জিয়া হাবীব আহসান এডভোকেট
গত ১৫ই জুলাই, বুজর্গ শিক্ষক, নৈতিকতার বাতিঘর, আন্দরকিল্লা ঐতিহ্যবাহী এম.ই.এস হাই স্কুলের সাবেক বিজ্ঞান শিক্ষক, লেখক, সুফি গবেষক ও গ্রন্থ প্রণেতা আলহাজ্ব মৌলানা মো: লোকমান (এফ.এম. বিএসসি - বিএড) এর মৃত্যু বার্ষিকী। ২০১২ সালের ঐ দিন সকাল সাড়ে দশ টায় তিনি সি এস সি আর হাসপাতালে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন।
স্যারের রহমতগঞ্জস্থ বাসার প্রতিবেশী ও এমইএস হাই স্কুলের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট স্কাউট লীডার আমার বন্ধু ডাঃ রাকিব উল্লাহ্ প্রথম আমাকে স্যারের মৃত্যু সংবাদটি প্রদান করে। এর কদিন আগে স্যারকে আমি হাসপাতালে দেখে আসি। তিনি হাটহাজারী থানাধীন গুমানমর্দন সুলতান বাড়ীর মরহুম আলহাজ্ব মৌলানা হোছাইনুজ্জামানের ঔরষজাত ও নাংগলমোড়া ইউনিয়নের ক্বারী সাহেবের বাড়ীর মরহুম আলহাজ্ব কারী আব্দুল হাকিম সাহেবের বিদুষী কণ্যা মরহুমা আলহাজ্ব গোলবাহার বেগমের গর্ভজাত সন্তান।
একাধারে মাদ্রাসা ও আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষার সমন্বয় ঘটেছিল এ মনিষীর জীবন ও কর্মে। নৈতিকতা পূর্ণ আদর্শ জীবনের অধিকারী আমার এ প্রিয় শিক্ষককে তাঁর মৃত্যু বার্ষিকীতে শ্রদ্ধার সাথে স্বরণ করছি।যে কজন গুণী শিক্ষকের দোয়া আর ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছি তিনি তাঁদের অন্যতম।তাঁর স্নেহের ঋণ কখনো শোধ করা যাবে না। তিনি তদানিন্তন বৃহত্তর গুমান মর্দন ইউনিয়ন কাউন্সিলের ছিপাতলী —ঈদগাহ প্রাইমারি স্কুল' থেকে প্রাইমারী শিক্ষা শেষ করে ঐতিহ্যবাহী নাংগলমোড়া হাইস্কুলে লেখাপড়া করেন ও পরবর্তীতে নাজিরহাট আহমদিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। এরপর পাঁচলাইশ ওয়াজেদিয়া আলীয়া মাদ্রাসা থেকে ১৯৬২ সালে ১ম বিভাগে ফাজেল পাশ করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে ভর্তি হন এবং ১৯৬৯ সনে বিএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৮৫ সালে চট্টগ্রাম বিএড কলেজ থেকে বিএড ডিগ্রি লাভ করেন। সারা জীবন তিনি শিক্ষকতার মহান পেশায় আত্মনিয়োগ করেন এবং সমাজে শিক্ষার আলো ছড়ানোকে জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন।
অর্থ সম্পদ বৈভবের চেয়ে অতি সাধারণ মুসাফির এ-র জীবন ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট্য। ১৯৬৯ সনে তিনি ওয়াজদ্দিয়া হাইস্কুলে বিজ্ঞান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৭০ সালের ২০ জুলাই ঐতিহ্যবাহী আন্দরকিল্লাস্থ এমইএস হাই স্কুলে যোগদান করে ২০০৪ সাল পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন ভাবে শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করেন। আমি ঐ স্কুলের ১৯৮০ এসএসসি ব্যাচের ছাত্র ছিলাম এবং তিনি আমাদের অংক ও বিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন। তিনি যে একজন আলেমে দ্বীন এবং ইসলামী চিন্তাবিদ ছিলেন তা আমি প্রথম জানতে পারি আমার মরহুম আব্বা এডভোকেট আলহাজ্ব আবু মোহাম্মদ য়্যাহ্য়্যা থেকে। কারন স্যারের বড়ো ভাই বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি জনাব আলহাজ্ব এ কে এম সোলায়মান আমার আব্বার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। আর আব্বা ছিলেন তদানিন্তন বৃহত্তর গুমান মর্দন ইউনিয়ন কাউন্সিল এর প্রায় এক যুগের চেয়ারম্যান।
শ্রদ্ধেয় লোকমান স্যারের জেঠাতো ভাই সিনিয়র এডভোকেট এ.এফ মঈনউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‚লোকমান সাহেব আমার ভাই ও বন্ধু ছিলেন। তিনি ছোটবেলা থেকে সৎ, চরিত্রবান, বিনয়ী ও ভদ্র ছিলেন।আমাদের বংশ ঐতিহাসিক গৌরের শাসনকর্তা সৈয়দ আলাউদ্দিন হোসাইন শাহ গৌরীর বংশধর। গৌর এর সুলাতানের বংশধররা অত্র স্থানে এসে এই জায়গাতে আবাদ করে বলে এর নাম —গৌর মর্দ্দন' বা —গুমানমর্দন' এবং অপর অংশের নাম —সিপাহী টোলা' সিপাহিদের কেল্লা।
অপরদিকে —নাংগে মোড়া' থেকে বর্তমান —নাংগল মোড়ার' উৎপত্তি।১৪৯৩ সালে গৌরের সিংহাসনে স্বাধীন সুলতান হিসেবে সৈয়দ আলাউদ্দিন হোসাইন শাহ গৌরী অধিষ্ঠিত হন।তাঁর একমাত্র পুত্র সৈয়দ নসরত শাহ্ গৌরী তদানিন্তন বাংলার স্বাধীন সুলতান ছিলেন, তিনি চট্টগ্রামে বহু দিঘী খনন ও মসজিদ স্থাপন করেন ।
“ লোকমান স্যারের স্ত্রী মরহুমা খালেদা বেগম ছিলেন একজন পীর বংশের মহীয়সী কন্যা। তিনি রাউজান কদলপুর গ্রামের মরহুম মৌলানা হযরত মোল্লা মিসকিন শাহ (র) এর বাড়ীর মরহুম আলহাজ্ব খলিলুর রহমান প্রকাশ কে আর শাহ এর ঔরষজাত ও মরহুমা হালিমা বেগমের গর্ভের প্রথম সন্তান। আমাদের একই এলাকায় মহানগরী চট্টগ্রামের সাবেরিয়া, দেওয়ান বাজারে তাঁদের নিজস্ব বাড়ি ছিলো। যার ঠিকানা:- হালিমা মঞ্জিল, ৭ নং কাজেম আলী রোড, ঘাটফরহাদবেগ, চট্টগ্রাম শহরের এই স্থায়ী ঠিকানায় লোকমান স্যারও স্বপরিবারে থাকতেন। আমরা ওখানে স্যারের কাছে অংক ও বিজ্ঞান প্রাইভেট পড়তে যেতাম। স্যারের একমাত্র শ্যালক শাহ মোঃ সেলিম উল্লাহ আমাদের বন্ধু ছিলেন। তিনি অকালে মৃত্যু বরন করেন।
শ্রদ্ধেয় লোকমান স্যার মা আর শাশুড়ীকে একসাথে নিয়ে পবিত্র হজ্জব্রত পালন করেন।তিনি মাসের প্রায় দিন নফল রোজা ও তাহাজ্জুদ গুজার ছিলেন।লোকমান স্যারের সহধর্মীনির মৃত্যুর ৩৬দিন পর আমাদের শ্রদ্ধেয় লোকমান স্যার ইন্তেকাল করেন।স্ত্রীর ৪০দিন, আর স্যারের ৪দিন, একই দিনে হয়।মিসেস লোকমান মা বাবার ১ম সন্তান ছিলেন। স্যারের ৪ কন্যা ও ওমর ফারুখ ১ পুত্র সন্তান।বড় মেয়ে বাবা মায়ের আগে মারা গেছেন।তার নাম নিগার সুলতানা, তিনি ইংরেজি সাহিত্যে এম.এ পাশ।পিতার গবেষণা কর্ম, লিখালিখি ও পুস্তক প্রকাশে তিনি সবসময় সহযোগিতা করতেন মর্মে তাঁর বইতে তিনি উল্লেখ করেন। স্যারের ২য় সন্তান মিসেস মিনার সুলতানা (শিলা) একাউন্টিংএ মাস্টার্স, তিনি খুলশি ফয়েজ লেকস্থ চট্টগ্রাম ডায়াবেটিস হাসপাতালের কর্মরত সিনিয়র কর্মকর্তা।মরহুম লোকমান স্যার অবসরে পীর আউলিয়াদের সঠিক জীবন কাহিনি লিখে তা পুস্তক আকারে প্রচার করতেন। আমি স্যারের সহযগিতার জন্য একসাথে অনেকগুলো বই কিনে নিয়ে তা বন্ধুদের মাঝে বিলি করতাম, হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি (র) এর জীবনী সহ তিনি বহু গ্রন্থের রচয়িতা ও প্রণেতা।
তাঁর রচিত অন্যান্য বই গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, হযরত আবুল বারাকাত বদর উদ্দিন শায়খ আহাম্মদ ছেরহেন্দী মুজাদ্দেদে আলফে ছানী (রহঃ), হোসাইন ইবনে মনছুর ইবনে মাহামা আল্লামা মনছুর হাল্লাজ, হযরত মাওলানা হুছাইনুজ্জামান (রাঃ), তোহফায়ে রমযান, প্রভৃতি। সারাটা জীবন তিনি জ্ঞান চর্চা ও জ্ঞান বিতরণে জীবন অতিবাহিত করেন।স্কুলের প্রায় প্রতিটি অনুষ্ঠানে এবং শ্রেণীকক্ষে তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের সৎ উপদেশ দিতেন। চরিত্র গঠনের মূল মন্ত্র গুলো শিখিয়ে দিতেন। দোয়া পরিচালনা করতেন। তিনি অত্যন্ত প্রচার বিমুখ এবং নিরহংকারী মানুষ ছিলেন। তাঁকে মৃত্যুর পর জানাজা শেষে হযরত মোল্লা মিসকিনশাহ্ (রঃ) মাজার মসজিদ সংলগ্ন কবরস্থানে দাফন করা হয়।
তাঁর সহধর্মীনি ও ঐ কবরস্থানে ঘুমিয়ে আছেন, যেখানে আমার মা-বাবা সহ বন্ধু-আত্নীয় পরিজন ঘুমিয়ে আছেন।মহান প্রভূ দয়াময় রহমান রহিমের কাছে আকুল আবেদন আমাদের এ প্রিয় শিক্ষক ও বুজুর্গ ওস্তাদকে তাঁর নেক আমল সমূহ কবুল করে তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌসের চিরস্থায়ী বাসিন্দা করে দিন আমিন।
লেখক - আইনবিদ, কলামিস্ট, মানবাধিকার ও সুশাসন কর্মী ।
সম্পাদক ও প্রকাশক: রফিকুল ইসলাম
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-১৩১০