অ্যাডভোকেট মো. সাইফুদ্দীন খালেদ
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণজনিত কারণে দেশের মানুষ বিভিন্ন সংকটের মুখোমুখি। মানুষজন রয়েছে দুর্ভোগে! এই দুর্ভোগ আরো বাড়তে পারে যদি দ্রব্যমূল্যের দাম অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে। একটি পরিবার কীভাবে তাদের দৈনন্দিন জীবনকে নির্বাহ করবে তা নির্ভর করে তাদের আয়, চাহিদা এবং দ্রব্যমূল্যের ওপর। দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে জীবনযাত্রার সর্ম্পক অত্যন্ত নিবিড়। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ আর তা রুখতে দীর্ঘদিন ধরেই লকডাউন জারি থাকায় আর্থিক ভাবে সমস্যার মুখে পড়ে দেশের বহু মানুষ। অনেকেই কাজ হারিয়েছেন। আবার অনেকেরই আয় আগের তুলনায় কমেছে। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে চোখ রাঙাচ্ছে বাজার পরিস্থিতি। এদিকে যোগান কম, চাহিদা বেশি অন্যদিকে লকডাউন হয়েছে। ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী এবং শাকসবজির দাম বৃদ্ধি পেয়েছে অনেকটাই। মার্চের শুরুর দিকে পেঁয়াজ এর দাম কিছুটা আয়ত্তের মধ্যে আসলেও, লকডাউনের পর থেকেই পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে খেটে খাওয়া মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা এমনিতেই থমকে দাঁড়িয়েছে, তার ওপর নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আরও বেড়ে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনে নেমে আসে দুর্বিষহ অন্ধকার। দব্যমূল্য বৃদ্ধির কিছু কারন রয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুদামজাত করে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে এবং পরে অধিক হারে মুনাফা লুটে নেয়। তাদের মূল লক্ষ্য হলো ব্যবসা। অবৈধ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে তারা সাধারণ মানুষকে অবর্ণনীয় কষ্ট দেয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম জনগণের নাগালের মধ্যে অর্থাৎ সহনীয় পর্যায়ে রাখতে সরকারকে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের মূল্য যখন সহনীয় পর্যায়ে এবং সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে, তখন তাদের জীবন কাটে স্বস্থিতে। অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য যখন সাধারণ মানুষের আর্থিক সংগতির সঙ্গে অসামঞ্জস্যর্পূণ হয়ে যায়, তখন দরিদ্র এবং অতিদরিদ্র পরিবারে শুরু হয় অশান্তি। তাই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে একদিকে জনজীবনে নেমে আসে কষ্টের কালো ছায়া। খাদ্যদ্রব্য, চাল, ডাল, তেল, লবণ, মরিচ, পেঁয়াজ, রসুন, মাছ, তরকারি, চিনি, দুধ ইত্যাদি নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি জনজীবনের গতিকে অচল ও আড়ষ্ট করে তুলে। সম্প্রতি পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধির পর আলুর দামের হার আশঙ্কাজনক পর্যায়ে উপনীত হওয়ায় তা যেন আলোচিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। পেঁয়াজের দামের উল্লস্ফনতো রয়েছে। খুচরা বাজারে কোথাও প্রতি কেজি ৮০-৮৫ টাকা পর্যন্ত বিক্রয় করা হচ্ছে। দুই তিন মাস আগে পেঁয়াজের দাম ছিল ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। আগস্টের মাঝামাঝিতে পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি শুরু হয়। ভারত বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ ঘোষণার পরই রাত পর্যন্ত ক্রমাগত দাম বেড়ে বিক্রি হয়। অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্য বৃদ্ধি ও মজুদে ঘাটতির কারণে গত বছর সেপ্টেম্বরেই প্রথমে পেঁয়াজের রপ্তানি মূল্য বৃদ্ধি এবং পরে রপ্তানি বন্ধ করেছিল ভারত। এরপর বাংলাদেশের বাজারে হু হু করে বাড়তে থাকে পেঁয়াজের দাম, শেষ পর্যন্ত কেজি প্রতি ২৫০-৩০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রয় হয়েছিল। ভারতীয় কৃষিপণ্যের মূল্য নির্ধারণকারী সংস্থা ‘ন্যাপেড’ হঠাৎ করে প্রতি মেট্রিক টন পেঁয়াজের রফতানি মূল্য বাড়িয়ে ৭৫০ মার্কিন ডলার নির্ধারণ করে দিলে বাংলাদেশে পেঁয়াজের রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। আগে প্রতি মেট্রিক টন ৩৫০ মার্কিন ডলারে রপ্তানি করলেও পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই এ বছর ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে তা ৭৫০ মার্কিন ডলারে আমদানি করতে হবে বলে জানায়। আর এদিকে বাংলাদেশও গতবারের পরিস্থিতি থেকে অভিজ্ঞতা নেয়নি। এতে সুযোগ নেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। অপরদিকে ব্যবসায়ীরা সীমান্তের সিন্ডিকেটকে দোষারূপ করছেন। দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিক্রিও বহুগুণ বেড়েছে। এখন শুরু হল আলু নিয়ে তুঘলকি কা-। আলুর বর্তমান দাম প্রতি কেজি ৫৫-৬০ টাকা। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি দেশের অন্যতম সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ন্যায়সঙ্গত মূল্য বলতে বর্তমানে কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্র পাওয়া যায় না। অতীতের সেই কথাগুলো আজ আমাদের কাছে রূপকথার মতো মনে হয়। যেমন- শায়েস্তা খাঁর আমলে টাকায় আট মন চাল পাওয়া যেত। এখন আর সে মূল্য আশা করা যায় না। এক সের লবণ এক পয়সা, এক পয়সার এক সের দুধ, দু আনায় এক সের তেল, একটি লুঙ্গি এক টাকা এবং একটি সুতি শাড়ি দু টাকা- তা খুব বেশি দিনের কথা না হলেও এটা কেউ এখন আর আশা করে না। ব্রিটিশ শাসনামলেও আমাদের দেশে দ্রব্যমূল্য একটা নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় ছিল। বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঘোড়া জনগণকে হতাশার রাজ্যে নিয়ে যাচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের পাশাপাশি বাড়ছে বাসাভাড়া, পরিবহন-ভাড়া, চিকিৎসা ও শিক্ষা খাতের ব্যয়। সরকারি-বেসরকারি সেবার দামও বাড়ছে। সেই অনুপাতে বাড়ছে না মানুষের আয়। ফলে জীবনযাত্রার মানেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বাজার অস্থিতিশীল হওয়া মানেই দেশের বেশির ভাগ মানুষের ওপর চাপ পড়া। দ্রব্যমূল্য বাজারে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় চাহিদা ও জোগানের আলোকে নির্ধারিত হবে। তবে বাজার প্রক্রিয়াকে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যেন ব্যাহত করতে না পারে, সে জন্য সরকার তদারকি ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে পারবে। পাশাপাশি কর্মসংস্থানও বাড়াতে হবে। তখন উৎপাদন বাড়বে, বাড়বে ক্রয়ক্ষমতা। আয় বাড়লে মূল্যস্ফীতির আঘাতও হয় সহনীয়। কালোবাজারি, মুনাফাখোর, মজুদদার প্রভৃতির কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় ও অপরিহার্য দ্রব্যগুলোর মূল্যবৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিদিন এবং ক্রমে এসব পণ্য সংগ্রহ করা কঠিনতর হচ্ছে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য। জনজীবন বিপর্যস্ত, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি বুভুক্ষু মানুষকে অর্ধাহার ও অনাহারে দিন কাটাতে বাধ্য করছে। মানুষের একটু ভালোভাবে বাঁচার দাবি আজ সর্বত্র। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি তাদের প্রতিকূলে। সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার সীমাকে অতিক্রম করে অশ্বগতিতে বেড়ে চলছে ব্যয়ের খাত। এরূপ হারে পানির বিল, জ্বালানি তেলের মূল্য ও দ্রব্যমূল্যের অতিরিক্ত খরচ জনগণের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। আর নি¤œবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণীই মূল্যের এরূপ বৃদ্ধিতে অসহায় ও নিরূপায় হয়ে পড়েছেন। অথচ তারাই মূল্যবোধ দিয়ে সমাজকে ধরে রাখেন; তারাই গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের মূল শক্তি হিসেবে কাজ করেন। জনগণ আশা করছেন তাদের এরূপ অবস্থার উন্নতি হবে, দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসের মূল্য কমবে। কিন্তু তাদের সে স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাচ্ছে। বাজারের ওপর সরকার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে কি ব্যর্থ হচ্ছে- বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এমন প্রশ্ন দাঁড়ায়। অসাধু ব্যবসায়ীরা যাতে বাজারে যাচ্ছেতাই কা-কীর্তি চালাতে না পারে, এ জন্য টিসিবিকে শক্তিশালী করার তাগিদ ইতিমধ্যে বহুবার নানা মহল থেকে এসেছে। কিন্তু এ ব্যাপারে আশানুরূপ উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। শুধু যে পণ্যদ্রব্যের দামই বেড়েছে তাই নয়, বেড়েছে বিদ্যুতের দাম, পরিবহন ব্যয়, বাসা ভাড়া। অর্থনীতির সূত্রমতে, উৎপাদন ব্যয় ছাড়াও জিনিসপত্রের দাম বাজারে চাহিদা-জোগানের ভারসাম্যের ওপর নির্ভর করে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মূলে বহুবিধ কারণ রয়েছে- স্বার্থপরতা, অসাধু সমাজবিরোধী তৎপরতা, অর্থলোভী মানুষের অমানবিক আচরণ। তাছাড়া প্রাকৃতিক কারণে অর্থাৎ অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টির কারণে জমিতে আশানুরূপ ফসল উৎপাদিত না হলে দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়ে যায়। আবার কৃষি ও শিল্প কারখানাগুলোর উৎপাদনে সীমাবদ্ধতা এবং বিদেশী মুদ্রার অভাবে পণ্যদ্রব্য চাহিদা পরিমাণ আমদানি করা সম্ভব না হলে চোরাকারবারি, মজুদদারি ও দুর্নীতিপরায়ণ ব্যবসায়ীরা এর সুযোগ গ্রহণ করে। তারা জিনিসের কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করে, ফলে দ্রব্যের মূল্য অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পায়। পণ্যমূল্য নির্ধারণে যুগোপযোগি আইন প্রণয়ন ও তা প্রয়োগের ব্যবস্থা নিতে হবে। এ আইনের আওতায় দ্রব্যমূলের মূল্য নির্ধারণ, চোরাকারবারি প্রতিরোধ, ফড়িয়া ও অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য হ্রাস, দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি ব্যবস্থা গ্রহণ করে এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যেতে পারে। সরকারের খাদ্য মন্ত্রণালয় অথবা পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় এ পদক্ষেপ নিতে পারে। টিসিবিকে আরো শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে হবে। নিয়ম বহির্ভূতভাবে কেউ কেনাবেচা করলে তর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যতালিকা টাঙানো এবং নির্ধারিত মূল্যে পণ্য বিক্রয় করা হচ্ছে কি না, সেটি পর্যবেক্ষণের জন্য সব বাজারে দ্রব্যমূল্য মনিটরিং কমিটি গঠনের ব্যবস্থা করতে হবে। অবশেষে বলবো ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসন এর আন্তরিক প্রচেষ্টা এবং জনগণের সার্বিক সহযোগিতায় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হলে দেশের মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে। বাংলাদেশ কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যে ভবিষ্যতে আরো উন্নত ও সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে- এ বিশ্বাস আমাদের সকলের।
লেখক ঃ আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
সম্পাদক ও প্রকাশক: রফিকুল ইসলাম
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-১৩১০