নিউজ ডেস্ক :
তুরস্ক ও সিরিয়ায় হয়ে যাওয়া সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে হওয়া ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে দায়ী করা হচ্ছে ভবন নির্মাণ ও নির্মাণ পরবর্তী তদারকি কাজে তুরস্কের সরকারের দুর্নীতির বিষয়টিকে।
তুরস্কের নগর পরিকল্পনাবিদ ও ভূমিকম্পবিষয়ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে বিল্ডিং কোড না মেনে বহু ভবন নির্মাণ করায় এই পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি হয়েছে।
১৯৯২ সালে তুরস্কে বড় ধরনের একটি ভূমিকম্প হয়। ওই ভূমিকম্পের পর তুরস্কের সরকার ভূমিকম্প মোকাবেলায় তহবিল গঠনসহ বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছিল।
কিন্তু সে সময় যারা নিয়ম না মেনে ভবন তৈরি করেছিল, তাদের শাস্তির আওতায় না এনে অল্প কিছু জরিমানা করে ছেড়ে দেয়া হয়। যার ফলে প্রায় ৬০ লাখ ভবন অপরিবর্তিত অবস্থায় থেকে যায়। সরকারের এই দুর্নীতি আর অনিয়মের ফলেই সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে ব্যাপক আকারে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশেও বাণিজ্যিক বা আবাসিক ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে অনিয়ম বা দুর্নীতির অভিযোগ নতুন কোনো বিষয় নয়। বাংলাদেশের অধিকাংশ অঞ্চলেই ভবন তৈরির ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অনিয়মের অভিযোগ উঠে থাকে।
বাংলাদেশে ভবন তৈরির ক্ষেত্রে জাতীয় বিল্ডিং কোড অনুসরণ না করা, ভবনের নকশা অনুমোদন ও বাস্তবায়ন বা অঞ্চল পরিকল্পনা তৈরি ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ না নেয়ার মতো নানা অনিয়মের চিত্র উঠে আসে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ২০২০ সালের এক গবেষণায়।
বাংলাদেশের ভূতত্ববিদ ও নগর পরিকল্পনাবিদরা মনে করছেন, বাংলাদেশে বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে এখানকার ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি তুরস্কের মতো বা তার চেয়ে বেশি মাত্রায় হতে পারে। আর এই ক্ষয়ক্ষতির পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ হবে অপরিকল্পিতভাবে তৈরি করা ভবন।
কতটা ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে?
বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে এমন এক জায়গায় অবস্থিত যেখানে যেকোনো সময় আট বা তারচেয়ে বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে বলে বলেন ভূতত্ত্ববিদ ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি সৈয়দ হুমায়ুন আখতার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ অবজারভেটরির সাবেক এই পরিচালক ও তার সহ-গবেষকরা প্রায় দুই যুগ ধরে যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে এই অঞ্চলে ভূমিকম্পের সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা করছেন। তাদের গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশের ডাউকি ফল্টে ৮.২ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তবে এই ভূমিকম্প ঠিক কোন সময়ে হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
‘সিলেট থেকে কক্সবাজারের পাহাড়ি অঞ্চলের নিচে যে পরিমাণ শক্তি সঞ্চিত হয়েছে, সেখানে যেকোনো সময় আট মাত্রার বেশি ভূমিকম্প হতে পারে। এই ভূমিকম্প আজও হতে পারে, আবার ১০০ বছর পরেও হতে পারে। যত সময় যাবে, সঞ্চিত শক্তি বাড়তে থাকবে।’
তাদের গবেষণা প্রতিবেদন ২০১৬ সালে বিজ্ঞান বিষয়ক জার্নাল ‘নেচার’-এ প্রকাশিত হয়। ওই গবেষণায় উঠে আসে যে বাংলাদেশে বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে।
এই গবেষকের অনুমান, বাংলাদেশে ভূমিকম্প হলে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা বেশি হবে অপরিকল্পিতভাবে তৈরি ভবন, ভূমিকম্প প্রতিরোধী ভবন তৈরিতে উদাসীনতা, ভূমিকম্প নিয়ে সচেতনতা ও প্রস্তুতির অভাবের কারণে।
হুমায়ুন আখতার বলেন, ‘সিলেট থেকে কক্সবাজারের পাহাড়ি অঞ্চল পর্যন্ত বাংলাদেশের নিচে যে ফল্টলাইন আছে, সেই এলাকায় আট মাত্রার বেশি ভূমিকম্প হলে ক্ষয়ক্ষতি তুরস্কের চেয়ে ভয়াবহ মাত্রায় হবে।’
তার গবেষণার হিসাব অনুযায়ী, ভূমিকম্পে ঢাকা মেট্রোপলিটানের এক শতাংশ ভবনও যদি ধ্বংস হয় তাহলে ছয় হাজার ভবন বিধ্বস্ত হবে। যার ফলে অন্তত তিন লাখ মানুষ সরাসরি হতাহত হবেন। আর অপরিকল্পিতভাবে তৈরি শহরে ভূমিকম্প পরবর্তী উদ্ধার ও সেবার কাজ পরিচালনা বাধাগ্রস্ত হওয়ায় আরো বহু মানুষের জীবনের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।
২০০৯ সালে সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি (সিডিএমপি) ও জাইকার যৌথ জরিপে বলা হয়, ঢাকায় সাত বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হলে, শহরের ৭২ হাজার ভবন ভেঙ্গে পড়বে এবং ১ লাখ ৩৫ হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তৈরি হবে সাত কোটি টন কনক্রিটের স্তূপ।
‘শুধু ঢাকা মেট্রোপলিটানে হবে অন্তত তিন লাখ মানুষ এছাড়া নারায়ণগঞ্জ, সাভার, গাজীপুরের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোতে আরো লাখ খানেক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন।
‘আর পূর্বপ্রস্তুতি না থাকলে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাতে ভূমিকম্পের পরে জরুরি উদ্ধারকাজ চালানো কঠিন হয়ে পড়বে। আগে থেকে যদি পরিকল্পনা না থাকে তাহলে ওই সময় জরুরি চিকিৎসা, বিদ্যুৎ, পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার মতো কাজগুলো সামাল দেয়া সম্ভব হবে না এবং মানবিক বিপর্যয় তৈ হতে পারে,’ আশঙ্কা প্রকাশ করেন হুমায়ুন আখতার।
কীভাবে প্রস্তুতি নেয়া সম্ভব?
ভূমিকম্প থামানোর কোনো উপায় না থাকলেও এই দুর্ঘটনার আগে পূর্বপ্রস্তুতি নেয়া সম্ভব হলে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি সামাল দেয়া সহজ হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
ভূমিকম্প মোকাবেলায় তেমন কোনো প্রস্তুতি না থাকার অভিযোগ উঠলেও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী মো: এনামুর রহমান গত সপ্তাহে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছিলেন, উদ্ধার কাজের জন্য সিটি করপোরেশনগুলোকে আলাদা আলাদা অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। এসব অঞ্চলে ৩৬ হাজার প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রাখা হয়েছে। তাদের দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া হয়েছে। দায়িত্ব রয়েছে সামরিক বাহিনীগুলোরও।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক মেহেদি আহমেদ আনসারীর মতে, বাংলাদেশের বড় ও ঘনবসতিপূর্ণ শহরের ঝূঁকিপূর্ণ ভবনগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোকে ভূমিকম্প প্রতিরোধী করা ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি কমানোর উদ্যোগের প্রথম ধাপ।
‘ঢাকা শহরে হাতেগোনা ৫-৭ শতাংশ ভবন হয়তো ভূমিকম্প সহনশীলভাবে তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু বাকি সব ভবন এখনই যেহেতু ভূমিকম্প সহনশীল করা বাস্তবসম্মত না, শুরুতে আমাদের ঝূঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করে সেগুলোকে ভূমিকম্প সহনশীল করার কাজ করতে হবে,’ বলেন তিনি।
এই ভবন চিহ্নিত করা ও সেগুলোকে ভূমিকম্প-সহনশীল করার কাজের দায়িত্ব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে দিলে দ্রুত ও কার্যকরভাবে ভবনগুলোকে ত্রুটিমুক্ত করা সম্ভব হব বলে মনে করেন তিনি।
আনসারীর মতে, ভবনগুলো ভূমিকম্প-সহনশীল হলে হতাহতের সংখ্যা যা ধারণা করা হচ্ছে তার চেয়ে অনেক কম হবে।
আর ভূমিকম্প পরবর্তী উদ্ধারকাজ দ্রুত ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে মহড়া ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সব এলাকার স্থানীয় বাসিন্দাদের আগে থেকে প্রস্তুত রাখার বিকল্প নেই বলে মনে করের বিশেষজ্ঞরা।
ভূতত্ত্ববিদ হুমায়ুন আখতার বলেন, ‘সব এলাকায় – সেটা ওয়ার্ড বা থানা ভিত্তিতে হতে পারে – নিয়মিত ভিত্তিতে স্বেচ্ছাসেবীদের দলকে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে ও তাদের নিয়ে মহড়ার আয়োজন করতে হবে যে ভূমিকম্প হলে কী করতে হবে। সাধারণ মানুষকেও এই প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করতে হবে।’
হুমায়ুন আখতারের মতে, নিয়মিত মহড়া হলে দুর্যোগের পর মানুষের মধ্যে একটা ধারণা থাকে যে কী করতে হবে। ফলে দুর্যোগ পরবর্তী ক্ষয়ক্ষতির হার সামাল দেয়া সহজ হয়।
এছাড়াও ভূমিকম্প হলে স্মার্টফোনের মাধ্যমে জরুরি খবর পাঠানোর ব্যবস্থা করা, ভূমিকম্প বিষয়ক গেমের মাধ্যমে তরুণদের মধ্যে সতর্কতা তৈরি করাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ বাস্তবায়নের মাধ্যমে মানুষের মাঝে ভূমিকম্প নিয়ে সচেতনতা তৈরি করার মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব বলে মনে করেন ভূতত্ত্ববিদ ও নগর পরিকল্পনাবিদরা।
সূত্র : বিবিসি
সম্পাদক ও প্রকাশক: রফিকুল ইসলাম
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-১৩১০