অ্যাডভোকেট সাইফুদ্দীন খালেদ
একটি দুর্ঘটনা আজীবনের কান্না; এ স্লোগান ব্যবহার হয় সড়ক পথে দুর্ঘটনা বিষয়ে জনগণকে সচেতন করার জন্য। দুর্ঘটনা জনিত খবর গুলো সব থেকে বেশি শিহরিত করে তুলে। প্রতিদিন মানুষের মৃত্যু ঘটাচ্ছে দেশের বিভিন্ন সড়কগুলোতে। ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই দুজন শিক্ষার্থীকে বাসচাপা দেওয়ার পর দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে ওঠে। শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের মুখে সরকার ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর নতুন সড়ক পরিবহন আইন পাস করে। এর আগে মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩ এবং মোটরযান বিধিমালা ১৯৮৪ এর অধীনে সড়ক পরিবহন খাত পরিচালিত হয়ে আসছিল। ১লা নভেম্বর ২০১৯ইং থেকে ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’ কার্যকর করার জন্য ২২ অক্টোবর প্রজ্ঞাপন জারি হয়। এরপর বিআরটিএ থেকে আইনটি কার্যকর করতে সকলের কাছে অনুরোধ জানিয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে ‘আইন মেনে চালাবো গাড়ি, নিরাপদে ফিরব বাড়ি’। সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ এ মোটরযান চলাচলের নির্দেশাবলী দেওয়া হয়েছে। উক্ত আইনের ৪৯ ধারায় প্রথম অংশে বলা হয়েছে- মদ্যপান বা নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করে কোন চালক মোটরযান চালাতে পারবেনা। মদ্যপান বা নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করে কোন কন্ডাক্টর বা মোটরযান শ্রমিক মোটরযানে অবস্থান করতে পারবেনা। মোটরযান চালক কোন অবস্থাতে কন্ডাক্টর বা মোটরযান শ্রমিককে মোটরযান চালনার দায়িত্ব প্রদান করতে পারবেনা। সড়ক বা মহাসড়কে নির্ধারিত অভিমুখ ব্যতীত বিপরীত দিক হতে মোটরযান চালানো যাবেনা। সড়ক বা মহাসড়কে নির্ধারিত স্থান ব্যতীত অন্যকোন স্থানে বা উল্টো পার্শ্বে বা ভুল দিকে (ডৎড়হম ঝরফব) মোটরযান থামিয়ে যানজট বা অন্যকোন ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যাবেনা। চালক ব্যতীত মোটর সাইকেলে একজনের অধিক সহযাত্রী বহন করা যাবেনা এবং চালক ও সহযাত্রী উভয়কে যথাযথ ভাবে হেলমেট ব্যবহার করতে হবে। চলন্ত অবস্থায় চালক, কন্ডাক্টর বা অন্যকোন ব্যক্তি কোন যাত্রীকে মোটরযানে উঠাতে বা নামাতে পারবেনা। প্রতিবন্ধী যাত্রীদের জন্য গণপরিবহণে অনুকূল সুযোগ-সুবিধা রাখতে হবে। মোটরযানের বডির সামনে, পিছনে, উভয়পার্শ্বে, বডির বাহিরে বা ছাদে কোন প্রকার যাত্রী বা পণ্য বা মালামাল বহন করা যাবেনা। সরকার বা কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ব্যতীত কোন মোটরযানে বিজ্ঞাপন প্রদর্শন বা প্রচার করা যাবেনা। কোন মহাসড়ক, সড়ক, ফুটপাত, ওভারপাস বা আন্ডারপাসে মোটরযান মেরামতের নামে যন্ত্রাংশ বা মালামাল রেখে বা দোকান বসিয়ে বা অন্য কোনভাবে দ্রব্যাদি রেখে যানবাহন বা পথচারী চলাচলে বাধা সৃষ্টি করা যাবেনা। সড়কের সংলগ্ন ফুটপাতের উপর দিয়ে কোন প্রকার মোটরযান চলাচল করতে পারবেনা। কোন ব্যক্তি কোন মোটরযানের মালিক বা কোন আইনানুগ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতীত সংশ্লিষ্ট মোটরযান চালিয়ে বাইরে নিয়ে যেতে পারবেনা। আইনানুগ কর্তৃপক্ষ বা যুক্তিসংগত কারণ ব্যতীত কোন ব্যক্তি দাঁড়িয়ে থাকা কোন মোটরযানে প্রবেশ বা আরোহণ করতে পারবেনা। দ্বিতীয় অংশঃ মোটরযান চালক মোটরযান চালনারত অবস্থায় মোবাইল ফোন বা অনুরূপ সরঞ্জাম ব্যবহার করতে পারবেনা। মোটরযান চালক সিটবেল্ট বাঁধা ব্যতীত মোটরযান চালাতে পারবেনা। দূরপাল্লার মোটরযানে নির্ধারিত সংখ্যক যাত্রী বা আরোহীর অতিরিক্ত কোন যাত্রী আরোহী বহন করা যাবেনা। কোন চালক, কমান্ডার বা মোটরযান পরিচালনার সংশ্লিষ্ট কোন ব্যক্তি পরিবহনযানে যাত্রী সাধারণের সাথে কোন প্রকার দূর্ব্যবহার বা অসৌজন্যমূলক আচরণ বা হয়রানি করতে পারবেনা। রাত্রি বেলায় বিপরীত দিক হতে আগত মোটরযান চালনায় বিঘœ সৃষ্টি হয় এরূপ হাইবিম ব্যবহার করে মোটরযান চালানো যাবেনা। উপরোক্ত নির্দেশাবলী সমূহ অমান্য করলে শাস্তির বিধান রয়েছে। প্রথম অংশের কোনো বিধান লঙ্ঘন করলে অনধিক ৩(তিন) মাসের কারাদ- বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদ- বা উভয় দ-ে দ-িত হবে এবং চালকের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত হিসাবে দোষ সূচক এক পয়েন্ট কর্তন হবে। দ্বিতীয় অংশের কোন বিধান লঙ্ঘন করলে অনধিক ১(এক) মাসের কারাদ- বা ৫ হাজার টাকা অর্থদ- বা উভয় দ-ে দ-িত হবে এবং চালকের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত হিসাবে দোষ সূচক এক পয়েন্ট কর্তন হবে। নতুন আইনে বেপরোয়া বা অবহেলায় গাড়ি চালানোর কারণে কেউ গুরুতর আহত বা কারো প্রানহানি হলে অপরাধীর সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদ- বা অনধিক ৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দ-ের বিধান রাখা হয়েছে। সড়ক পরিবহন আইনে বলা আছে, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হত্যার উদ্দেশ্যে প্রমাণিত হলে তা দন্ডবিধি ১৮৬০এর ৩০২ ধারার অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। কোনো ব্যক্তির ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকলে বা মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্স ব্যবহার করে গাড়ি চালালে সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদ- বা সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দ- হবে। সড়কে দুটি গাড়ি পাল্টা দিয়ে (রেসিং) চালানোর সময় যদি দুর্ঘটনা ঘটে, সে ক্ষেত্রে তিন বছরের কারাদ- অথবা ২৫ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। চলন্ত অবস্থায় চালক মুঠোফোনে কথা বললে এক মাসের কারাদ- বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে। এই আইনে অপরাধের তদন্ত, বিচার, আপিল ইত্যাদি ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধি প্রযোজ্য হবে। কিন্তু মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর চাপে এটি পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করতে পারেনি। আইনটি পাশ হওয়ার পর পরেই এটি পরিবর্তনের দাবিতে পরিবহন শ্রমিকরা দুই দফায় ধর্মঘট ডাকে। ফলে আবার সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়। উক্ত সংশোধনীতে রয়েছে এই আইনের ১০৫ ধারা অনুযায়ী, কেউ যদি মোটরযান দুর্ঘটনায় মারাত্মকভাবে আহত হন বা মারা যান, তাহলে তা ১৮৬০ সালের দন্ডবিধির সংশ্লিষ্ট ধারা অনুযায়ী অপরাধ বলে বিবেচনা করা হবে। দন্ডবিধির ৩০৪-বি ধারায় যা-ই বলা থাকুক না কেন কারো নিয়ন্ত্রণহীন গাড়ি চালানোর ফলে বা অবহেলাজনিত কারণে কেউ যদি দুর্ঘটনার শিকার হন এবং এতে যদি কেউ মারা যান বা মারাত্মকভাবে আহত হন, তাহলে তাদের সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদ- কিংবা ৫ লাখ টাকা জরিমানা কিংবা উভয় শাস্তি হবে। কিন্তু সংশোধনীতে ‘মারাত্মকভাবে আহত’ বিষয়টি বাদ দেওয়া হয়েছে এবং জরিমানা ৩ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে, পাঁচ বছর কারাদ-ের বিষয়টি রাখা হয়েছে। সংশোধনীতে বলা হয়েছে, ভুক্তভোগীকে জরিমানার টাকা সম্পূর্ণ বা আংশিক পরিশোধের জন্য আদালত আদেশ দিতে পারবেন। আইনের ৮৪, ৯৮ ও ১০৫ ধারা অজামিনযোগ্য অপরাধ। কিন্তু আইনটি সংশোধন হলে ৮৪ ও ৯৮ ধারা জামিনযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। ৮৪ নম্বর ধারায় অবৈধভাবে মোটরযানের আকৃতি পরিবর্তনে শান্তির কথা বলা হয়েছে। ৯৮ নম্বর ধারায় ওভারলোডিং বা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে গাড়ি চালানোর শাস্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে। ১২৬টি ধারার মধ্যে ২৯টি সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে, যার মধ্যে ১৫টি ধারায় বিদ্যমান কারাদ- ও অর্থদ- কমানো হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনার আরো বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে; কারণগুলোর মধ্যে রাস্তার ব্ল্যাকস্পট (ক্রটি), অদক্ষ চালক, সড়কের তুলনায় গাড়ির সংখ্যা বেশি, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, রাস্তার জ্যামিতিক ক্রটি, ঘুমন্ত ও নেশাগ্রস্ত হয়ে গাড়ি চালানো, পথচারী ও যাত্রীদের অসাবধানতা, ডিভাইডারের অভাবে বিপরীতমুখী যানবাহনের মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ, রেলের অরক্ষিত লেভেলক্রসিং। অনেক সময় রেলক্রসিং গুলোতে ট্রেনের ধাক্কায় মারা যাচ্ছে মানুষ। দেশের অধিকাংশ রেলক্রসিংয়ে নেই পর্যাপ্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা, নেই কোন সঠিক আগাম সংকেতের ব্যবস্থাও। দুর্ঘটনা কবলিত স্থানে দ্রুত চিকিৎসা সাহায্য পৌঁছানো, এম্বুলেন্স, ইমার্জেন্সি সার্ভিস এবং ফার্স্ট এইড টিম সংক্রান্ত ব্যাপারগুলো দেশে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। হাইওয়েগুলোতে পুলিশের পেট্রোল কারের সংখ্যাও নগণ্য। গাড়ির সিটবেল্ট এবং হেলমেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনীহা, ঝুঁকিপূর্ণ গতিতে গাড়ী ওভারটেক করা, ট্রাফিক আইন সম্পর্কে অজ্ঞতা ইত্যাদি। এসব কারণে সড়ক দুর্ঘটনা এখন অন্যতম জাতীয় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। এই সমস্যা থেকে মানুষজনকে মুক্ত রাখার সার্বিক পদক্ষেপ গ্রহণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখা জরুরী। যানবাহনের উচ্চগতি দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে। জেব্রা ক্রসিং ও ফুট ওভারব্রিজ ছাড়া রাস্তা পারাপার বন্ধ করতে হবে। পাঠ্য পুস্তকের সিলেবাসেও সড়ক দুর্ঘটনার কারণ, প্রতিরোধ সংক্রান্ত সচেতনতামূলক প্রবন্ধ, গল্প অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। চালকদের সচেতনতা বৃদ্ধিসহ বিআরটিএ'র উদ্যোগে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। ট্রাকে ওভারলোড বন্ধে প্রয়োজনীয় সংখ্যক (ওয়েয়িং) মেশিন চালু করা এবং ওভারলোডের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা চালু করতে হবে। বিভিন্ন সড়কের সুনির্দিষ্ট কারণ চিহ্নিত করে দুর্ঘটনা বিরোধী অভিযান চালাতে হবে। সড়ক মেরামত, সংস্কারের মত জরুরী কাজকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে বিভিন্ন গাড়ি ভাংচুর করে আগুন জ্বালিয়ে সাধারন জনতা ক্ষোভ প্রকাশ করলেও তারা ভুলে যাচ্ছে এটা কোনো সঠিক পন্থা নয়। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সড়ক পরিবহন আইন এবং ট্রাফিক আইন আইন সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান রাখা দরকার। সড়কে যানবাহন চলাচল এবং দুর্ঘটনা সংক্রান্ত ব্যাপার গুলোতে আইনের সঠিক প্রয়োগ করতে হবে। আইনের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা অবিলম্বে সম্পন্ন করা হোক। কর্তৃপক্ষের সুষ্ঠু, সমন্বিত পদক্ষেপ, জনগণের সচেতনতা ও আন্তরিক প্রচেষ্টায় দেশ দুর্ঘটনামুক্ত হবে এ প্রত্যাশা।
লেখক ঃ অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।
সম্পাদক ও প্রকাশক: রফিকুল ইসলাম
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-১৩১০