-----------------------------------
সাইবার ক্রাইম একটি ভয়াবহ আতঙ্কের নাম । শব্দটি সম্পর্কে কম বেশি সবাই পরিচিত হলেও এর পরিণতি সম্পর্কে সঠিক ধারণা অনেকেরই নেই । সাইবার অপরাধ বা কম্পিউটার অপরাধ, এমন একটি অপরাধ যা সংগঠনে একটি কম্পিউটার (computer), নেটওয়ার্ক (internet) বা ইন্টারনেট সংযুক্ত ডিভাইস (device) অপরাধের সাধন (object) হিসেবে ব্যবহার করা হয় । বাংলাদেশে সাইবার ক্রাইম সংক্রান্ত অপরাধ দমনের জন্য সংশ্লিষ্ট আইনটি অনেকেরই জানা নেই ।আবার আইসিটির নামেও রয়েছে নানা দুর্বলতা ।
কখন আর কিভাবে বুঝবেন আপনি সাইবার হামলার শিকার হচ্ছেনঃ
ফেসবুক, ওয়াটস এ্যাপ, ইমু, স্ন্যাপ চ্যাট, ইত্যাদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এ্যাপগুলো এখন সবার হাতের নাগালে তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাড়ছে হয়রানি পরিমাণ ।প্রযুক্তির এই ছোঁয়ায় আমাদের দেশ বদলেছে অনেক ।সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলোর অন্যতম হল ফেইসবুক । সহজলভ্য হয়ে পড়ায় ফেসবুকের মাধ্যমে সাইবার ক্রাইম বেড়েই চলেছে ফলে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে এই সাইবার ক্রাইম । আমাদের অজান্তেই আমরা সাইবার ক্রাইমেরর শিকার হয়ে যাচ্ছি । অনেকেই মুখ বুঝে সহ্য করেই যাচ্ছেন, কিন্তু জানেন না যে কিভাবে কি করতে হবে । কখন আর কিভাবে বুঝবেন যে আপনি ফেসবুকে বা সামাজিক গণমাধ্যমে সাইবার ক্রাইমের শিকার হচ্ছেন বা কখন আইনি ব্যবস্থা নিতে পারবেন ।
১. সাইবার বুলিং- কেউ যদি অনলাইনে আপনাকে অহেতুক জ্বালাতন করে এবং আপনার সম্মানহানি করার চেষ্টা করে অথবা অনলাইনে যেকোনো উপায়েই হোক কেউ যদি আপনাকে উত্যক্ত করে তাহলে তা সাইবার বুলিং হিসেবে স্বীকৃত । সেক্ষেত্রে তা যদি অনলাইনে হয় তাহলে আপনি তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারবেন ।
২. ডিফেমিং- আপনার আর আপনার ব্যবসায়ের স্বার্থ নষ্ট করার জন্য কেউ যদি উঠে পড়ে লাগে এবং সেক্ষেত্রে তা যদি অনলাইনে হয় তাহলে আপনি তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারবেন ।
৩. আইডি হ্যাক- আপনার ফেইসবুক আইডি কেউ যদি হ্যাক করে থাকে আর আপনার ব্যক্তিগত ছবি আর কথোপকথন অনলাইনে ছেড়ে দেবে বলে যদি হুমকি প্রদান করে, পাশাপাশি তা ঠেকানোর জন্য তার বিনিময়ে যদি সে আপনার কাছে অর্থ দাবি করে সেক্ষেত্রে আপনি আইনি ব্যবস্থা নিতে পারবেন ।
৪. সেক্সুয়ালি এবিউজ- কেউ যদি অনলাইনে আপনার ছবি দিয়ে কোনো অনলাইন প্ল্যাটফর্মে আইডি খুলে, আপনার ছবি ব্যবহার করে কোনো পোস্ট প্রদান করে । আপনার ছবির সাথে অন্য ছবি জোড়া লাগিয়ে বিতর্কিত কিছু বানোয়াট খবর প্রকাশ করে, আপনার ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি বা ভিডিও অনলাইনে প্রকাশ করে, পাশাপাশি তা ঠেকানোর জন্য তার বিনিময়ে যদি সে আপনার কাছে অর্থ দাবি করে সেক্ষেত্রে আপনি আইনি ব্যবস্থা নিতে পারবেন ।
৫. হ্যাকিং- অনলাইনে ডাটা বা তথ্য অনুমতিবিহীন চুরি, ধ্বংস বা ক্ষতিসাধন করার প্রক্রিয়াকেই বলা হয় হ্যাকিং । এতে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের তথ্য চুরি হয় এবং প্রাতিষ্ঠানিক সুনাম ক্ষুন্ন হয় ।
এ রকম আরো অনেক কিছুই রয়েছে। তবে এখন নাগাদ এই সমস্যাগুলোই বেশি পরিলক্ষিত হয়েছে । এর মধ্যে ফেইসবুকে সাইবার ক্রাইমের শিকার হওয়ার সংখ্যাই অনেক বেশি ।পাশাপাশি রয়েছে অনলাইন বা ইন্টারনেটে অনেক রকমের হয়রানি ।অনলাইনের হয়রানির ধরনগুলো কেমন হতে পারে যেমন সামাজিক মাধ্যমে ফেক আইডি খুলে জ্বালাতন, সামাজিক মাধ্যমের আইডি, ইমেইল অথবা ওয়েব সাইট হ্যাক, সামাজিক মাধ্যমের বিভিন্ন ট্রল গ্রুপ বা পেজে ব্যক্তিগত ছবি ছড়িয়ে দেওয়া, বিভিন্ন পর্নো ওয়েবসাইটে ব্যক্তিগত মুহূর্তের ধারণ করা ছবি বা ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া, সামাজিক মাধ্যমের আইডি হ্যাক করে অর্থ দাবি, ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি বা ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি প্রদান ও হয়রানি, কাউকে মারধর করে তার ভিডিও ধারণ করে তা অনলাইনে ছড়িয়ে দেওয়া, কোনো কিশোরী বা যুবতী বা নারীকে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে তার ভিডিও ধারণ করে তা অনলাইনে ছড়িয়ে দেওয়া, অনলাইনে ইকমার্সের নামে ভুয়া পেজ খুলে খারাপ পণ্য বিক্রির নামে হয়রানি, অনলাইনে পরিচিত হয়ে অনলাইন কারেন্সি ট্রাঞ্জেকশন করতে গিয়ে ফ্রডের শিকার, ভুয়া বিকাশ নম্বর থেকে ফোন করে লটারির কথা বলে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ, ভুয়া বিকাশের এসএমএস দিয়ে গ্রাহককে দিয়েই অভিনব কায়দায় প্রতারণা, অনলাইনে ব্যাংক একাউন্ট আর এটিএম কার্ডের ডিটেইলস চুরি করে অর্থ চুরি, অনলাইনে স্প্যামিং এবং গণ রিপোর্ট, অনলাইনে স্ক্যামিং, অনলাইনে বিভিন্ন সেলেব্রেটি বা মানুষের নামে ভুয়া তথ্য ছড়ানো বা খবর প্রচার, আসলে এভাবে সাইবার ক্রাইম নিয়ে বলতে গেলে শেষ হবে না ।
পর্নোগ্রাফির কথা বলতে গেলে, পর্ণ সাইটগুলো সবচেয়ে বিপদজনক জিনিস । বেশিরভাগ সাইটে ক্ষতিকর কম্পিউটার ভাইরাস সম্বলিত । অনেক সাইট পপঅ্যাপ শো করে এবং কখনও কখনও ইমেইল এড্রেস চেয়ে থাকে । আই সাইটগুলো স্বাভাবিক মন- মানসিকতাকে বিকৃত রুচির করে তুলে এবং মানুষ নানা ধরনের অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ে ।
আয়ের নেশায় সাইবার ক্রাইমঃ
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজস্ব পেজ, গ্রুপ কিংবা ইউটিউব চ্যানেল খুলে সেখান থেকে লাখ টাকা আয়ের নেশায় ভয়ংকর সাইবার ক্রাইমে জড়িয়ে পড়ছেন একশ্রেণির তরুণ-তরুণী ।এ তালিকায় রয়েছেন শিক্ষার্থী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারসহ উচ্চ ডিগ্রিধারীরা । ভাইরাল, লাইক, শেয়ার, ভিউ, ফলোয়ার বাড়াতে তারা বেছে নিচ্ছেন অসৎ ও বিকৃত পথ । নিজস্ব পেজ, চ্যানেল কিংবা গ্রুপে সামাজিক প্রথাবিরোধী ভিডিও আপলোড করলে ভিউ ও ফলোয়ার বেশি হওয়ায় আয়ও বেশি হয় । এই হীন মানসিকতাই বিপথে নিয়ে যাচ্ছে তাদের । এ ছাড়া আপত্তিজনক ছবি তুলে তা ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইলও করা হচ্ছে । ফেসবুকে গার্লস প্রায়োরিটি গ্রুপের অ্যাডমিন অভিজাত পরিবারের সন্তান তাসনুভা আনোয়ার নামের এক দন্ত চিকিৎসকও সাইবার ক্রাইমের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন । নগরীর পাঁচলাইশের এক নারীকে ব্ল্যাকমেইল করার ঘটনায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় কারাভোগ করেন তিনি ।
সাইবার হামলার শিকারঃ
সাইবার অপরাধ এবং প্রযুক্তির নিরাপদ ব্যবহার নিয়ে মানুষকে সচেতন করার কাজে নিয়োজিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন দেশের সাইবার অপরাধ নিয়ে একটি গবেষণার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখান থেকে জানা যায়, শতকরা প্রায় ৫২ ভাগ অভিযোগই আসে নারীদের থেকে ৷ সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সী মেয়েরা। শতাংশের হিসাবে যা প্রায় ৭৪ শতাংশ। অভিযোগের একটি বড় অংশের অভিযোগ ফেসবুক সংক্রান্ত ৷ যার মধ্যে আইডি হ্যাক থেকে শুরু করে সুপার ইম্পোজ ছবি এবং পর্নোগ্রাফির মতো ভয়াবহ অভিযোগও রয়েছে ৷ সাইবার হামলার শিকার বেশি নারীরা ৫২% অভিযোগ নারীদের থেকে ৩০% নারী জানেনা কীভাবে আইনি ব্যবস্থা নিতে হয় । ৭৪% নারীদের বয়স ১৮-৩০ বছরের মধ্যে ২৫% নারী মনে করে অভিযোগ করে লাভ হবে না । এর পাশাপাশি প্রতিবছরই মামলার সংখ্যা বাড়ছে । ২০১৭ সালে মামলা বৃদ্ধির হার ছিল ১৫ শতাংশ । ২০১৮ সালে হয়েছে ৭ শতাংশ আর ২০১৯ সালে সেটি গিয়ে দাঁড়িয়েছে ২৮ শতাংশে । গত ১৩ মাসে মোট দুই হাজার ৯৩২ জন ভুক্তভোগী অভিযোগ নিয়ে এসেছে । এর মধ্যে এক হাজার ৫৫৩ জন পুরুষ ও এক হাজার ৩৭৯ জন নারী রয়েছে । শতকরা হিসাবে ৫৩ শতাংশ পুরুষ ও ৪৭ শতাংশ নারী ।এক্ষেত্রে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাইবার হামলায় শিকার হন।
সাইবার ক্রাইমে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা থেকে বাঁচার উপায়ঃ
সর্বপ্রথম ব্যক্তিগত কোনো কিছু অনলাইনে আদান-প্রদান করবেন না, সামাজিক মাধ্যমের পাসওয়ার্ড কারও সাথে শেয়ার করবেন না, পাবলিক ওয়াইফাই ব্যবহার কমানো, ব্যক্তিগত ডিভাইসকে সুরক্ষিত রাখা, নিজের বা পারিবারিক কোনো ছবি পাবলিকে না দেওয়া, সামাজিক মাধ্যমে বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে সাবধান হওয়া, ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি বা ভিডিও গ্রহণ না করা এবং কেউ গ্রহণ করতে চাইলে তাতে বাধা প্রদান করা, মোবাইলে অহেতুক উপহারের কথা শুনে অর্থ লেনদেন না করা, বিকাশে ভুয়া মেসেজ না বুঝেই টাকা ট্রাঞ্জেকশন করে ফেলা, সুরক্ষিত নয় এমন কোনো জায়গায় ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ড রাখা, সুরক্ষিত নয় এমন কোনো দোকানে বা অনলাইন শপে ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ড দিয়ে কেনাকাটা করা, রিভিউ না দেখেই অনলাইনের বিভিন্ন শপ থেকে কেনাকাটা করা, প্র্যাংকের নামে সমাজবিরোধী কোনো অনলাইন ভিজুয়্যাল কন্টেন্ট, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন ভালগার গ্রুপ ।
মামলার স্তুপঃ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৮ সালে তাদের কাছে সরাসরি এক হাজার ৭৬৫টি অভিযোগ জমা পড়েছিল । এছাড়া, হ্যালো সিটি অ্যাপস, ফেসবুক, মেইল ও হেল্প ডেস্কের মাধ্যমে অভিযোগ এসেছে ৬ জাজার ৩০০টি । ২০১৯ সালে সরাসরি অভিযোগের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৯৩২ টিতে । আর হ্যালো সিটি অ্যাপস, ফেসবুক, মেইল ও হেল্প ডেস্কের মাধ্যমে অভিযোগ এসেছিল ৯ হাজার ২২৭টি ।
আইনি পদক্ষেপে যত বিড়ম্বনাঃ
প্রথম পর্যায়ে পুলিশের সহায়তাই মূল । প্রমাণগুলো নিয়ে প্রথমে থানায় যাবেন । থানায় জিডি করবেন । অনেকেই আইডি বন্ধ করার জন্য পাগল হয়ে যান, কিন্তু মামলা করতে চাইলে আইডি অফ করা যাবে না । এতে প্রমাণ ধ্বংস হয় । ফরেনসিক রিপোর্টের রেজাল্ট এফেক্টেড হয় এবং মামলার ক্ষতি হয় । জিডি না নিতে চাইলে তাদেরকে পজিটিবলি বুঝাবেন যে আপনি কোন দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন । জিডি নিলে আপনাকে সাইবার ক্রাইম ইউনিটে প্রেরণ করা হবে, ঢাকায় হলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে (ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চ) । ঢাকার বাইরে ডিবিতে প্রেরণ করা হয় । সেখানে আরেকটি আবেদন করার পর আপনার অভিযোগের ওপরে তথ্য যাচাইয়ের পরে একশনে যাবে ইউনিট । প্রয়োজনে মামলা হবে । কোনো কারণে যদি আপনার মামলা না হয় বা আপনার যদি মনে হয় আপনি পুলিশকে আপনার সমস্যা বুঝাতে পারেননি বা সাপোর্ট পাচ্ছেন না, তাহলে আপনার অভিযোগের সত্যতার প্রমাণাদি নিয়ে উকিল বা অ্যাডভোকেটের সাহায্যে সরাসরি ঢাকা সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলা করতে হবে । তাছাড়া সাইবার ট্রাইব্যুনালে সরাসরি উকিল বা অ্যাডভোকেটের সাহায্যে সরাসরি ঢাকা সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলার আবেদন করা যাবে ।
আইনে শাস্তির বিধানঃ
ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের ২৫ ধারায় বলা হয়েছে, কেউ যদি ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল মাধ্যমে আক্রমণাত্মক ভয়ভীতি দেখান, তাহলে তাকে তিন বছরের জেল ও তিন লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেওয়া যাবে ।
২৬ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কেউ আইনগত কর্তৃত্ব ছাড়াই অন্য কোনও ব্যক্তির পরিচিতি তথ্য সংগ্রহ, সরবরাহ বা ব্যবহার করেন, তাহলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে ।এসব ঘটনায় অভিযোগ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ সাত বছরের দণ্ড এবং দশ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে ।
২৮ ধারায় বলা হয়েছে, কেউ যদি ধর্মীয় বোধ ও অনুভূতিতে আঘাত করে, তাহলে তার ১০ বছরের জেল ও ২০ লাখ টাকা জরিমানা হবে৷
২৯ ধারায় বলা হয়েছে, কেউ মানহানিকর কোনও তথ্য দিলে সেই ব্যক্তির তিন বছরের জেল ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে ৷
৩১ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনও ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন বা করান, যা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে বা অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে অথবা আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটায় বা ঘটার উপক্রম হয়, তাহলে ওই ব্যক্তির সেসব কাজ অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।
৩২ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনও ব্যক্তি বেআইনি প্রবেশের মাধ্যমে কোনও সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ কোনও সংস্থার কোনও অতি গোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনও ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করেন বা করতে সহায়তা করেন, তাহলে ওই ব্যক্তির ওই কাজ কম্পিউটার বা ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে ।
প্রতিবন্ধকতাঃ
প্রযুক্তিতে দক্ষ অপরাধীদের মোকাবিলায় পুলিশ কতটা প্রস্তুত, সেটি একটি বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইনে কোথাও থানায় সাইবার মামলা নেয়ার ক্ষেত্রে কোন বাধা নেই, এরপরও ভুক্তভোগীদের বেশিরভাগই থানা পুলিশের কাছে গিয়েও আশানুরূপ ফল পাচ্ছেন না। দক্ষতার অভাবে অনেক পুলিশ কর্মকর্তাকে সাইবার অপরাধের বিষয়গুলো তদন্তে হিমশিম খেতে হয়। পুরো বাংলাদেশে শুধুমাত্র একটি সাইবার ট্রাবুনাল থাকায় মামলা করতে সবাইকে ঢাকা ছুটতে হয়, সেখানে গিয়েও গিয়েও আশানুরূপ ফল পাচ্ছেন না ভক্তভুগীরা। এছাড়া অভিযোগের তদন্ত করার সময়ের মধ্যেই বিতর্কিত পোস্টটি হয়তো ভাইরাল হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে রিপোর্ট করেও কোন কাজ হয় না ৷ এছাড়া গুগলে স্থায়ীভাবে সেগুলো থেকে যাওয়ায় সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়েন ভুক্তভোগী। আসলে সাইবার ক্রাইম অনেক বড় ধরনের মহামারী আকার নেবে ২০১৮-২০২০ সালের মধ্যে ।
সরকারের প্রশংসনীয় ২০২১ সালের মধ্যে দেশকে ডিজিটাল করার উদ্যোগ যেমন একদিকে আমাদের দেশের যুবসমাজের জন্য খুলে দিয়েছে অপার সম্ভাবনার দ্বার, ঠিক তেমনি আবার এর বিপরীতমুখী প্রযুক্তির ভুল ব্যবহার আমাদের দিনে দিনে ঠেলে নিয়ে যাবে অন্ধকারে । দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বেশিরভাগ যুবক এখনো জানে না যে সাইবার ক্রাইম কি? কি হলে তাকে সাইবার ক্রাইম ধরা যাবে? অর্থাৎ তাদের মধ্যে সাইবার ক্রাইমের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র আইডিয়া নেই । যাদের জানা আছে তারা থানায় গিয়ে কোন সাহায্য পাচ্ছে না, থানায় গেলে মামলা নেয়া হয় না বলে অনেক অভিযোগ রয়েছে । ফলে ভোক্তভুগীরা দেশের প্রশাসনের উপর প্রতিনিয়ত আস্থা হারাচ্ছে এবং সঠিক বিচার পাওয়ার অধিকার ক্ষুন্ম হচ্ছে । ৫৭ ধারায় সরল বিশ্বাসের কথা বলে সকলকে দায়-মুক্তি হয়েছে । তাছাড়া পুরো বাংলাদেশে শুধুমাত্র একটি সাইবার ট্রাব্যুনাল রয়েছে ঢাকায় ফলে মামলা সঠিক সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে না, ফলে ভোক্তভোগীরা তাদের সঠিক বিচার পাচ্ছে না । তাছাড়া দেশের প্রত্যেক জেলায় সাইবার ট্রাইবুনাল না থাকার কারণে বেশিরভাগ ভোক্তভোগীরা মামলা করতে পাচ্ছে না । সাইবার আদালত সংকটের কারণে প্রতিদিন ১০ জন বিচারকও যদি সঠিকভাবে মামলা পরিচালনা করেন তবুও সঠিক সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি সম্ভব হবে না । ট্রাইব্যুনালের বিচারক এই আইনের অধীন কোনো মামলার অভিযোগ গঠনের তারিখ হইতে ১৮০ (একশত আশি) কার্য দিবসের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করার কথা বলা হলেও এই কার্যদিবসের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করা হয় না । তবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কোনো মামলা নিষ্পত্তি করিতে ব্যর্থ হইলে সর্বোচ্চ ৯০ (নব্বই) কার্য দিবস বৃদ্ধি করিতে পারিবেন এর বেশি নয় ।
দেশের প্রত্যেক থানায় একটি পূর্ণাঙ্গ ‘সাইবার পুলিশ স্টেশন’ স্থাপন করা প্রয়োজন । সাইবার পুলিশ স্টেশনে সাইবার এক্সপার্ট একটি টিম থাকলে খুব দ্রুত একশনে যাওয়া সম্ভব হবে । এছাড়াও ইনভেস্টিগেশন এবং অপারেশনের জন্য আলাদা টিম থাকতে হবে । এছাড়াও প্রতিটি জেলায় সিআইডি কার্যালয়ের কর্মকর্তারা সহযোগীতা করতে হবে । ঢাকার বাইরে সিআইডির কার্যালয়ে গিয়েও ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করতে পারার ব্যবস্থা করতে হবে । আবার আসামি গ্রেফতার বা অপারেশনের জন্য জেলার সিআইডি কর্মকর্তারাও সহযোগিতা করতে হবে । সেক্ষেত্রে তাদের ঢাকা থেকে আইটি সাপোর্ট পাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে । এই আইনে কেউ কোন সরকারী সংস্থার গোপনীয় তথ্য কম্পিউটার, ডিজিটাল যন্ত্র ও ইলেকট্রনিকের মাধ্যমে ধারণ করলে গুপ্তচরবৃত্তি বলে সাব্যস্ত করা হবে, এতে গণতন্ত্রের মৌলিক চেতনা এবং বাকস্বাধীনতায় আঘাত করছে । একইসঙ্গে তা স্বাধীন সাংবাদিকতাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলার মতো পরিবেশ সৃষ্টি করেছে ।
সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীর মন্তব্যঃ
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরা কালো আইন বলে অভিহিত করেছে । প্রকৃত ভিক্টিমরা এই আইনের সুফল না পেলেও বর্তমানে আইনটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হওয়ার অভিযোগ উঠায় সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরা আইনটিকে নিপীড়নমূলক মর্মে মন্তব্য করেছেন । অনেকে এইটাকে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের চেয়েও সঠিক কির্তনমূলক মর্মে অবহিত করেন, নানা বিতর্কের কারণে তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা বিলুপ্তি হলেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আরো কঠোর ব্যবস্থা সংযুক্ত করা হয় । কিন্তু বাস্তবে সাইবার অপরাধীরা নানা কারণে পার পেয়ে যায়, একটি মাত্র সাইবার কোর্ট হওয়ায় সেখানে মামলার স্তুপ জট এবং তদন্ত কাজেও ধীর গতির কারণে আইনটির সুফল থেকে বঞ্ছিত করছে নাগরিকদের ।
পরিশেষে বলা যায়, অপরাধ করার পরও আইন ও বিচারিক কিছু দুর্বলতার কারণে সাইবার ক্রাইমকে অনেকে এখন পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। কারণ, সারাদেশের জন্য শুধু ঢাকায় একটি মাত্র সাইবার আদালত থাকায় এ অপরাধীরা অনেক ক্ষেত্রেই অপরাধ করে পার পেয়ে যাচ্ছে । থানায় সাইবার অপরাধের অভিযোগ নিয়ে গেলে ইচ্ছে হলে মামলা নেয়, না হলে নেয় না। এ অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে হলে প্রতিটি জেলা ও দায়রা জজকে সাইবার অপরাধের মামলা নেওয়ার এখতিয়ার দেয়া উচিত নাহলে সাইবার ক্রাইম নিয়ন্ত্রণ আইনটি অধরাই থেকে যাবে ।
লেখকঃ আইনজীবী, কলামিস্ট, মানবাধিকার ও সুশাসনকর্মী।
সম্পাদক ও প্রকাশক: রফিকুল ইসলাম
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-১৩১০