ইমদাদুল হক যুবায়ের :
“আজি হতে চির-উন্নত হল শিক্ষা গুরুর শির, /সত্যিই তুমি মহান উদার বাদশাহ আলমগীর।” চরণ দুটি কবি কাজী কাদের নেওয়াজের ‘শিক্ষা গুরুর মযার্দা’ কবিতার অংশ বিশেষ। সারা বিশে^র মতো বাংলাদেশেও শিক্ষকতা একটি মহান পেশা হিসেবে স্বীকৃত। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মানসম্মত শিক্ষা। যে দেশের শিক্ষার অবকাঠামো ও শিক্ষার সামগ্রিক পরিবেশ যত উন্নত, দেশ ও জাতি হিসেবে সার্বিকভাবে তারাই উন্নত ও স্বয়ংসম্পূর্ণ। আর এই জাতি গঠনের মূল কাজটি করেন আমাদের শিক্ষক সমাজ; যারা শিক্ষা ব্যবস্থার মুল চালিকাশক্তি। মা-বাবা যেমন সন্তানদের ভালোবাসা, স্নেহ-মমতা, আদর সোহাগ দিয়ে বড় করেন, ঠিক তেমনি একজন শিক্ষক শিক্ষার আলো দিয়ে একজন শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে যান। শিক্ষার্থীর মনন, মেধা, আত্মশক্তির বিকাশ, পরিশীলন, উন্নয়ন ও প্রসার সাধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন একজন শিক্ষক। তাইতো একজন শিক্ষক যেমন শিক্ষার্থীর বন্ধু, পরিচালক ও যোগ্য উপদেষ্টা, ঠিক তেমনি শিক্ষার্থীর চরিত্র গঠনের মহানিয়ামক এবং তিনিই জাতির সুনাগরিক তৈরির মহান কারিগর।
শিক্ষক দিবস হলো- শিক্ষকদের সম্মানার্থে পালিত একটি বিশেষ দিবস। ১৯৯৫ সাল থেকে প্রতি বছর ৫ অক্টোবর বিশ^ ব্যাপী পালিত হয়ে থাকে বিশ^ শিক্ষক দিবস। এই দিবসটি শিক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষক সমাজের অসামান্য অবদানকে স্মরণ করার জন্য পালন করা হয়। জাতি সংঘের অঙ্গ সংস্থা ইউনেস্কোর ডাকে বিশে^র ১০০টি দেশে এই দিবসটি পালিত হয়ে থাকে। এই দিবসটি পালনে এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল (ইআই) ও তার সহযোগী ৪০১টি সদস্য সংগঠন দিবসটি উদযাপন করে। দিবসটি উপলক্ষে ইআই প্রতি বছর একটি প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করে থাকে যা জনসচেতনতা বৃদ্ধির সাথে সাথে শিক্ষকতা পেশার অবদানকেও স্মরণ করিয়ে দেয়।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এখনো এ মহান পেশায় সামাজিক নিরাপত্তা ও পেশাগত মর্যাদার নিশ্চয়তা বিধান করা হয়নি। বরং কথায় কথায় চাকুরীচ্যুতির ভয় দেখানো হয়। এরকম ভীতিকর পরিবেশের মধ্যে কাঙ্খিত পাঠদান ফলপ্রসু হওয়ার কথা নয়।
ইসলামে শিক্ষকতা পেশাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব ও সম্মান দেওয়া হয়েছে। ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, শিক্ষকের মযার্দা সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে ছিল ব্যাপক সমাদৃত। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “তোমরা জ্ঞান অর্জন কর এবং জ্ঞান অর্জনের জন্য আদব শিষ্টাচার শেখ। তাকে সম্মান কর; যার থেকে তোমরা জ্ঞান অর্জন কর।” (ইমাম বুখারী, সহীহুল বুখারী, খ--২, হাদীস নং ৩৬৪১)
সুতরাং যার থেকে জ্ঞান অর্জন করা হয় তিনিই আমাদের শিক্ষক। সকল সৃষ্টি শিক্ষকদের জন্য দুআ করে। সকল মুমিনের দায়িত্ব শিক্ষকদের সম্মান করা। রাসূলুল্লাহ (সা.) আরো বলেছেন- “যে ব্যক্তি বড়দের সম্মান করে না, ছোটদের স্নেহ করে না এবং শিক্ষকের মর্যাদা-অধিকার বোঝে না সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।” (আহমদ, আল-মুসনাদ, খ--৫, পৃ. ৩২৩) রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজেও একজন শিক্ষক ছিলেন। তিনি বলেন- “আমাকে শিক্ষক হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে বা আমি শিক্ষকরূপে প্রেরিত হয়েছি।” (মুসলিম, আস-সহীহ, খ--৩, পৃ. ১২৫৫)
আমরা দুনিয়াতে যত নেক আমল করি সেগুলোর সাথে ইলম শিক্ষার নেক আমলের দুইটি বিশেষ পার্থক্য রয়েছে। প্রথমত, অন্যকে শিখালে ইল্ম-এর সাওয়াব চক্রবৃদ্ধিহারে বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং দ্বিতীয়ত, ইল্মের সাওয়াব মৃত্যুর পরেও অব্যাহত থাকে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন- “যদি কেউ কোনো জ্ঞান শিক্ষা দেয়, তবে সেই শিক্ষা অনুসারে যত মানুষ কর্ম করবে সকলের সমপরিমাণ সাওয়াব ঐ ব্যক্তি লাভ করবে, কিন্তু এতে তার সওয়াবের কোনো ঘাটতি হবে না।” (ইবনু মাজাহ, আস-সুনান, খ--১, পৃ. ৮৮)
ইসলামের দৃষ্টিতে শিক্ষকতা অতি সম্মানিত ও মহান পেশা হলেও আমাদের সমাজে এ মহান পেশাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখা হয়। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষকদের লাঞ্ছিত ও শারীরিকভাবে নিগৃহীত হতে দেখা যায় যা অত্যন্ত ঘৃণ্য অমানবিক কাজ। অন্যদিকে শিক্ষকতার এ মহান পেশাকে কলংকিত করে কিছু শিক্ষক নীতি নৈতিকতা বিবর্জিত কাজে জড়িয়ে পড়েন; এটা ঘৃণিত ও বর্জনীয়। অথচ রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন- “শিক্ষক ও শিক্ষার্থী ছাড়া কেউই আমার আপন নয়।” (হাকিম, আল-মুসতাদরাক, খ-- ১, পৃ. ২১১)
আলোচনার প্রান্তে এসে বলতে পারি যে, যেহেতু শিক্ষককে জীবন্ত উপাদান নিয়ে কাজ করতে হয়, সেহেতু শিক্ষকতা একটি উঁচু স্তরের শিল্প। রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে শিক্ষক যাতে চাকুরীচ্যুত বা চরম নিরাপত্তাহীনতায় নিমজ্জিত না হয় যথাযথ কর্তৃপক্ষের সেদিকে নজর দিতে হবে। তাছাড়া শিক্ষক সমাজের যৌক্তিক অধিকার প্রদান, বাস্তবসম্মত সমস্যা সমাধান ও বিভিন্ন হয়রানির প্রতিকারকল্পে অতি দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
এ কথা সর্বজন স্বীকৃত যে, স্বীয় ত্যাগ তিতিক্ষা, নিষ্ঠা-সততা, মমতা, স্বহৃদয়তা ও সেবাধর্মী মনোভাবের স্পর্শে শিশুদের আগামী দিনের সৎ ও যোগ্য নাগরিক রূপে গড়ে তোলার কাজ করেন একজন শিক্ষক। তাই শিক্ষকের কাছ থেকে আমাদের শিখতে হবে গভীর শ্রদ্ধা ও পরম মমতাবোধের মাধ্যমে। শিক্ষক সমাজকে মযার্দা দিতে হবে। তাঁদের সাথে সকল বিমাতাসুলভ আচরণ বন্ধ করতে হবে। সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকদের সকল সমস্যার সমাধানে সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষকে সচেষ্ট হতে হবে। আসুন আমরা শিক্ষকের মযার্দা রক্ষা করে দুনিয়া ও পরকালে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জন করি। আল্লাহ আমাদের তৌফিক দান করুন। আমীন॥
লেখক: শিক্ষক, জালালাবাদ ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ, এম.ফিল গবেষক, কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক।
সম্পাদক ও প্রকাশক: রফিকুল ইসলাম
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-১৩১০