নজরুল ইসলাম,কুতুবদিয়া ঃ
এখনো সমুদ্রে চলাচলকারী দেশী-বিদেশী জাহাজের নাবিকদের পথ দেখিয়ে যাচ্ছে কুতুবদিয়া বাতিঘর। ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক তৎকালীন ৪৪২৮ টাকা ব্যয়ে নির্মিত ১২০ ফুট উচ্চতার বাতিঘরটি জাহাজের নাবিকদের দিকনিদের্শনার কাজে নিয়োজিত হয়ে এখনো আলো ছড়াচ্ছে সমূদ্রের দীর্ঘ দুইশ কিলোমিটার পর্যন্ত। যদিও ঐতিহাসিক বাতিঘরটি সমুদ্রের করালগ্রাসে সাগর গর্ভে বিলিন হয়েছে অনেক আগেই।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৮২২ সালে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড ও জলোচ্ছ্বাসের ফলে এদেশের সমূদ্র উপকূল বিধ্বস্ত হয়ে চট্টগ্রাম বন্দর এলাকায় সমুদ্রবক্ষে পলি জমে অনেকগুলো চরের সৃষ্টি হলে চট্টগ্রাম বন্দরে দেশি-বিদেশি জাহাজ চলাচলে সমস্যা দেখা দেয়। নির্বিঘেœ জাহাজ চলাচলের স্বার্থে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার বাতিঘর স্থাপনের জন্য জরিপকাজ পরিচালনার মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে প্রায় ২৫ মাইল দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর পরিবেষ্টিত কুতুবদিয়ায় একটি সুউচ্চ বাতিঘর স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়।
তারই প্রেক্ষিতে, ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে ক্যাপ্টেন হেয়ার-এর পরিচালনায এবং ইঞ্জিনিয়ার জে,এইচ, টুগুড-এর নকশায় বন্দর নগরী চট্টগ্রামের কর্ণফুলি নদীর মোহনায় বাতিঘরটি নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়। ১৮৪৬ খ্রিষ্টাব্দে এই বাতিঘরটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়। এটির নির্মাণ ব্যয় ছিল ৪৪২৮ টাকা। বাতিঘরটি তৈরি হয়েছিল পাস্তরের ভিত্তির উপর ১২০ ফুট উচ্চতার একটি সুউচ্চ টাওয়ারের উপরিভাগে। মাটি থেকে টাওয়ারের অংশে ছিল ১৫ ফুট উচ্চতার ১৫ টি কক্ষ। টাওয়ারটির মাটির নিচেও একটি কক্ষ ছিল। সেই সময়ে রাতের আঁধারে প্রায় ২২০ কিলোমিটার দূর থেকে বাতিঘরের আলো দেখতে পেতো জাহাজের নাবিকরা।
পাকিস্তান আমলে এই টাওয়ারটি নতুন কর নির্মাণ করা হয় লৌহ কাঠামোর উপর। প্রাচীন আলোক-উৎপাদন প্রক্রিয়া বাতিল করে আধুনিক পদ্ধতিতে চালু করা হয় আলোক উৎপাদন প্রক্রিয়া। পরে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পাকিস্তান আমলেই এই বাতিঘরটি অকেজো হয়ে ক্রমাগত সমুদ্রের ভাঙ্গনের মুখে বাতিঘরটি একসময় বিলীন হয়ে যায়।
প্রাচীনকাল থেকে চট্টগ্রাম ছিল একটি সমুদ্রবন্দর এবং বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পর থেকে চট্টগ্রাম বন্দর পরিণত হয় একটি ব্যস্তম আন্তর্জাতিক বন্দরে। আর তখন থেকেই কুতুবদিয়া নামক দ্বীপটি প্রসৃদ্ধি লাভ করে বাতিঘরের জন্য। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়া দ্বীপের দক্ষিণ ধুরুং ইউনিয়নে ১৯৭২ সালে ইস্পাতের কৌণিক দন্ড ব্যবহার করে নির্মাণ করা নতুন বাতিঘরটি। এরই মধ্যদিয়ে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়েছে এটি। আর নিরবিচ্ছিন্নভাবে দীর্ঘপথ পর্যন্ত আলো ছড়িয়ে দিক নিদের্শনা দিচ্ছে সমূদ্রে চলাচলকারী দেশী-বিদেশী জাহাজের নাবিকদের এবং নাবিকরা সর্তক হতে পারছে সুমূদ্রের অগভীর অঞ্চল এবং সমুদ্র সৈকতের যে সকল এলাকায় প্রচুর প্রবালগঠন জাহাজের ক্ষতি সাধন করতে পারে, সে সম্পর্কেও।
এখনো বাতিঘরটি একনজর দেখতে প্রতিবছর ছুটে আসেন ভ্রমণকারীরা। ঐতিহাসিক এই বাতিঘর ও দ্বীপকে কেন্দ্র করে এদেশের পর্যটন শিল্পকে সমৃদ্ধ করতে বর্তমান সরকার যে মেগাপ্রকল্প হাতে নিয়েছে তা বাস্তবায়ন হলে বঙ্গোপসাগরের বুক চিরে জেগে উঠা কুতুব আউলিয়ার এই দ্বীপ পরিণত হবে সম্ভাবনাময় এক স্বর্গরাজ্যে। যে সকল প্রকৃতি প্রেমীরা চট্টগ্রাম হয়ে বিশে^র দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার ঘুরতে যান তারা সহজেই ফেরার পথেই ঘুরে আসতে পারেন বাতিঘরটিসহ বৈচিত্রময় এই মায়া দ্বীপটি।
সড়কপথে পেকুয়ার মগনামা ঘাটে গিয়ে নৌ-পথে বোটে তিন কিলোমিটারেরও বেশি প্রশস্ত কুতুবদিয়া চ্যানেল পাড়ি দিয়ে পৌঁছানো যায় এখানে। সাধারণ বোটে ২০-৩০ মিনিট, স্পিড বোটে ৫-৭ মিনিট সময় লাগে পারাপারে। দ্বীপে থাকার জন্যও রয়েছে ভালো আবাসনের ব্যবস্থা এবং খাবারের তালিকায় পাবেন তরতাজা সামুদ্রিক মাছ।
সম্পাদক ও প্রকাশক: রফিকুল ইসলাম
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-১৩১০