ইডেন প্রতিনিধি :
রাজধানীর ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সরকারি ইডেন মহিলা কলেজে জুলাই অভ্যুত্থানের পরে ছাত্রলীগ পালিয়ে গেলে আপামর সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রচেষ্টায় তৎকালীন দায়িত্বরত অধ্যক্ষ জনাব ফেরদৌসী বেগম সহ সকল বিভাগীয় প্রধানদের মাধ্যমে ১৮ আগস্ট, ২০২৪ সালে সরকারি ইডেন মহিলা কলেজকে ছাত্ররাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস ঘোষণা দেয়া হয়।
যার এক বছর পূর্ণ হয়েছে। এ অবস্থায় উঠে আসছে এক নতুন পরিবেশ,এবং এর ভবিষ্যৎই বা কি ইঙ্গিত দিচ্ছে, টিকে থাকবে কি এই পদক্ষেপ?
ছাত্ররাজনীতি বন্ধের গত একবছরে কোনো প্রকাশ্যে রাজনৈতিক সভা,সেমিনার, কার্যক্রম দেখা যায় নি।কোনো গন্ডগোল, মারামারি, সিট বাণিজ্য ও টর্চারের চিত্র দেখা যায় নি বরং সাংস্কৃতিক ও সুষ্ঠু সামাজিক কার্যকলাপে মুখরিত ছিলো ক্যাম্পাস। তবে কিছু শিক্ষার্থীদের দাবি শিক্ষার্থী প্রতিনিধি না থাকায় নানান সমস্যার মোকাবেলা করা যাচ্ছে না। এমতাবস্থায় ছাত্ররাজনীতি বন্ধ নিয়ে ভিন্ন মতামতও দিচ্ছেন কেউ কেউ। সাধারণ শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগই ছাত্ররাজনীতি চান না বলে জানালেও ছাত্ররাজনীতিতে যারা আছেন তারা বলছেন, এতে গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি হচ্ছে না,নেতৃত্ব গুণাবলির চর্চাও থাকছে না।
এ নিয়ে ব্যবস্থাপনা বিভাগের ২০২১-২২ সেশনের আনিকা আক্তার বলেন, ইডেন কলেজে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের এক বছর পূর্ণ হলেও ভাবার বিষয় হলো ইডেন ক্যাম্পাস থেকে কি আদৌ রাজনীতি বন্ধ হয়েছে? কেননা শুনতে পাচ্ছি এখনো নাকি হলগুলোতে রাজনীতি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। কিন্তু আমি মনে প্রাণে চাই ইডেনে যেনো আর রাজনীতি না ঢুকে। আমার প্রিয় ক্যাম্পাসে যেনো আর কোনো কাদা না লাগে। আর যেনো আমাদের হলের বোনদের অত্যাচার সহ্য করতে না হয়। এটাই চাওয়া। মনে রাখা জরুরি যে, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন।
সাবিনা ইয়াসমিন বলেন,ইডেনের বর্তমান পরিবেশই ভালো। প্রতিষ্ঠান এখন সুন্দর ও স্বাভাবিক আছে। আর রাজনীতির প্রয়োজন নেই ক্যাম্পাসে।
সাদিয়া আফরিন মৌ এ নিয়ে বলেন,আমরা যদি পূর্বের ইডেন ক্যাম্পাসের সাথে বর্তমান পরিস্থিতি তুলনা করি তাহলে বলব বর্তমান সময়ের শিক্ষার্থীরা অনেক বেশি শান্তিপূর্ণভাবে ক্যাম্পাসের প্রতিটা প্রাঙ্গনে ঘোরাফেরা করে, কেমন জানি মুক্ত পাখির মত তারা ইডেন ক্যাম্পাসের প্রতিটা অঙ্গনে ডানা মেলে উড়ে বেড়ায়, যেটা জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পূর্বে অর্থাৎ ছাত্র রাজনীতি বহাল থাকা অবস্থায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা পারত না তাদের মনে একটা আতঙ্ক কাজ করতো কোথায় কার সাথে ধাক্কা লাগে, কোথায় কার সাথে কোন বিষয় নিয়ে ঝামেলা সৃষ্টি হয়ে যায় এবং প্রতিনিয়ত ক্যাম্পাসের রাজনৈতিক নেত্রীদের সালাম দিয়ে মাথা নিচু করে চলাফেরা করার যে একটি প্রবণতা ছিল সেটি সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য অনেক বেশি অস্বস্তিকর বিষয় ছিল।
তিনি আরো বলেন, রাজনীতি করা সবার গণতান্ত্রিক অধিকার সেখানে হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই রাজনীতিটাকেও সংস্কার করা প্রয়োজন। তবে আমি মনে করি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোনো রকম রাজনৈতিক আধিপত্য বহাল না থাকাই শ্রেয়।
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের ঢাকা নগর শাখার অর্থ সম্পাদক ও সমাজকর্ম বিভাগ বিভাগের সুমাইয়া শাইনা বলেন,
গত ১৭ বছর ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসে এককভাবে আধিপত্য কায়েম করেছে এবং অন্য কোন ছাত্র সংগঠনকে রাজনীতি করার সুযোগ দেয়নি। ক্যাম্পাসে সন্ত্রাস, সিট বানিজ্য, গেস্টরুম, গণরুম কালচারের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অপরাজনীতির চর্চা করেছে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ, ভিন্ন মত দমন ও প্রশাসনকে দলীয়করণের মধ্য দিয়ে সর্বাত্মক দখলদারিত্ব কায়েম করেছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্র রাজনীতি সম্পর্কে এক ধরনের আতঙ্ক ও ভীতি তৈরি হয়েছে। এবং শিক্ষার্থীদের এই ভীতিকে পুঁজি করে ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের মতো ঘটনাগুলো ঘটেছে।
তিনি আরও বলেন, ছাত্র রাজনীতির মূল কাজ হলো ছাত্রদের অধিকারের কথা বলা, ছাত্র ও শিক্ষা রক্ষায় ভূমিকা পালন করা।
অভ্যুত্থান পরবর্তী সময় আমরা দেখেছি কলেজ প্রশাসন কোন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে একের পর এক শিক্ষার্থীর স্বার্থ বিরোধী বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। আমাদের কলেজে এখনো পর্যন্ত ছাত্র সংসদ নির্বাচনের কোন আয়োজন আমরা দেখতে পাইনি, এদিকে ছাত্র সংগঠনগুলো থাকলে তারা মতামত প্রদান করতে পারতেন। ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা গণতান্ত্রিক ক্যাম্পাস গড়ে তোলার প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে।
ইডেন কলেজ ছাত্রদলের সদস্য সচিব, সানজিদা ইয়াসমিন তুলি বলেন,
বিগত ১৭ টা বছর স্বৈরাচারী স্বৈরাচার হাসিনার আমলে শুধু ইডেন ক্যাম্পাস নয় বাংলাদেশের কোন ক্যাম্পাসেই শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ছিল না। ছাত্রলীগ ছাড়া
অন্য কোন সংগঠন স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করতে পারতো না। সেং ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ অভ্যন্তরীণ কোন্দল, সিট বাণিজ্য, দখলদারিত্ব এবং সাধারণ ছাত্রীকে নানা ভাবে হেনস্তা করাই ছিল ছাত্রলীগের মূল টার্গেট।
এই ছাত্রলীগের একক আধিপত্যের কারণে আমরা কোনভাবেই হলে থাকতে পারতাম না।
তিনি আরও বলেন,ক্যাম্পাসে সাধারণ ছাত্রীদের নামে একটি পক্ষ একক আধিপত্য কায়েম করতে চাচ্ছেন। আর এইগুলো মদদ দিচ্ছেন আওয়ামীলীগ সমর্থিত শিক্ষকরা। তারাই বর্তমানে ক্যাম্পাস রাজনীতি বন্ধের পাইতারা করছেন। হল গুলোতে এখনও ছাত্রদল কর্মীদের নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। আমরা আমাদের সাংগঠনিক অভিভাবক তারেক রহমানের নির্দেশনা মেনে ক্যাম্পাসে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রেখে আমাদের – কার্যক্রম ব্যাপক পরিসরে না হলেও সীমিত পরিসরে -অব্যাহত রেখেছি।
এছাড়াও তিনি বলেন, ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের পদক্ষেপটা সঠিক বলে আমি মনে করি না। যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে ওঠে কিন্তু ক্যাম্পাস রাজনীতির মাধ্যমেই।
আর যোগ্য নেতৃত্ব সম একটি সমাজ এবং রাষ্ট্রের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ক্যাম্পাসে সঠিকভাবে রাজনীতি বাস্তবায়ন করতে পারলে অবশ্যই সেটা ভালো দিক। ক্যাম্পাস থেকে অপরাজনীনি বন্ধ করতে চাই, ছাত্ররাজনীতি বন্ধের পক্ষে নই।
ইডেন মহিলা কলেজ অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. শামসুন নাহার বলেন,আমি ২০২৩ সালে ইডেন কলেজে বিভাগীয় প্রধান হিসেবে যোগদান করি। অর্থনীতি বিভাগে রাজনীতিতে খুব সক্রিয় শিক্ষার্থী আমার চোখে পরেনি, বা সক্রিয় থাকলেও প্রকাশিত ছিল না। রাজনীতি সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীদের যোগাযোগ বেশি থাকে প্রশাসনের সাথে, আমি যেহেতু প্রশাসনে ছিলাম না কাজেই তাদের সম্বন্ধে বেশি কিছু জানি না। আন্দোলন চলাকালে তাদের কিছু কার্যক্রম দেখেছি এই পর্যন্তই। এক বছর থেকে রাজনীতি নিষিদ্ধ না বলে বলা উচিৎ দলীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ। প্রতিটি শিক্ষার্থী স্বাধীনভাবে তাদের বাকস্বাধীনতার চর্চা করছে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের নানা বিষয় নিয়ে তাদের মত প্রকাশ করছে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ক্যাম্পাস সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। এখানে আমি বা আমার নয় বরং আমরা বা আমাদের এই বিষয়টি প্রাধান্য পাচ্ছে। এটি আশাব্যঞ্জক।
তিনি আরো বলেন,আমরা একটি গণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যে নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি সেখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতি কেমন হওয়া উচিত এই প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সময়োপযোগী। ছাত্র রাজনীতি শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব, সচেতনতা এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ছাত্র রাজনীতি হওয়া উচিৎ দলীয় রাজনীতির প্রভাব থেকে মুক্ত, শিক্ষার্থীদের কল্যাণ, গণতন্ত্র, এবং মানবিক মূল্যবোধ দ্বারা পরিচালিত, শিক্ষাবান্ধব ও নীতিনির্ভর।
ইডেন মহিলা কলেজে গত একবছরের চিত্র ছিলো যুগ যুগ ধরে চলা অপরাজনীতির বাহিরে। যা ছিলো স্বস্তি, শান্তি ও শিক্ষার যথোপযুক্ত পরিবেশেের রূপ।বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরা বলেন তাদের এই মুক্ত বাতাসে আর ফিরিয়ে আনতে চাননা রাজনীতিকে।তবে কারো কারো মত, সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক চর্চায় ছাত্ররাজনীতি হচ্ছে বিশেষ সহায়ক।
তবে সবারই একই কথা- ক্যাম্পাসে শিক্ষার পরিবেশ, মানোন্নয়ন ও গঠনমূলক কার্যক্রম চান।