মুহা. ইকবাল আজাদ, ঢাকা
ইতিহাস গড়তে ২৪ বলে ১ রান প্রয়োজন। স্ট্রাইকে গত ওভারে বাউন্ডারি মারা রাকিবুল হাসান। ডাগ আউট ছেড়ে বাংলাদেশ টিম বাউন্ডারি লাইনে। কেউ উত্তেজনায় চিল্লাচ্ছেন। কেউ পতাকা হাতে দৌড় দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। মাঠে থাকা কাপ্তান আকবর আলীও চুপচাপ। বিজয়ের মাহেন্দ্রক্ষণ আসতে যে খুব বেশি দেরি নেই, এটা বুঝতে বাকি ছিলো না আকবরের। ভারতীয় অধিনায়কের চেহারায় আঁধার ধারণ করেছে। সবচেয়ে বেশি মেঘ জমেছে টুর্নামেন্টের সফল ব্যাটসম্যান জশওয়ালের অবয়বে। বল হাতে এগিয়ে আসছেন এনকোলেকার। রাকিবুলও এগিয়েছেন কিছুটা। ফিল্ডারের মাথার উপর দিয়ে বল ডিপ মিড অনে। নন স্ট্রাইকের কাপ্তান আকবর আলীর উচ্চ লাফ। ততক্ষণে আদায় হয়ে গেছে এক রানের আক্ষেপ। মাঠে উসাইন বোল্টের গতিতে ছুটে এসেছেন সাকিব-শরিফুলরা।
আইসিসির কোন ইভেন্টে বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বজয়। শব্দ বৃদ্ধিতে, বিশ্ব ক্রিকেটের আয়োজনে বিশ্বমঞ্চের প্রথম বিশ্বকাপ জয়। আনন্দে আত্মহারা বাংলার প্রশিক্ষক নাভিদ নেওয়াজ, কাপ্তান আকবরের চোখে অশ্রু টলমল। কোচকে ঘিরে শরিফুলের আনন্দের চক্ষু জল বিসর্জন। উত্তেজনায় পুরো মাঠ গর্জন করে কাঁপাচ্ছে বাংলার ছোট বাঘেরা। নিজের দেশের পতাকা নিয়ে দৌড়াচ্ছে দুই-তিন জন। জানান দিচ্ছে বিশ্ব মাতাতে বাংলাদেশও তৈরি হচ্ছে। কেউ বা দর্শকদের আরও উৎসবমুখর করে তুলছে। বাংলাদেশ কলরবে পচেফস্ট্রুম তখন যেন মিরপুর স্টেডিয়াম।
বাংলাদেশ-ভারত মানে হেরে যাওয়া ম্যাচের প্রতিচ্ছবি। ২০১৫ এর বিশ্বকাপ, ২০১৬ এর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ কিংবা ২০১৭ এর চ্যাম্পিয়নস ট্রফি। আইসিসির ইভেন্ট মানে ভারতের কাছে নির্ঘাত হার। গত এশিয়া কাপেও ১০৭ রানের টার্গেটে যুবারাও হারে এই ভারতের কাছে। জাতীয় দল এই হারের গল্পগুলো কতটা মনে রাখে বা পরবর্তী ম্যাচে হারের জেদ কতটা জিততে শিখায়, তা ভিন্ন প্রসঙ্গ। কিন্তু টাইগার যুবাদের গত হারের গল্প ভালো করেই হৃদয় ক্ষয়েছে। হারের জেদ জিততে শিখিয়েছে। যার ফলে ফাইনাল ম্যাচে প্রথম থেকেই বোলারদের কথার আক্রমণ। ইনিংসের দ্বিতীয় বল থেকে শরিফুলের কথার ফুলঝুরি কিংবা সাকিবের বল থ্রো, এ-সবই গত হারের জিদের অংশ। কম যাননি ভারতীয়রা। বিষ্ণু, আকাশ, ত্যাগীরাও স্লেজিং করেছেন, বাজে বকেছেন। শাহাদাতকে আউট করে বিষ্ণু অশ্রাব্য শব্দও ব্যবহার করেছেন, ইমনকে ব্যাটিং করতেও আহবান করেছেন। হিসাব করলে এসবই ক্রিকেটের অংশ। আইসিসির মতে কিছুটা অমার্জনীয় ব্যবহার। কিন্তু উল্লাসের সময় অন্য দেশের পতাকা কেড়ে নেওয়া কিসের অংশ?
মাঠে যা হয়েছে তা নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছেন বাংলার কাপ্তান আকবর আলী। একই কাজ ভারতীয়রা করেও তাদের কাপ্তান ছুঁড়েছেন অভিযোগের তীর। ভারতীয় ম্যানেজার বিচার দিয়েছেন আইসিসির কাছে। আইসিসিও অভিযোগ শুনেছেন। মাঠের হাতাহাতির বিচার করেছেন। শাস্তিও দিয়েছেন দীর্ঘ দিনের। তাতে বাংলার যুবাদের তিন নাম। ভারতীয় মাত্র দুজন। আইসিসির এই বিচার কতটা নিরপেক্ষ কিংবা কতটা আইনের যথোপযুক্ত তা ভালো বলতে পারবেন বিশ্লেষকরা। কিন্তু নিজের দেশের পতাকা রক্ষা করতে গিয়েও যদি কাউকে এতদিনের নিষিদ্ধ হতে হয়, সেটা সাধারণ দর্শকদের চোখেও বেমানান লাগবে। কোন জাতির জাতীয়তাবাদে অন্যের পক্ষাঘাত দেখলে যে কেউই উত্তেজিত হবে। পতাকা রক্ষা করতে গিয়েই যদি এত শাস্তির মুখে পড়তে হয়, তবে অন্য দেশের পতাকা কেড়ে নিলে কত বড় শাস্তি হতো, প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
বাংলাদেশ দলের তৌহিদ ১০ ম্যাচ, শামীম ৮ ম্যাচ এবং রাকিবুল ৪ ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছেন। আইসিসির জেনারেল ম্যানেজার জিওফ অ্যলার্ডিস বিবৃতি দিয়েছেন,
‘আইসিসি অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের ফাইনালে আশানুরূপ লড়াই হয়েছে। কিন্তু ম্যাচ শেষে উল্লাস ও হতাশা প্রকাশের সময় যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে, ক্রিকেটে তার কোন স্থান নেই। স্পিরিট অফ ক্রিকেটে সম্মান জিনিসটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আশা করি, ক্রিকেটাররা আরও আত্মসংযমী হবে, প্রতিপক্ষকে তাদের সাফল্যের জন্য অভিনন্দন জানাবে আবার নিজেদের সাফল্য উপভোগ করবে।’
ক্রিকেটাররা শাস্তির কথা জেনেছেন, বিনা বাক্যে মেনে নিয়েছেন। সুযোগ হলে বিসিবি অবশ্য শাস্তি কমাতে আবেদন করবেন বলেও জানিয়েছেন। যুবা ক্রিকেটাররা এখান থেকে কিছুটা হলেও শিখবেন, পরবর্তীতে নিজেদেরও সংযত রাখবেন। কিন্তু বিচার-বিবেচনা, সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে আইসিসির উপর মোড়লদের প্রভাব আদৌও কি কমবে?