-হিফজুর রহমান চৌধুরী
অরবি প্রভাষক,দারুন্নাজাত সিদ্দীকিয়া কামিল মাদরাসা
১৪৪৪ হিজরী। একটি নতুন হিজরী বর্ষের সূচনা। হিজরী বর্ষের সূচনা ও সমাপ্তি দুটোই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও গুরুত্ববহ। যিলহজ মাসের সমাপ্তির মধ্য দিয়েই হিজরী বর্ষের ইতি হয় আর সূচনা হয় মহররম মাসের পবিত্র ও শুভ সূচনার মাধ্যমে।যিলহজয মাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাবান দুটি ইবাদত হজ্ব ও কুরবানী আদায় করা হয়।আর মহররম মাস কুরআনের ভাষায় “আরবাআতুন হুরুম" তথা চার সম্মানিত মাসের অন্যতম।এ হিসেবে হিজরী বর্ষ সূচনা ও সমাপ্তি উভয় দিক থেকেই অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ, মহিমান্বিত ও তাৎপর্যবহ।যদিও তা একটি নতুন হিজরী বর্ষের সূচনা। তবে তা এসেছে পরিসমাপ্তির পথ বেয়ে। তাই এটি বিগত সময়ের মুহাসাবা ও সামনের জন্য নতুন সংকল্পে উজ্জীবিত হওয়ার সময়। অতীতের যে সময়টুকু আল্লাহ তাআলা মর্জি মোতাবেক অতিবাহিত করার তাওফীক হয়েছে তার জন্য কৃতজ্ঞতা আর যা গাফলত-উদাসীনতা ও আল্লাহর নাফরমানীতে বরবাদ হয়েছে তার জন্য অনুশোচনা এবং তাওবা-ইস্তেগফার করা। এটাই হল মুমিনের করণীয়। তবে মুমিনের আত্মপর্যালোচনা শুধু বর্ষকেন্দ্রিক, মাস বা সপ্তাহকেন্দ্রিক নয়। বরং মুমিন প্রতিদিন তার কর্মের হিসাব গ্রহণ করে এবং গতকালের চেয়ে আগামীকালকে অধিক ফলপ্রসূ করার চেষ্টা করে।নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,"সকল মানুষই প্রতি ভোরেই আমলের বিনিময়ে নিজেকে বিক্রি করে। হয় তার আমল দ্বারা আল্লাহর কাছে বিক্রিত হয়ে জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করে। নতুবা শয়তানের কাছে বিক্রিত হয়ে নিজেকে ধ্বংস করে"।সহীহ মুসলিম, হাদিস:৪২২, সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদিস: ৮৪৪।
আর বিশিষ্ট সাহাবি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলতেন, তুমি সন্ধ্যায় উপনীত হলে আর ভোরের অপেক্ষা করো না এবং ভোরে উপনীত হলে সন্ধ্যার অপেক্ষা করো না (বরং এখন থেকেই নেক আমলে পূর্ণ আত্মনিয়োগ কর)। তোমার সুস্থতার অবস্থায় তোমার পীড়িত অবস্থার জন্য কিছু সঞ্চয় কর এবং জীবিত অবস্থায় তোমার মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ কর।
সহীহুল বুখারী, হাদিস: ৬৪১৬,জামে তিরমিযী, হাদিস:২৩৩৩।
হিজরী বর্ষের প্রথম মাস মুহাররম। এ মাসের নামোচ্চারণের সাথে সাথে বাঙালী মুসলিমের মনে পড়ে যায় বিদ্রোহী কবির সেই অমর পংক্তি ত্যাগ চাই, মর্সিয়া-ক্রন্দন চাহি না।’ তার এ পংক্তিতে ব্যাক্ত হয়েছে ইসলামের অতি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। আর তা হচ্ছে, দুঃখ-কষ্ট-প্রতিকূলতায় -, ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে পরিস্থিতি মোকাবেলার চেষ্টা করাই কাম্য। আমাদের ব্যক্তিগত, পেশাগত ও দাওয়াতী জীবনের নানা প্রতিকুলতা, উম্মাহর বিভিন্ন শ্রেণির ধর্মীয় ও নৈতিক স্খলন, আর্থ-সামাজিক সঙ্কট, বিশ্বজুড়ে মুসলিম উম্মাহর নানামুখী বিপর্যস্ততা ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই এই কথা সত্য। মর্সিয়া-ক্রন্দনে সঙ্কট থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়; বরং তা ক্ষেত্রবিশেষে সঙ্কট মোচনের পথে বাধা ও প্রতিবন্ধকও বটে। শিয়া-সম্প্রদায়ের মাঝে মুহাররম মাস-কেন্দ্রিক যেসকল অনৈসলামিক আনুষ্ঠানিকতা আছে তার সিংহভাগই মাতম- মর্সিয়া।
আমরা যদি ইসলামী আদর্শ ও আমাদের চারপাশের চাহিদা ও প্রয়োজনকে সামনে নিয়ে নিজেকে বিচার করি তাহলে নিজের অনেক অযোগ্যতা, অক্ষমতা ও অপূর্ণতা চোখে পড়বে। এইসব ত্রুটি দূর করার কিংবা অন্তত হ্রাস করার উপায় কী? এর উপায় মাতম-মর্সিয়া নয়, ত্যাগ ও কুরবানী। নিজেকে গড়ার পথে, ত্রুটি ও অসম্পূর্ণতাগুলো দূর করার পথে আমাদের ত্যাগ-তিতিক্ষার পথ অবলম্বন করতে হবে। আলস্য-উদাসীনতা, নির্লিপ্ততা-আরামপ্রিয়তা ছাড়তে হবে। নিজের সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং সঠিক পথে অক্লান্ত পরিশ্রমে আত্মনিয়োগ করতে হবে।
একই কথা ব্যক্তিজীবনের নানা অশান্তি, অস্থিরতা, দারিদ্র্য, রোগ-ব্যাধি ইত্যাদির ক্ষেত্রেও। এইসব অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় বিলাপ ও মাতম নয়, ধৈর্যের সাথে অবস্থা পরিবর্তনের যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাওয়া এবং চেতনা-বিশ্বাসে ও কর্ম-প্রচেষ্টায় ইসলামী শিক্ষার অনুশাসন মেনে চলা।
আমাদের সামাজিক জীবনের নানা অবক্ষয়-অসঙ্গতি, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অনৈক্য, বিভক্তি, হিংসা-বিদ্বেষ, স্বার্থপরতা, জুলুম-অবিচার, পরশ্রীকাতরতা, অন্যায়, অনাচার, অনৈতিকতা ইত্যাদি থেকে উত্তরণের উপায়ও মাতম-ক্রন্দন নয়; এর উপায় ব্যক্তিগত পরিশুদ্ধি, নীতি-নৈতিকতা র্চচা,নিজ নিজ পরিবার-পরিমণ্ডলে দাওয়াতী ও আত্মশুদ্ধির কর্মতৎপরতা, মানব সেবা, গণ-সংযোগ, গণমুখী দাওয়াতী কার্যক্রম, দাওয়াতের সম্ভাব্য সকল প্রকারের উপায়-উপকরণের যথার্থ ব্যবহার। এককথায় ব্যক্তি থেকে পরিবার এবং প্রতিষ্ঠান থেকে সমাজ সর্বত্র সঠিক উপায়ে দাওয়াতী ও আত্মশুদ্ধি কার্যক্রমের এক ইস্পাত-কঠিন সংকল্প গ্রহণ। অভিযোগ-অনুযোগ এবং মাতম-বিলাপের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশে দেশে মুসলিম উম্মাহর নানা বিপদ-বিপর্যয়, মুসলিম নেতৃবর্গের অবক্ষয়-অধঃপতন, যুব-সমাজের চেতনা-বিশ্বাস ও স্বভাব-চরিত্রগত বিপথগামিতা, মুসলিম জনতার সিংহভাগের ধর্ম-বিমুখিতা বা ধর্মীয় বিষয়ে নির্লিপ্ততা-অনাগ্রহতা ইত্যাদি থেকে উত্তরণের উপায়ও মর্সিয়া-ক্রন্দনের আনুষ্ঠানিকতা নয়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের কী উপায়? যে কোনো সচেতন মুসলিমই বুঝবেন- এ প্রশ্নের উত্তর সহজ নয়, তবে হাঁ ইসলাম যেহেতু প্রত্যাশার দ্বীন, ইসলাম যেহেতু মানবীয় সাধ্যের উপর নয়, এই বিশ্বজাহানের সৃষ্টিকর্তার কুদরতের উপর আস্থা রাখতে শেখায়, তাই এ প্রশ্নের উত্তর এই যে, উত্তরণের উপায় আছে। আর তা হচ্ছে আল্লাহর উপর ভরসা রেখে নিজ নিজ পরিমণ্ডলে আল্লাহর হুকুম মোতাবেক কাজ করে যাওয়া। যে প্রজন্ম গেছে তা তো গেছেই, আগামী প্রজন্মের দ্বীন-ঈমান সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করা, সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে আল্লাহমুখিতা ও আখিরাতমুখিতা তৈরির সাধনায় আত্মনিয়োগ করা, গণমানুষের চেতনা-বিশ্বাসে, হৃদয় ও মস্তিষ্কে, কর্ম ও জীবনাচারে ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠার সর্বব্যাপী মেহনতে জীবনকে ওয়াকফ করা। মুসলিম-অমুসলিম উভয় শ্রেণির কাছে ইসলামের সুমহান আদর্শের বাস্তব নমুনা প্রোজ্জ্বলভাবে তুলে ধরা।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এ কথাগুলো বলা যত সহজ কার্যে পরিণত করা তত সহজ নয়। তবে যদি আল্লাহর মদদ ও নুসরত হয় তাহলে কোনো কঠিনই কঠিন নয়। সেই মদদ ও নুসরতের উপায় মর্সিয়া-মাতম নয়, ত্যাগ, কুরবানী ও মুজাহাদা।
বিশেষভাবে আল্লাহ তাআলা নতুন বছরে নতুন প্রত্যয় ও পূর্ণ উদ্যমে ঈমান-আমলের পথে এগিয়ে যাবার তাওফীক দান করুন। আমাদের ঈমান-আমল, কর্ম-আচরণ, স্বভাব-চরিত্রসহ জীবনের সকল অঙ্গনে উৎকর্ষ আসুক। এই পণ নিয়ে শুরু হোক আমাদের আগামীর পথচলা। আল্লাহ তাআলা সকলকে সেই তাওফীক দান করুন- আমীন।
সম্পাদক ও প্রকাশক: রফিকুল ইসলাম
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-১৩১০