--------
"জেল গেটে যখন উপস্থিত হলাম ছোট ছেলেটা আজ আর বাইরে এসে দাঁড়াইয়া নাই দেখে একটু আশ্চর্যই হলাম। আমি যখন রুমের ভেতর যেয়ে ওকে কোলে করলাম আমার গলা ধরে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে কয়েকবার ডাক দিয়ে ওর মার কোলে যেয়ে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে ডাকতে শুরু করল। ওর মাকে ‘আব্বা’ বলে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ব্যাপার কি?’ ওর মা বলল, ‘বাড়িতে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে কাঁদে তাই ওকে বলেছি আমাকে ‘আব্বা’ বলে ডাকতে। ‘রাসেল’ আব্বা আব্বা’ বলে ডাকতে লাগল। যেই আমি জবাব দেই সেই ওর মার গলা ধরে বলে, ‘তুমি আমার আব্বা।’ আমার উপর অভিমান করেছে বলে মনে হয়। এখন আর বিদায়ের সময় আমাকে নিয়ে যেতে চায় না।"
- কারাগারের রোজনামচা।
ঠিক এভাবেই বঙ্গবন্ধুর কারাবন্দীত্বের ৪৬৮২ দিন, শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব পরিবার, বাংলাদেশ তথা শেখ মুজিবের অবিকল্প প্রকৃত প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠতে পেরেছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী যেমন তার ওপর নির্ভরশীল ছিলেন আবার বঙ্গবন্ধুও বেগম মুজিবের ওপর কোনো অংশে কম নির্ভরশীল ছিলেন না। শুধু পারিবারিক জীবন নয়, বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী রাজনৈতিক জীবনে ঝুঁকি ও সংকটকালীন মুহূর্তে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বেগম মুজিব নিয়ামক ভূমিকা পালন করেছেন। বেগম মুজিবের রাজনৈতিক পরামর্শ বঙ্গবন্ধু গ্রহণ করেছেন এমন দৃষ্টান্ত কম নয়।
বঙ্গবন্ধু তার ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইয়ের অগণিত স্থানে তার সহধর্মিণীর প্রতি গভীর ভালোবাসা, আস্থা, বিশ্বাস ও পরম নির্ভরতার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি অকুণ্ঠচিত্তে বেগম মুজিবের ধৈর্য, ত্যাগ ও অবদানের বিবরণ দিয়েছেন। প্রায় ৪০ বছরের দাম্পত্য জীবনে বেগম মুজিব ভালোবেসে তার স্বামীর সংগ্রামমুখর, ঝুঁকিপূর্ণ জীবনে সঙ্গী ছিলেন।
গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে তাঁর শিক্ষা জীবনের পরিসমাপ্তি হলেও তিনি কখনও পড়ালেখা ছেড়ে দেননি। সংসার জীবনে বই ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ পাঠক। বিচিত্র বিষয়ের বই পাঠে তাঁর আগ্রহ ছিল প্রবল। বিভূতিভূষণ, বঙ্কিম, শরৎচন্দ্র, প্রবোধ সন্যালের বই ছিল তাঁর খুব প্রিয়। ওই পাঠাভ্যাসই তাকে রাজনীতি সচেতন করে তোলে। ফলে বাংলাদেশের স্বাধীকার আন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়ে তিনি জড়িয়ে পড়েন। সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।
১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলনের পক্ষে জনসমর্থন আদায় ও জনগণকে উদ্ধুদ্ধ করতে লিফলেট হাতে রাস্তায় নেমেছিলেন বঙ্গমাতা। এসময় তিনি নিজের অলংকার বিক্রি করে সংগঠনের প্রয়োজনীয় চাহিদা মিটিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের নেপথ্যেও ছিল তার সঠিক দিক নির্দেশনা। আন্দোলনের উত্তাল সময়গুলোতে নিজ বাড়িতে পরম মমতায় নির্যাতিত নেতা-কর্মীর আত্নীয় স্বজনদের আপ্যায়ন করতেন, সুবিধা-অসুবিধার কথা শুনে ব্যবস্থা নিতেন। আশাহত নেতাকর্মীরা খুঁজে পেতেন আশার-আলো, আন্দোলনের জ্বালানি আসতো বেগম মুজিবের আশাজাগানিয়া বক্তব্য থেকে। শহীদ পরিবার ও মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যক্তিগতভাবে অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছেন তিনি।
স্বাধীনতার পর বীরাঙ্গনাদের উদ্দেশ্যে বঙ্গমাতা বলেন, ‘আমি তোমাদের মা।’ অনেক বীরাঙ্গনাকে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দিয়ে সামাজিকভাবে মর্যাদাসম্পন্ন জীবনদান করেন তিনি।
বঙ্গমাতার রাজনৈতিক দূরদর্শিতার বহু দৃষ্টান্তের মধ্যে অন্যতম আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্য আসামীদের প্যারোলে মুক্তির ঘটনা।
"বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ" গ্রন্থে এমএ ওয়াজেদ মিয়া লিখেছেন, "বঙ্গবন্ধু কোর্টে প্যারোল চেয়ে আবেদন পেশ করার নির্দেশ দিয়েছেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি পক্ষের প্রধান কৌসুলি ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলামের কাছে এমন কথা শুনে বেগম মুজিব মনে মনে ভীষণ রুষ্ট হন। তিনি বঙ্গবন্ধু যাতে প্যারোলে মুক্তি না নেন সেই বার্তা পাঠান বন্দিশালায় বন্দী বঙ্গবন্ধুর নিকটে। বঙ্গমাতার চিন্তা পরবর্তীকালে সঠিক প্রমাণিত হয়। বঙ্গবন্ধু সেদিন প্যারোলে মুক্তি নিয়ে রাওয়ালপিন্ডি গেলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন স্তিমিত হতো। জনগণ ও বঙ্গবন্ধুর সহযোদ্ধারা হতাশ হতো। আইয়ুব শাহীর শাসন দীর্ঘ হতো। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্যারোলের বদলে মুক্তি পাওয়ায় জনগণ, সহযোদ্ধা ও পাকিস্তানি স্বৈরশাসকের নিকট বঙ্গবন্ধুর আপসহীন ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। আর বঙ্গবন্ধুর ওই আপসহীন ভাবমূর্তিই বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে নতুন গতি এনে দেয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ত্বরান্বিত করে। নতুন দিশা পায়।"
বঙ্গবন্ধু ও তাঁর জীবনদর্শন নিয়ে যত বেশি গবেষণা হবে, সেইখানের প্রতিটি পাতায় পাতায় বঙ্গমাতার নির্যাসমিশ্রিত খুবই সুচারুভাবে। এক অভিন্ন সত্তায় মিশ্রিত বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতার জীবনচরিত। যা কিনা পরবর্তীতে বাঙালি ও বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে সারা দুনিয়াজুড়ে।
বঙ্গবন্ধু, বাঙালি ও বাংলাদেশ যেমন একই সূত্রে গাঁথা, তেমনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবও পরস্পর অবিচ্ছেদ্য নাম।
পক্ষান্তরে বঙ্গমাতা, বঙ্গবন্ধু, বাঙালি ও বাংলাদেশ একই সূত্রে গাঁথা কতিপয় প্রণয়োপাখ্যান।
হোসাইন মাহমুদ আপেল,
প্রভাষক,
সমাজকর্ম বিভাগ,
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুর।
সম্পাদক ও প্রকাশক: রফিকুল ইসলাম
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-১৩১০