মুহা. ইকবাল আজাদ, ক্রীড়া সম্পাদক।
ডাগআউটে বসে থাকা রুবেলের তীক্ষ্ণ নজর মাঠের দিকে। নতুন রেকর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে মুশফিকুর রহিম। হয়তো বুকে একটা আক্ষেপের কম্পনও হচ্ছিলো দ্বাদশ খেলোয়াড় রুবেল হোসেনের। দিনের শুরুতে আশরাফুল কাছাকাছি গিয়েও রেকর্ডের মাইলফলক ছুঁতে পারেননি। নতুন অধিনায়ক কি কাজটা সম্পন্ন করতে পারবেন? নাকি কাটা পড়বেন নার্ভাস নাইনটিনে? বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করা শব্দকে সঙ্গী করে সেদিন হয়তো রুবেলও অপেক্ষার প্রহর গুনছিলেন। মুশফিক সেবারে হতাশ করেননি। ঠিকই কাজটা করেছিলেন। কাভারের উপরে বলটা ঠেলে দিয়েই স্বাভাবিক সিঙ্গেল রানে প্রথমবারের মতো দ্বিশতকের ঘর স্পর্শ করেন। মুশফিকের পাশাপাশি রুবেলের অস্পষ্ট মুখের স্পষ্ট হাসি বলে দিচ্ছিলো কতটা খুশি হয়েছিলো বাংলাদেশ দল।
বছর ঘুরে ঠিক ৮ বছর পরে একই দিনে দেশের হয়ে প্রথম দ্বিশতক স্পর্শ করেন আফগানিস্তানের মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান হাসমতুল্লাহ শাহিদি। অধিনায়ক আফগান যখন দ্রুত গতিতে রান তুলছিলেন, তখনও মন্থর গতিতে এগিয়ে যাচ্ছিলেন হাসমত। দ্বিশতকের দিকে এগিয়ে যাওয়া আফগান যখন কাটা পড়েন ১৬৪ রানে, তখন শাহিদির রান ১৪০। অনেকটা যেন ২০১৩ সালের ১১ই মার্চের মুশফিক-আশরাফুল জুটির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আশরাফুল থেকে রানে পিছিয়ে থাকা মুশি সেদিন দেশের হয়ে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি অর্জন করেছিলেন। সারাদিন রানে পিছিয়ে থাকা হাসমতুল্লাহ শাহিদিও দিন শেষে তা-ই যেন করে দেখালেন।
স্বল্পভাষীতায় মিলে মুক্তি, ধৈর্যে মিলে ফসল। ধৈর্যের পরীক্ষায় সেদিন পাশ করেছিলেন বাংলার মিস্টার ডিপেন্ডেবল। মুশফিকের দিনে প্রথম বারের মতো একই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন আফগানিস্তানের ভরসার প্রতীক। নট আউট ২০০ তে শেষ করা হাসমতের ইনিংসের মতো মুশফিকেরও প্রথম ডাবল সেঞ্চুরির ইতি ঘটেছিলো ২০০ রানেই। বাউন্ডারির দিক থেকেও দুজনের মিলটা কাছাকাছি। দ্বিশতকের মাঝে মুশফিকের ছিলো ২২টি বাউন্ডারির সাথে ১টি ওভার বাউন্ডারি। অন্যদিকে হাসমতুল্লাহ শাহিদি ঠিক একটি বাউন্ডারি কমে ২১টি বাউন্ডারির সাথে ১টি ওভার বাউন্ডারি আদায় করেছেন। মজার ব্যাপার, দুজনের রান আদায় করার জোনটাও এক, অফসাইডে। বলের কন্ট্রোলও প্রায় সমপরিমাণ।
বলা হয়ে থাকে, ভালো খেলোয়াড় তো তারাই যারা চাপের মাঝে ভালো খেলে থাকেন। নিজের পারফরম্যান্সে চাপকে গ্যালারিতে হাঁকান কিংবা প্রতিপক্ষের জালে গোল বানান। শ্রীলঙ্কার পাহাড়সম রানের চাপে সেদিন নব্য কাপ্তান মুশফিক নিজের মুন্সিয়ানায় প্রতিপক্ষকে প্রতিবাদ করাটা দেখিয়ে দিয়েছেন। বোলারদের চোখে চোখ রেখে ভয়কে জয় করেছেন। রানের পাহাড়ের তলা থেকে দলকে টেনে চূড়ায় তুলেছেন। দিনশেষে 'হোয়াট এ প্লেয়ার' তকমা ঠাঁই নিয়েছে মুশফিকের সাথে। হাসমতুল্লাহ শাহিদিও চাপের মাঝে নিজের জাত চিনিয়েছেন। ২০১৯ সালে মন্থর গতিতে খেলার অভিযোগে দল থেকে বাদ পড়া হাসমত পুনরায় বড্ড সংগ্রাম করে দলে ফিরেছেন। টিকে থাকার লড়াইয়ে চাপকে বানিয়েছেন বেঁচে থাকার ঢাল। ঢালে ভর করেই প্রথমবারের মতো করেছেন দ্বিশতকের কাব্য রচনা। দেশের হয়ে পূর্বে যা কেউ করেনি, তা করে বুঝিয়েছেন পরিশ্রমের সাধনা। লাল বলের রেকর্ড বইতে মুশফিকের মতো একই দিনে মাতৃভূমির নামে প্রথম সারিতে নিজের নাম লেখান হাসমতুল্লাহ শাহিদি। দিনশেষে 'সুপারব ব্যাটসম্যান' এর তকমা নিয়ে মাঠ ছেড়েছেন।
ক্রিকেট অঙ্গনে সাদৃশ্যতার গল্প ভুঁড়ি ভুঁড়ি। রেকর্ড বইয়ে একই দিনে একই রেকর্ডের গল্পও আছে একাধিক। তবুও দেশের হয়ে প্রথম যে গল্প লিখে, তার নাম-গুণগান থেকে যায় অনন্তকাল। বাংলাদেশের হয়ে টেস্টে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ১৯০ রানে যখন আশরাফুল আউট হয়েছিলেন, কতজন বা ভেবেছিলেন এই গলে একটু পরে কাব্য রচনা করতে চলেছেন মুশফিকুর রহিম। আফগানিস্তানের হয়ে টেস্টে প্রথমবারের মতো দেড়শো পেরুনো আজগর আফগানের ইনিংসের পর কতজন বা আঁচ করেছিলেন মন্থর গতির হাসমতুল্লাহ শাহিদি এখানে একটু পরে উল্লাসের কেতন উড়াবেন। গোল বলের খেলা যেন অনিশ্চয়তার রঙ্গমঞ্চ। সেই মঞ্চে প্রথম বারের মতো দ্বিশতক করা মুশফিকের ইনিংসের কল্যাণে বাংলাদেশ ৯ বছর পরে বিদেশের মাটিতে ড্র করেছিলো। হয়তো হাসমতুল্লাহর প্রথম দ্বিশতকে আরও ভালো কিছু করবে আফগানিস্তান দল।
সম্পাদক ও প্রকাশক: রফিকুল ইসলাম
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-১৩১০