মাধ্যম হিসাবে। এটি হালাল পেশা। বর্তমানে নিজে ক্যালিগ্রাফি করছি। তবে, ভবিষ্যতে নতুনদের মাঝে ক্যালিগ্রাফি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ইচ্ছাও আছে।
সম্পাদক ও প্রকাশক: রফিকুল ইসলাম
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-১৩১০