
বুটেক্স প্রতিনিধি-
বাংলাদেশের একমাত্র সরকারি টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়—বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুটেক্স) আর্থিক স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষার্থী ও সংশ্লিষ্টরা। অভিযোগ উঠেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট ও আয়-ব্যয়ের তথ্য গোপন রেখে প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। ফলে বড় ধরনের আর্থিক অনিয়মের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তাছাড়া তথ্য অধিকার আইন মেনে প্রশাসনের কাছে তথ্য চেয়ে আবেদন করলেও তারা তথ্য অধিকার আইন মানছেন না।
বুটেক্সে প্রতি সেমিস্টারে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ১,৬০০ টাকা ভর্তি ফি নেওয়া হলেও কোন খাতে কত টাকা আদায় করা হয় সে বিষয়ে কোনো বিবরণ দেওয়া হয় না। একইভাবে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় ২০,১০০ টাকা নেওয়া হয়। সেখানে বিভিন্ন খাতের নাম থাকলেও কোন খাতে কত টাকা নেওয়া হয় তার বিবরণ উল্লেখ নেই। ফলে নির্দিষ্ট খাত বাবদ টাকা পরিশোধ করলেও টাকার পরিমাণ অনু্যায়ী সুবিধা পাওয়া তো দূরে থাক সেই খাতে সুবিধা দেওয়া হয় কিনা সে বিষয়ে প্রশ্ন উঠে। এমনকি অনেক শিক্ষার্থী জানেনই না তিনি সে খাতে টাকা পরিশোধ করেছেন।
তাছড়াও বুটেক্সের অর্থ কমিটির পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের থেকে আদায়কৃত ফি এর পুনঃনির্ধারিত হারের এক নথি থেকে জানা যায় প্রতি সেমিস্টারে “ছাত্র সংসদ/ছাত্র কার্যক্রম” খাতে ২৫০ টাকা করে নেওয়া হয়, যদিও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখনো কোনো ছাত্র সংসদ গঠিত হয়নি।
এছাড়া “খেলাধুলা” ও “ধর্মীয় তহবিল” খাতে প্রতি সেমিস্টারে ৫০ টাকা করে, আর প্রথম বর্ষে “শিক্ষার্থী কার্যক্রম ফি” হিসেবে ৩,২৫০ টাকা আদায় করা হয়। পাশাপাশি “রোভার স্কাউট” (৫০ টাকা) খাতেও অর্থ সংগ্রহ করা হয়—যেখানে বাস্তবে এসব কার্যক্রম বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই বা কখনো চালু হয়নি।
প্রথম বর্ষের ভর্তি ফি-এর মধ্যে “খেলাধুলা, পরিবহন, ধর্মীয় তহবিল ও বিবিধ” নামে আরও চারটি খাতে যথাক্রমে ৮০০, ৩,০০০, ৫০০ ও ৬০০ টাকা করে নেওয়া হয়। অথচ খেলাধুলার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারি বাজেটেই প্রতিবছর প্রায় ১১ লক্ষ টাকা বরাদ্দ রয়েছে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের মতে তারা বিভিন্ন খেলাধুলার আয়োজন করতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যথাযথ সুবিধা বা ফান্ডিং পাওয়া যায় না। আবার অনেকের মতে স্পোর্টস খাতে বুটেক্স প্রশাসন ইউজিসিতে টাকা ফেরত দিতেও প্রস্তুত কিন্তু শিক্ষার্থীদের পেছনে ব্যায় করবেন না, এমন ধারণা পোষণ করে। কিন্তু ছাত্রলীগের আমলে এনাদের অনেকের হাতেই লাখ লাখ টাকার অনিয়ম হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, এসব খাত থেকে প্রতি বছর শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রায় অর্ধকোটি টাকা সংগ্রহ করা হয়, যার ব্যয়সংক্রান্ত কোনো বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায় না। এর মধ্যে শুধুমাত্র “শিক্ষার্থী কার্যক্রম” খাতেই প্রায় ১৯ লক্ষ টাকা আদায় হয়, আর “ছাত্র সংসদ” খাতে প্রায় ১২ লক্ষ টাকা আদায়ের হিসাব ধোঁয়াশাপূর্ণ। শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছেন, “যে কার্যক্রমগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই, সেগুলোর নামেই নিয়মিত টাকা নেওয়া হচ্ছে। অথচ কোথায় সেই টাকা ব্যয় হচ্ছে, তা কেউ জানে না।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট সংক্রান্ত তথ্যও রাখা হচ্ছে সম্পূর্ণ গোপনীয়। শিক্ষক, শিক্ষার্থী, এমনকি বিভাগীয় প্রধান ও ফ্যাকাল্টি ডিনরাও বাজেটের বিস্তারিত জানেন না বলে জানা গেছে। এর আগে বাজেট বিষয়ে জানতে চাইলে ফাইন্যান্স বিভাগ উপাচার্যের নিষেধের কথা বলে। অন্যদিকে দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে বাজেট সংক্রান্ত তথ্য সংশ্লিষ্টদের জন্য প্রকাশ্যে থাকে এবং তারা সহজেই তা জানতে পারেন।
এ বিষয়ে বুটেক্সের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. শাহ আলিমুজ্জামানের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, “আমি উপাচার্যের দায়িত্ব পালনকালে অ্যাকাউন্টস সেকশনকে ফি-সংক্রান্ত বিস্তারিত হিসাব প্রকাশের ব্যাপারে বলেছিলাম, কিন্তু তারা এতে আগ্রহী ছিল না এবং নানা ধরনের যুক্তি দেখাতো। আমার মেয়াদকালে আমি এসব অর্থ খাত অনুযায়ী ব্যয় করার চেষ্টা করেছি। যেমন: ধর্মীয় ফান্ড থেকে মসজিদে এসি লাগানোর কাজ করা হয়েছিল। তবে যে সকল অর্থ ব্যয় হয়নি, সেগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনেই থাকার কথা।”
তিনি আরও যোগ করেন, “আগে ছাত্র সংসদের টাকার জন্য ছাত্রলীগ আমাকে চাপ দিত এবং না দিলে ঝামেলা করতো। তবে বর্তমানে যেহেতু রাজনীতি নেই, তাই স্বচ্ছতার জন্য হিসাবসমূহ বিস্তারিত প্রকাশ করা উচিত।”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষক বলেন, “যদি বাজেট গোপন রাখা হয়, তাহলে আর্থিক জবাবদিহিতা বিঘ্নিত হয় এবং স্বচ্ছতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। শিক্ষার্থীদের অর্থ কোন খাতে যাচ্ছে, তা জানার অধিকার তাদের রয়েছে।"
বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী শাহাদাত হোসেন বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক কার্যক্রমে স্বচ্ছতা না থাকলে প্রশাসনের প্রতি আস্থা নষ্ট হয়।”
বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৯তম ব্যাচের এক শিক্ষার্থী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে কুয়েটের একটি ভর্তি রসিদের সঙ্গে তুলনা করে লেখেন, “দেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি বা সেমিস্টার ফি-এর বিস্তারিত উল্লেখ থাকে। কিন্তু বুটেক্সে ব্যতিক্রম দেখা যায়। শিক্ষার্থীদের টাকা কোন খাতে যাচ্ছে, তা অজানা।”
এই বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস সেকশনের ডেপুটি ডিরেক্টর মোহাম্মদ কামরুজ্জামান চৌধুরী বলেন, “এই বিষয়ে তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে উপাচার্যের নিষেধ রয়েছে। প্রয়োজনে সরাসরি উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করতে হবে।”
বুটেক্সের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. জুলহাস উদ্দিনের সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে তিনি ‘উপাচার্যের নিষেধ’-এর বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, এই বিষয়গুলো সম্পর্কে তিনি অবগত নন এবং শিগগিরই ফাইন্যান্স অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস সেকশনের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনা করবেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন,"আমার জানামতে বর্তমান উপাচার্য একাধারে উপচার্য ও কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছেন। অথচ তার দায়িত্ব গ্রহণের এক বছর পরও তিনি যখন এমন একটি বিষয়ে অজ্ঞ থাকেন বলে জানান তা আসলে একাধারে অবিশ্বাস্য ও হতাশাজনক।"
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে “তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯” অনুযায়ী যেকোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ও প্রশাসনিক তথ্য প্রকাশযোগ্য। এই আইনের ধারা ৬(১)-এ স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে—“প্রত্যেক সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জনগণের জন্য তাদের কার্যক্রম ও ব্যয়সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করবেন।” অথচ তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী আবেদন করেও তথ্য না পাওয়ার নজির বুটেক্সে বিদ্যমান।
এজন্য দেশের বিশেষায়িত এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতা ও বিস্তারিত হিসাব প্রকাশের দাবি উঠেছে। তবে এখন পর্যন্ত প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো ব্যাখ্যা বা উদ্যোগ দেখা যায়নি।
সম্পাদক ও প্রকাশক: রফিকুল ইসলাম
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-১৩১০