রফিকুল ইসলাম জসিম:
এ দেশে সমাজ বলতে বুঝায় ভাষা, সাহিত্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি, প্রথা ঐতিহ্য ও রীতিনীতি বলি, বৃহৎ সমাজ। বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান, ঈদ, পূজা-পার্বন, মেলা, খেলাধুলা ইত্যাদিতে মিলিত হওয়ার এক সমাজ। হাসি-আনন্দ, দুঃখ-বেদনায় ভাগাভাগী হওয়ার সমাজ। এ সমাজের ভিত্তি অনেক মজবুত। সমাজে একে অপরের সুখ-দুঃখে ঝাঁপিয়ে পড়া সকলে মিলে ঐক্যবদ্ধ তৈরি হয়।
আগে মণিপুরি মুসলিম সমাজে শিক্ষা কম ছিল বলে সমাজ এগোতে পারেনি। বর্তমানে মণিপুরি সমাজে শিক্ষা বাড়ছে-সমাজও এগিয়ে যাচ্ছে। এই গতি আরো বাড়ানো দরকার। শিক্ষা ক্ষেত্রে উন্নত জাতিগুলোর চাইতে আমরা অনেক পিছিয়ে। আমরা জানি, শিক্ষার কারণেই ঘটে সমাজ উন্নয়ন। যে জাতির শিক্ষা যত বেশি এগোবে সমাজ উন্নয়ন তত বেশি সম্ভব। বর্তমানে শিক্ষা ব্যবস্থার অনেক অগ্রগতি হয়েছে। এই অগ্রগতি পিছনে কাজ করে যাচ্ছে মণিপুরি মুসলিম শিক্ষক সমাজ।
বাবা-মায়ের পর শিক্ষকদের স্নেহে, প্রশ্রয়ে, শিক্ষায়, সহমর্মিতায় প্রতিনিয়ত আমরা ঋদ্ধ হই। আমাদের আচরণের বহিঃপ্রকাশ কী হবে, শিশুবয়স থেকেই উচিত-অনুচিতের বোধ আমরা শিক্ষকের কাছ থেকেই জানতে পারি। আজ ৫ অক্টোবর শিক্ষকদিবস আমাদের কাছে আজও একটা মহান দিবস হিসেবেই সূচিত হয়। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল সেই কারণেই কবেই বলে গেছিলেন—‘‘যাঁরা শিশুদের শিক্ষাদানে ব্রতী তাঁরা অবিভাবকদের থেকেও অধিক সম্মাননীয়। পিতামাতা আমাদের জীবনদান করেন ঠিকই। শিক্ষকরা সেই জীবনকে সুন্দর ভাবে গড়ে তুলতে সাহায্য করেন।
এ পি জে আবদুল কালাম বলেছিলেন, ‘যদি একটি দেশকে দুর্নীতিমুক্ত এবং সুন্দর মনের মানুষের জাতি হতে হয়, তাহলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি এ ক্ষেত্রে তিনজন সামাজিক সদস্য পার্থক্য এনে দিতে পারে। তারা হলেন বাবা, মা এবং শিক্ষক।’ সুতরাং একমাত্র শিক্ষিত ব্যক্তিই জানে কীভাবে পরিবর্তন সম্ভব এবং শিক্ষাই পারে জ্ঞানের সীমানা বৃদ্ধি ও সত্যাসত্যের বিচার করতে। শিক্ষার উদ্দেশ্য একটি আদর্শ জাতি গঠন। শিক্ষা আলোকিত সমাজ বিনির্মাণের হাতিয়ার। শিক্ষক হলো তার সুনিপুণ কারিগর। শিক্ষা ছাড়া আলোকিত মানুষ সৃষ্টি কোনভাবেই সম্ভব নয়। একজন শিক্ষকের কিছু কাজ ও দায়বদ্ধতা আছে। এ কাজ ও দায়বদ্ধতা সহকর্মীদের কাছে, সমাজের কাছে, দেশ ও জাতির কাছে, আগামী প্রজম্মের কাছে।
বাংলাদেশে অবস্থানরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীসমূহের মধ্যে স্বল্প পরিচিত মণিপুরী মুসলিম (পাঙাল) সম্প্রদায়ের মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলায় বসবাসরত (মুসলিম ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী) মণিপুরি মুসলিম (পাঙাল) শিক্ষকের গড়া সর্ববৃহৎ একটি বেসরকারি ও শিক্ষাসেবা সংগঠন; বাংলাদেশ মণিপুরী মুসলিম এডুকেশন ট্রাস্ট (বিএমইটি)। ‘শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে গৃহীত এই সংগঠনের যে পদক্ষেপ গুলোকে আজ আলোচনা ও পর্যালোচনা করবো।
এক সময়ে শিক্ষা-দীক্ষা ও উন্নয়নে পিছিয়ে পড়া অবস্থানরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীসমূহের মধ্যে স্বল্প পরিচিত মণিপুরী মুসলিম (পাঙাল) সম্প্রদায়ের সুশিক্ষার আলোয় আলোকিত করে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে যে সংগঠনটি নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে তার নাম বাংলাদেশ মণিপুরী মুসলিম এডুকেশন ট্রাস্ট (বিএমইটি) মণিপুরি মুসলিম (পাঙাল) সম্প্রদায়ের সর্বস্তরের শিক্ষার্থীদেরকে শিক্ষা ও সেবার প্রেরণায় উজ্জ্বীবিত করে আলোর পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সংগঠনটি ইতোমধ্যে উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পেরেছে। সম্প্রদায়ের সর্বস্তরের শিক্ষার্থীদের মাঝে সংগঠনটি বৃহত্তর অরাজনৈতিক সেবামূলক প্লাটফর্ম হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জনে সক্ষম হয়েছে।
মানুষ সামাজিক জীব। সামাজিক জীব হিসেবেই সে বেড়ে ওঠে, বসবাস করে। প্রাণীজগতের আরো কিছু প্রাণীর মধ্যেও সমাজবদ্ধ হয়ে জীবনযাপনের প্রবণতা দেখা যায় তবে মানুষের বুদ্ধির মাত্রা তাদের চেয়ে বেশি। মানুষ কেবল সামাজিক প্রাণীই নয়, বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন প্রাণীও বটে। তাই সে সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাসের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রকার সংগঠন গড়ে তোলে যার মধ্যে সামাজিক সংগঠন অন্যতম। সাধারণত কোনো নির্দিষ্ট সমাজকে কেন্দ্র করেই সামাজিক সংগঠনগুলো গড়ে ওঠে। কোনো সমাজের কিছু লোক যখন কিছু নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বা সমাজের কিছু সমস্যা সমাধানে একত্র হয় এবং কিছু নীতিমালা অনুসরণ করে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যায় তখন তাকে সামাজিক সংগঠন প্রয়োজনীয়তা দেখা যায় ।
সামাজিক সংগঠন প্রতিষ্ঠায় সমাজের এক শ্রেণি মানুষকে অগ্রণী ভূমিকায় দেখা যায়। সামাজিক সংগঠন করার প্রধান কারণ সামাজিক দায়বদ্ধতা। জন্মের পর শিশুর মানসিক বিকাশে সমাজের ভূমিকা অনন্য। সমাজের কোনো এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই তার প্রথম পাঠ শুরু হয়। তরুণ বয়সে সমাজের সমবয়সী বন্ধুদের সঙ্গে চলাফেরায় তার সামাজিকীকরণ সম্পন্ন হয়, নেতৃত্বের গুণাবলি গড়ে ওঠে। এভাবে সামাজিক মূল্যবোধ নিয়ে ধীরে ধীরে সে উচ্চশিক্ষার দিকে এগিয়ে যায় এবং সমাজে সামাজিক কাজ করার দায়বদ্ধতা অনুভব করে একসময় মণিপুরি মুসলিম পাঙাল সম্প্রদায়ের এক শ্রেণি শিক্ষিত মানুষ শিক্ষাসেবামূলক সামাজিক সংগঠন গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখে ।
মণিপুরি মুসলমানদের সেই স্বপ্নের ফলস্বরূপ বাংলাদেশ মণিপুরী মুসলিম (পাঙাল) সম্প্রদায়ের শিক্ষামূলক সংগঠন বাংলাদেশ মণিপুরী মুসলিম এডুকেশন ট্রাস্ট (বিএমইটি) ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। প্রতিষ্ঠাতা সময়কালে থেকে শিক্ষা সংক্রান্ত নানবিধ কার্যক্রম গ্রহণ করে আসছে। তাদের কার্যক্রমগুলো শিক্ষাবান্ধব, সমাজ উন্নয়ন, সৃজনশীল, জনসচেতনামুলক উল্লেখ করে সবস্তরে জনসাধারণের সুনাম কুড়িয়েছে।
দরিদ্র ও অসহায় মেধাবী শিক্ষার্থীদের পাশে দাড়ানোসহ বিভিন্ন ধরণের শিক্ষা ও সেবামূলক কার্যক্রমে সংগঠনটি অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। বিশেষত মাধ্যমিক এসএসসি উচ্চ শিক্ষার সম্প্রসারণের লক্ষ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছুক শিক্ষার্থীদেরকে সংগঠনের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান সবসময়ই অব্যাহত রয়েছে। মেধাবী ও সম্ভাবনাময় শিক্ষার্থীদেরকে নিয়মিত সংবর্ধনা প্রদান সংগঠনের আরেকটি অনুপ্রেরণামূলক কার্যক্রম। শিক্ষার মান উন্নয়নের মাধ্যমে অসহায়, দরিদ্র জনগোষ্ঠির জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচী প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়নের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাওয়া সংগঠনটির মূল লক্ষ্য।
একটি উন্নত দেশ ও জাতি গঠনে শিক্ষার ভূমিকা, গুরুত্ব এবং তার প্রমাণ লিখে বা বলে শেষ করা যাবেনা। সমগ্র বিশ্বের দিকে খেয়াল করলে আমরা দেখতে পাই, যে জাতি বা দেশের শিক্ষার অবকাঠামো ও শিক্ষার সামগ্রিক পরিবেশ যত উন্নত, দেশ ও জাতি হিসেবে সার্বিকভাবে তারাই উন্নত ও স্বয়ংসম্পন্ন। শিক্ষা একটি চলমান প্রক্রিয়া- সমাজের উন্নয়নে সুশিক্ষাই বিশেষ প্রয়োজন। এই সুশিক্ষাই মানুষের মধ্যে ঐক্য ও মানবতাবোধ জাগ্রত করে। স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সুশিক্ষা যত বেশি প্রসারিত হবে, মানুষের মন ততই বড় হবে এবং সুষ্ঠু সমৃদ্ধ সমাজ গড়ে উঠবে। পরিশেষে বলা যায়, সমাজকে এগিয়ে নিতে অলস-অথর্ব লোকদের দ্বারা সম্ভব নয়। দরকার পরিশ্রমী, দক্ষ ও জ্ঞানে সমৃদ্ধ বিপুল জনগোঠীর। এই জনগোষ্ঠী গড়তে আরো দায়িত্ব পালন করতে পারেন শিক্ষক সমাজ। সমাজ হবে কলুষিত। সমাজকে গড়তে, এগিয়ে নিতে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবসে সকল শিক্ষকদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। তাদের সুস্থ ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি।’
======================
লেখক : সাংবাদিক ও প্রবন্ধকার।।
সম্পাদক ও প্রকাশক: রফিকুল ইসলাম
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-১৩১০