ভ্রমণ করতে কার না ভাল লাগে? আর সেই ভ্রমণ যদি হয়, ডিপার্টমেন্ট দের বড় ভাই, ছোট ভাই,সহপাঠী,শিক্ষকদেরকে নিয়ে, তাহলে তো ভ্রমণ ফলপ্রসূ হবে-ই। আমি আবার খুব ভ্রমণ পিপাসু লোক, কোন বন্ধু বা সহপাঠী যদি বলে চল ঘুরে আসি, আমি এক পায়ে রাজি। যদি বিশেষ কোন কাজ না থাকে। ২০২৩ সালের (২ মার্চ) আমরা বন্ধুরা মিলে কক্সবাজার ঘুরে আসি। এরপর আবার শুনি, (১৮ মার্চ) আমাদের ইংরেজী বিভাগ ফেনী সরকারি কলেজ থেকে শিক্ষা -সফরের তারিখ নির্ধারণ করেছে।
আর এ শিক্ষা- সফরটা হবে পার্বত্য - অঞ্চল খাগড়াছড়ি কেন্দ্রিক, তাই আমি আর লোভ সামলাতে পারলাম না। ট্যুরের জন্য নাম রেজিস্ট্রেশন করে ফেললাম, আমি আর সজল। দেখতে দেখতে চলে এল আমাদের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, যার জন্য অপেক্ষা করেছিলাম।
(১৮ মার্চ) শনিবার সকাল ৬.৩০ মিনিটে আমাদের গাড়ি ছাড়ার নির্দিষ্ট সময়। সবার গ্রুপ লিডারকে আগে থেকেই বলা হয়েছে, ঠিক সময়ে উপস্হিত হতে হবে। আগের দিন রাতে আমাদের টিম লিডার 'মামুন' মোবাইলে কল দিয়ে বলে, আমাদের শিহাব স্যার, পাংচুয়াল একজন মানুষ। কারও জন্য কিন্তু অপেক্ষা করা হবে না, যদি সময় মত না আস। আমি সে কথার তাগিদে ফজর নামাজের আগেই রেডি হয়ে, নামাজ পড়ে রওয়ানা দিলাম। আমরা ঠিক সময়ে সবাই হাজির।
এসে দেখি বাস রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে শান্ত ভাবে। উল্লেখ্য যে, বাসের নাম -ই শান্তি পরিবহন। আমাদের এ সফরে, তিনজন শিক্ষক যাবেন। তাঁরা হলেন, বিভাগীয় প্রধান: (সোহেল মোস্তাক স্যার) সহকারী অধ্যাপক: (শিহাব উদ্দীন ও মাহফুজ উদ্দীন স্যার) আমরা কলেজ গেইটে নামার কিছুক্ষণ পর-ই দেখলাম, আমাদের বিভাগীয় প্রধান মোস্তাক স্যার হাজির। জানতে চাইলো, মাহফুজ স্যার আসে নি? আমরা বললাম যে, না এখনো স্যার আসে নি। কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর আমাদের মাহফুজ স্যার ও চলে আসলেন। কিন্তু ; যার কারনে আমরা সঠিক সময়ে হাজির হলাম, সেই শিহাব স্যার নেই। পরে জানতে পারলাম, তিনি আমাদের সাথে ' তরুণদের সেলফি রোড খ্যাত ' সেখান থেকে আমাদের সাথে গাড়িতে উঠবে। আমাদের বাস দুইটি ছিল, আমরা দ্বিতীয় বাসে ছিলাম, আমাদের সাথে ছিলেন, মাহফুজ স্যার, গাড়ি চলতে চলতে হটাৎ করে চাক্কা পাংচার হয়ে যায় প্রথম গাড়ি। আমরা ও তাকে ধরে ফেললাম। কি করা সবাইকে সকালের নাস্তার ব্রেক দেওয়া হলো, নাস্তার আইটেম ছিল, মুরগির খিঁচুড়ি, শসা, ডিম,কাঁচামরিচ ইত্যাদি।
আমাদের সকালের নাস্তা করাও শেষ, গাড়ির চাক্কা লাগানো ও শেষ। এবার আবার গন্ত্যব্যের দিকে চলা। সেফলফি রোড়ের আগে আমাদের সাথে যোগ দিলেন,শিহাব স্যারের ছেলে এবং সহধর্মিনী। মূলত, স্যারের বাড়ি মেইন রাস্তার সাথে হওয়ায়, আমাদের আমন্ত্রণ করেছিল,কিন্তু সময় কম থাকার কারনে যাওয়া সম্ভব হয়নি।
প্রথম স্পর্ট "সেলফি রোড" সবাই নেমে যে যার মত করে ছবি তুলছে, ১৫ মিনিটের মধ্যে সবাই আবার গাড়িতে উঠে যায়। গাড়ি যেন তার আপন গতিতে ছুটে চলছে, আমি জানালার পাশে বসে সরু এবং উঁচু - নিচু রাস্তা দেখছি। আর বিশাল বিশাল টিলা, যা আগে কোন ভিডিও দৃশ্যতে দেখছি। আমার যেমন ভয় করছিলো, তেমনি অনেক আনন্দ লাগছিলো। যার কারনে ভয়ের রেশটা কেটে গেছে। পুরো সফর জুড়ে আমাদের সার্বিক দেখাশুনার দায়িত্বে ছিল, নাহিয়ান, জাহিদুল ইসলাম,হাসনাত সোহাগ, আবির, আতিকুর রহমান তুষার ও ফুয়াদ।
চলছে গাড়ি, আপন বাড়ি। আপন বাড়ি বলতে আমাদের আজকের বাড়ি খাগড়াছড়ি। চলন্ত গাড়িতে আমাদের পিছনের ছিটে ছিল অনার্স থার্ড ইয়ার আর সামনে ছিল আমাদের (মাস্টার্স) এর বড় ভাইয়েরা। সবাই খুব ইনজয় করছিলো, বাসের মধ্যে নিজ কন্ঠে গান গাওয়া হচ্ছিলো। যেহুতো আমাদের ফেনী থেকে খাগড়াছড়ি যেতে সাড়ে তিন থেকে চার ঘন্টা লাগবে। নিজ কন্ঠ বাদ দিয়ে সাউন্ড বক্সে জোরে গান ছেড়ে দিল, আর সবাই উল্লাস করছিল। হঠাৎ করে একটা আওয়াজ হলো,এখন বন্ধ করো। অনেক বাজিয়েছো এখন রেষ্ট করো। সেনাবাহিনীর কমান্ডার যখন কোন কিছুর নির্দেশ দেওয়ার পর সৈনিকেরা সাথে সাথে পালন করে। আমিও লক্ষ করলাম সেই কাজটি সংঘঠিত হয়েছে।
খুব দ্রুত চলে আসলাম, "দ্বিতীয় স্পর্ট " আলুটিলা গুহা। এটি একটি প্রাকৃতিক গুহা, গুহাটিকে আলুটিলা রহস্যময় গুহাও বলা হয়। স্হানীয়রা একে বলে মাতাই হাকর। আমরা দুই বাসে প্রায় ৮০ জন ছিলাম। সবাই, মেইন গেট দিয়ে আলুটিলাতে প্রবেশ করলাম। যেতে যেতে সেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আলু টিলা গুহার মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম অনেককে? কারণ, সবাই এই গুহাতে প্রবেশ করতে পারে না। সাহসী যারা আছে তারাই পারে। কারণ, গুহার ভিতর অন্ধকার, দেখতেও ভয়ংকর। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে একজন বলে, না - যাব না? আমি সহ আরও কয়েকজন বলে আসছি যখন, গুহার ভিতর ঢুকব-ই। যেই ভাবা সেই কাজ,ঢুকে পড়লাম, জুতা পায়ে নিয়ে, বৃষ্টির সময় প্রচন্ড পানি থাকে তখন জুতা হাতে নিতে হয়,আমারা যখন গিয়েছি তখন পানি তেমনটা ছিল না। সবশেষে আমরা গুহার সফর সফল ভাবে শেষ করলাম। সবাই স্যারদের সাথে গ্রুপ ছবি,সিঙ্গেল ছবি তোলা শুরু করলেন। আমরাও ছবি তুললাম, কিছুক্ষণ ঘোরা-ঘুরি করার পর সবাই আলুটিলা গুহার স্হান ত্যাগ করলাম।
আবার ও শান্ত মনে সবাই যাচ্ছি আমাদের পরবর্তী স্পর্টে। এবার স্পর্ট খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ হার্টিকালচার পার্ক। সেখানে যেতে যেতে আমাদের দুপুর দুইটা বেজে গিয়েছে। সবাইকে ক্লান্ত মনে হচ্ছে; আমরা সেখানে ঝুলন্ত ব্রিজ পাড়ি দিয়ে , দুপুরের লাঞ্চের জন্য অপেক্ষা করলাম। সে এক আজব কাহিনী, সবাই ক্ষুধার্থ যেন, কয়েকদিনের উপোস। সবাই পেলেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আবার দু'একজনে আমাদের এই কষ্টের দৃশ্য ভিডিও করছে।
দুপুরের লাঞ্চের পর, শরীরে একটু প্রশান্তি অনুভব হল। কেউ কেউ ড্রেস চেঞ্জ করছে, আমিও করলাম, সজল, রাকিব সহ আরও অনেকে করলো। মজার বিষয় হলো, মেয়েরা এই সফরে এসেও তাঁরা মেকাপ নিয়ে ব্যস্ত ছিল। আমরা এখানে ঘোরাঘুরির পর, রাকিব বললো চলো, চা খেয়ে আসি। আমরা ৫ জনে মিলে চা খেলাম, চা-গুলো অসম্ভব খারাপ ছিল। দাম কিন্তু কম নেয়নি, প্রতিকাপ ১৫ টাকা করে নিয়েছে। যাই হোক,দেখতে দেখতে আমাদের সফর প্রায় শেষের দিকে। বিকেল ৩ টা থেকে আমাদের কালচারাল পোগ্রাম শুরু হয়। আমাদের মাঝে আমাদের সহকারী অধ্যাপক " মাহফুজ স্যার" যাকে আমরা সবাই মিলে নাম দিয়েছি,গানের সম্রাট। তিনি ইংরেজী সাহিত্যে পড়াশোনা করলেও তাঁর সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা অনেকটাই প্রখর। তিনি সবাইকে মনোমুগ্ধকর গান শুনাতেন। আমাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গিয়েছে ৩.১০ মিনিট থেকে, প্রথম গান গেয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, শিহাব উদ্দীন স্যারের চার বছরের ছেলে, আবদুল্লাহ আল আরাফ। কৌতুক পরিবেশন করে, (রাকিব) যার কৌতুক শুনে সবাই হাসতে বাধ্য হয়েছিল। তার পরবর্তী সেশন ডান্স : ডান্স পরিবেশন করে সাওজিয়া এবং রাইসা। এরপর শুরু হয় আমাদের গানের সম্রাট 'মাহফুজ উদ্দীন " এর ভিন্নধর্মী গান। সবাই স্যারের দিকে তাকিয়ে আছে। মাঝখানে আমাদের র্যাফেল ড্র অনুষ্ঠিত হয়। মোট দশজনকে পুরস্কৃত করা হয়েছে। সেরা দশের ভিতর আমার নাম পাঁচ নম্বরে উঠে এসেছে,সত্যি আমি বিশ্বাস করতে পারছি না যে, আমি বিজয়ী হয়েছি, অনেক হাসি -মাখা মুখ আর কৌতুহল নিয়ে যখন, পুরস্কার গ্রহন করতে যাব, তখন আমাদের (বিভাগীয় প্রধান) সোহেল মোস্তাক স্যার বলেন,করিম এদিকে দাঁড়াও ছবি তুলতে হবে। সত্যি বলতে আমি স্যারের মুখে আমার নিজের নাম শুনে কি-যে ভাল লেগেছে তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। সাধারণত স্যারের সাথে দেখা করতে গেলে বা কোন কাজ থাকলে শান্ত এবং সাবলীল ভাষাতে বলে কি অবস্হা কিছু বলবা ? কাজ থাকলে তো স্যার অবশ্যই সেটা সমাধান করে দেয়। আমি নিজে খুব প্রাউড ফিল করি, যখন শিহাব স্যার,আর মোস্তাক স্যার আমাকে নাম ধরে সম্বোধন করে, আমাদের ইংরেজী ডিপার্টমেন্ট এর স্যার গুলোর বিনয়ী, ভালবাসা এবং দুরদর্শিতা অনেকটাই প্রখর। শিক্ষার্থীদের সাথে খুব সহজেই মিশে যেতে পারেন। কোন ধরনের ইতস্ততা বোধ করে না। মোস্তাক স্যার একটু ব্যতিক্রম, তিনি একাধারে বিভাগীয় প্রধান, এ ছাড়াও তিনি সামাজিক কার্যক্রম, সেচ্ছাসেবী এবং মানবকল্যাণ কাজে সব সময়ের জন্য নিবেদিত প্রান। তার হাত থেকে যখন আমি পুরস্কার গ্রহন করি তখন ফিলিংসটা অন্য রকম।
সর্বশেষ, আমরা আমাদের সকল কার্যক্রম শেষ করে গন্ত্যব্যের দিকে ফিরে চললাম। তখন ৫.৩০ মিনিট সবাই আস্তে আস্তে বাসে উঠে পড়লাম। বাসে উঠার পরে আমাদেরকে মাহফুজ স্যার,গান শোনালেন। সবাই উচ্ছাসিত, দেখতে দেখতে মুহূর্তের মধ্যে আমরা ফেনী চলে আসলাম। তখন রাত নয়টা বাজে, সবাই- সবার থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছে, আমরাও এক পা দু -পা নেমে চলে যাচ্ছি আমাদের বাসস্হানে। হয়ত কোন একদিন আবারও এমন সুন্দর মাহেন্দ্রক্ষণ আমাদের সামনে এসে হাজির হবে। সব কিছু মিলিয়ে অনেক ভাল লাগলো আমাদের খাগড়াছড়ি আনন্দ ভ্রমণ।
------------
মো.আব্দুল করিম গাজী
শিক্ষার্থী,ফেনী সরকারি কলেজ,(ইংরেজী বিভাগ)।
সম্পাদক ও প্রকাশক: রফিকুল ইসলাম
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-১৩১০