এরফান হোছাইন, কক্সবাজার :
সুবেদার মেজর আব্দুল মাবুদ চৌধুরী (অব.)-এর জন্ম ১৯৫৬ সালের ১৫ মে। মাত্র ১৫ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন তিনি। দশম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালীন বাবার নির্দেশে তরুণদের দলে যোগ দেন। প্রশিক্ষণ নিতে কক্সবাজার থেকে বেনাপোল সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের আগরতলায় যান। সেখানে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শেষে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন সীমান্ত অভিযানে অংশ নেন। এভাবে প্রায় ৫০ দিন প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধের অভিজ্ঞতা অর্জনের পর থার্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দেন তিনি।
যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আব্দুল মাবুদ জানান, তরুণ বয়সে যুদ্ধে যাওয়ার আগ্রহ দেখে বাবা-মাও সম্মতি দেন। প্রাথমিক প্রশিক্ষণে অস্ত্র ও গোলাবারুদ বহনসহ নানা কৌশল শেখানো হতো। দক্ষ সেনারা কীভাবে অস্ত্র চালায়, তাও দেখানো হতো। দুই সপ্তাহের বেশি প্রশিক্ষণের পর অস্ত্র ও গোলাবারুদ হাতে পেয়ে বিভিন্ন মিশনে পাঠানো হতো। যুদ্ধের ভয়াবহতা সম্পর্কে আগে ধারণা না থাকলেও, অস্ত্র হাতে পেয়ে তা আনন্দদায়ক মনে হত। তবে, খাবার সংকটের কারণে প্রায়ই ক্ষুধার্ত থাকতে হতো।
সেসময় যুদ্ধের পরিকল্পনা করত সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য বাহিনী। তবে, পরিকল্পনাগুলো স্বল্পমেয়াদী ছিল। কারণ যুদ্ধের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে কেউই নিশ্চিত ছিল না। মিশনে গিয়ে অনেকেই আহত হয়েছেন, এমনকি আব্দুল মাবুদ নিজেও পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। ঝড়-বৃষ্টি ও শীত উপেক্ষা করে বিভিন্ন অভিযানে অংশ নিয়েছেন। মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে দেশমাতৃকার জন্য যুদ্ধ করেছেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার খবরটি যুদ্ধক্ষেত্রে থাকা অনেকেই জানতেন না। ওয়্যারলেসের মাধ্যমে এ খবর পৌঁছানোর পর তারা জানতে পারেন, দেশ শত্রুমুক্ত হয়েছে।
তরুণ বয়সে যুদ্ধে যাওয়াটা খেলনা হাতে খেলার মতো মনে হলেও, সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার পর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যুদ্ধের ভয়াবহতা উপলব্ধি করেন আব্দুল মাবুদ।
“স্থানীয় রাজাকাররা পাঞ্জাবি সেনাদের চেয়েও ভয়ংকর ছিল,” মাবুদ ব্যাখ্যা করেন। “আমাদের আঞ্চলিক ভাষা চিনে ফেললে সেনাবাহিনীকে খবর দিত।” এজন্য ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডাররা কিশোর যোদ্ধাদের নিজ এলাকা থেকে দূরে মোতায়েন করতেন। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, স্থানীয়রা যাতে মুক্তিযোদ্ধাদের চিনতে না পারে, সেজন্যই এমনটা করা হতো।
যুদ্ধক্ষেত্রের মজার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আব্দুল মাবুদ বলেন, গেরিলা কৌশলে মুখে-গায়ে কালি মেখে বা কাদা মেখে যখন পাকিস্তানি হানাদারদের সামনে যেতেন, তখন তারা ভয় পেত। অনেক সময় কয়েক কিলোমিটার দূর থেকে কালোমুখো মুক্তিযোদ্ধাদের দেখে তারা পালিয়ে যেত।
“শত্রুর চোখে ধুলো দিতে, আমরা রূপ বদলাতাম,” স্মৃতি হাতড়ে বলছিলেন সুবেদার মেজর আব্দুল মাবুদ চৌধুরী (অব.)। ১৯৭১ সালের রণক্ষেত্রে, তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে এটাই ছিল গেরিলা যুদ্ধের অন্যতম কৌশল। পাকিস্তানি হানাদারদের বিভ্রান্ত করতে, মুখে-গায়ে কাদা-কালি মেখে, মাথায় পাতার ঝোপ পরে ছদ্মবেশ নিতেন তারা।
“খবর পেতাম, অমুক এলাকায় হানাদাররা ঘাঁটি গেড়েছে। অমনি আমরা দল বেঁধে রওনা হতাম,” আব্দুল মাবুদ বলেন, “কয়েক কিলোমিটার দূর থেকে আমাদের কালিমাখা মুখ দেখে, ওরা ভয়ে পালাত।”
শুরুতে ডামি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করলেও, দ্রুতই আসল অস্ত্র চালনায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন তারা। “কালিমাখা মুখে যখন হানাদাররা পালাত, আমরা হাসতাম,” স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বলেন আব্দুল মাবুদ। “ওরা ভাবতেও পারেনি, বাঙালিরা এভাবে রুখে দাঁড়াবে।”
হানাদারদের চোখে বাঙালি যোদ্ধারা ছিল মূর্তিমান আতঙ্ক। “ওরা ভাবত, বাঙালিরা যুদ্ধ করতে পারবে না,” বলেন আব্দুল মাবুদ, “কিন্তু যখন আমরা অস্ত্র হাতে ওদের বিরুদ্ধে দাঁড়ালাম, ওরা বুঝল, বাঙালিরা কতটা ভয়ংকর যোদ্ধা হতে পারে।”
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি জানান, যুদ্ধের ভয়াবহতার পাশাপাশি অনেক মজার ঘটনাও ঘটেছে। “যুদ্ধের মাঠে, হাসিরও মুহূর্ত ছিল,” বলেন তিনি।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং ২০২৪ সালের জুলাইয়ের বিপ্লবকে এক করে দেখা যায় না। কারণ, দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপট। ৭১-এর যুদ্ধে দেশের একটি অংশ স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিল, কিন্তু ৩৬ জুলাইয়ের বিপ্লবে ছাত্র-জনতাসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নিয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে না থেকেও অনেকে ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের নেপথ্যের কারিগর, যাদের অবদান অনস্বীকার্য। ১৯৭১ সালে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ নানা ভূমিকায় অংশ নিয়েছিল এই যুদ্ধে। এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রে খাদ্যের অভাবে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে, যা স্থানীয় জনসাধারণের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ও সমর্থন ছাড়া এড়ানো সম্ভব ছিল না। সুবেদার মেজর আব্দুল মাবুদের মতো কিশোর মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ ও সাহসিকতা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায়।
উল্লেখ্য যে, সুবেদার মেজর আবদুল মাবুদ (অব.) শুধু একজন মুক্তিযোদ্ধা নন, তিনি একজন নিবেদিত সমাজসেবকও। ১৯৫৬ সালের ১৫ মে কক্সবাজার সদর উপজেলাধীন খুরুশ্কুলের ফকিরপাড়ায় জন্ম নেওয়া এই মানুষটি ১৯৭২ সালে দেশ সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৯৬ সালে অবসর নেওয়ার পর শুরু হয় তার সমাজসেবার নতুন অধ্যায়। ২০০৩ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত খুরুশ্কুল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি এলাকার রাস্তাঘাট, পুল-কালভার্ট, স্কুল-মাদ্রাসা, মসজিদ-মন্দিরসহ বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন ও সংস্কারে অসামান্য অবদান রাখেন। তার অক্লান্ত পরিশ্রমে খুরুশ্কুল উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশে নির্মিত হয় আধুনিক ইউনিয়ন পরিষদ ভবন।
খুরুশ্কুলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে কাজে লাগিয়ে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সহযোগিতায় তিনি এই ইউনিয়নকে একটি আধুনিক মডেল ইউনিয়নে রূপান্তর করেন। তার এই অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৫-২০০৬ সালে তিনি জেলার শ্রেষ্ঠ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তার এই কৃতিত্বপূর্ণ অবদান এলাকাবাসী চিরদিন শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে।