-----জিয়া হাবীব আহ্সান, এডভোকেট
মেজবান জেয়াফত অনুষ্ঠান এর সামাজিক এবং ধর্মীয় গুরুত্ব বর্ণনা করে শেষ করা যায় না।আমার মরহুম বাপ-চাচারা, দাদী, মা যতোদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন প্রতিবছর শীতের সময় মেজবান ও ময় মুরুব্বিদের রুহের মাগফেরাত কামনায় দোয়ার মাহফিল জেয়াফত ইত্যাদি আয়োজন করতেন। আল্লাহর উদ্দেশ্যে পশু জবাই করে দোয়া দরূদ ফাতিহা পাঠ করে মুনাজাত করে আল্লাহ্র রহমত ও সন্তুষ্টি কামনা করে গরীব-এতিম মিসকিন, পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজনদের খাওয়ানো হতো।দূরদূরান্ত থেকে লোকজন কষ্ট করে অংশ নিতেন এবং এতে সকলের সাথে দেখা হতো, আত্মীয়তার বন্ধন সুদৃঢ় হতো।অনেক পুরোনো আত্মীয়-স্বজন এমন কি বাপ-দাদার নানারবাড়ী, শ্বশুরবাড়ীর আত্মীয়-স্বজনদেরও মিলন মেলা হতো।এ-উপলক্ষ্যে গ্রামের বাড়ীতে ফুফু খালারাও নাইর করতেন।মনে পড়ে বাড়ীতে কয়েক হাজার বর্তন, বাটি, বাসন সহ ডেক ডেকচি ছিল।মেজবান বিয়ে শাদীতে সবাই এগুলো ব্যবহার করতে নিয়ে যেত। সবাই সামাজিকভাবে এতে স্বেচ্ছায় অনুষ্ঠান বাস্তবায়নে সহায়তা দিত। চিলুম্চি বদনা দিয়ে মেহমানদের হাত ধোয়ানো হতো।লম্বা ছতরনজি বিছিয়ে এক কাতারে ধনী-দরিদ্র মাটিতে বসে খাওয়া হতো।পরে তা চেয়ার-টেবিল ডেকোরেশন ও বয় বাবুর্চিরা দখল করে। এখন সেই আনন্দের অনুভূতি আমেজ আর নেই।নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা জানেনা কারা তাদের আত্মীয়-স্বজন।একসময় আম্মা-আব্বারা তাদের মা-বাবার আত্মীয়-স্বজনদের যেভাবে খবর নিতেন আজকাল আমরা ঘনিষ্ঠ রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়-স্বজনদের ও খবর নিই না।কোন মানুষ মারা গেলে আত্মীয়-স্বজনরা রান্না করে মৃত ব্যাক্তির আত্মীয়-স্বজনদের জন্য নিয়ে আসতেন।শোক কেটে উঠলে মৃত ব্যাক্তির আত্মীয়-স্বজন যেসব আত্মীয়-স্বজন খোঁজ খবর নিয়েছেন বা সংগত কারনে নিতে পারেননি, যাঁরা দাফন কাফনে সাহায্য করেছেন, এতিম-মিসকিন, পাড়া-প্রতিবেশী সকলকে নিয়ে দোয়া দরুদ মাহফিল, কোরানখানী, কবর জিয়ারত ও আপ্যায়নের ব্যবস্থা করাতেন।আল্লাহ্র উদ্দেশ্যে পশু কুরবানির মধ্য দিয়ে মেজবান জেয়াফতের আয়োজন করতেন।এটা মৃত ব্যাক্তির উদ্দেশ্যে নয় (নাউজুবিল্লাহ) সম্পূর্ণ আল্লাহ্র উদ্দেশ্যে জবাই হতো।এধরনের অতিথি আপ্যায়ন মেজবান আমাদের ঐতিহাসিক ঐতিহ্য মণ্ডিত সংস্কৃতির অংশ।এর সামাজিক ও ধর্মীয় গুরুত্ব অপরিসীম।যদিও চারদিন্না, ফলাহার, মাছফইত্যা, চাল্লিশা ইত্যাদি মুসলিম বা ইসলামী সংস্কৃতির অংশ নয়।আল্লাহ্ তাআলা নিয়তের মালিক।তিনি নিয়তটাকেই পরীক্ষা করেন।মেজবান ও জেয়াফত যেন লোক দেখানো না হয়।নিয়ত পরিচ্ছন্ন হওয়া দরকার।মৃত ব্যক্তির ঋণ শোধ করা, সামর্থ থাকা সত্বেও হজ্জব্রত পালনে ব্যর্থ হলে তাঁর বদলী হজ্জের ব্যবস্থা করা, মৃত ব্যক্তির অছিয়ত পালন করা অত্যন্ত জরুরি।হাদীস শরীফে আছে মৃত্যু বরণকারীর আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু বান্ধবদেরও খবর নিতে।মহানবী হযরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভালো খাবার-দাবার উপহার হাদীয়া পেলে তা বিবি খাদীজার বান্ধবীর জন্যেও পাঠাতেন।ধার-কর্য করে জেয়াফত অনুষ্ঠান করা হাস্যকর।জেয়াফতে অভুক্ত গরীব-এতিম মিসকিনদের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি দিতে হবে।তারপর মুসাফির, আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীর হক।বহু ওয়াকফ্ দলিল ও অছিয়তনামা পাঠে দেখা যার বহু ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা তাঁদের উত্তরাধিকার ওয়ারিশদের অছিয়ত করে যান ময় মুরুব্বিদের রুহের মাগফিরাত কামনায় প্রতি বছর জেয়াফত ও দান খয়রাত জারী রাখার জন্যে। জেয়াফত ও মেজবানের সামাজিক গুরুত্ব নিয়ে বিশিষ্ট চিন্তাবিদ লেখক ও গবেষক মাহমুদুল হক আনসারী লিখেছেন: জেয়াফত মেজবানী সমাজে দুটিরই প্রচলন আছে।মৃতব্যক্তির আত্মার শান্তি কামনায় জেয়াফত আর মেজবানীর আয়োজন হয়ে থাকে।সামর্থবান মানুষ যখন ইহজীবন ত্যাগ করে পরপারে চলে যান, তখন তার উপর ইসলামের ভাষায় পূণ্য পৌঁছানোর নাম-ই হলো জেয়াফত।আর আয়োজনের নাম মেজবান।জেয়াফত অর্থ ছাওয়াব আর পূণ্য প্রেরণের ব্যবস্থা করা।দুনিয়ার শুরু থেকে সামর্থবান, অর্থবিত্তের অধিকারী সমাজ তাদের পূর্ব পুরুষদের ছাওয়াবের উদ্দেশ্যে এসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে।জেয়াফত কিংবা মেজবানী দিয়ে গরীব, দুস্থ, এতিম, মিসকিন সম্বলহীন অসহায় মানুষকে খাওয়নোর মাধ্যমে পূণ্য অর্জনের কথা ইসলামে বলা হয়েছে।পবিত্র কোরআনুল কারীম এবং হাদীস পাকের অনেক স্থানে মানুষদের খাইতে দেয়া ও মেহমানদারির কথা বলা হয়েছে।কোনো কোনো স্থানে এ অভ্যাসকে উত্তম অভ্যাস হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।মানব সেবায় অন্য সকল কাজের মধ্যে অভুক্ত মানুষদের খাবার পরিবেশন একটি অতি উত্তম সেবা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশেষভাবে জেয়াফত আর মেজবানীতে গরীব, অসহায়, এতিম, মিসকিন অসামর্থ শ্রেণির মানুষদের খাবার খাওয়ানোর উপর গুরুত্ব বেশী দেয়া হয়েছে।জেয়াফত আর মেজবানী খাবার ব্যবস্থায় ওই শ্রেণির মানুষগুলোর অধিকার থাকে বেশী।তাদের সাথে সামর্থবান আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব অন্য সকল পেশা ও শ্রেণির মানুষদের খাবারের এন্তেজাম করা যেতে পারে।যারাই জেয়াফত আর মেজবানী আয়োজন করবেন তাদের উচিৎ প্রথমেই অভুক্ত মিসকিনদের মেহমানদারি করা।সামর্থ থাকলে আত্মীয়-স্বজন অন্য বন্ধু-বান্ধবদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা ভালো কাজ।জেয়াফত আর মেজবানী যাই করা হউক না কেনো সবগুলো কর্মসূচী যেনো সু-শৃংখলভাবে করা হয়।কোনো মেহমানকে দাওয়াত দিয়ে অসম্মান করা ইজ্জত না দেয়া উপযুক্ত পরিবেশ বজায় রেখে খাবারের ব্যবস্থা না করা দুষনীয় পর্যায়ে পড়ে।এ ক্ষেত্রে যে পূন্য অর্জনের জন্য এসব কর্মসূচী পালন করা হয় তার ছাওয়াব পাওয়াতো দূরে থাক বরং মেহমানদের ঠিক মতো সেবা আপ্যায়ন না হলে উল্টো আয়োজকদের উপর আজাবের মাত্রা ভারী হবে।বর্তমান সমাজে প্রচলিত মেজবান আর জেয়াফত কোন ক্যাটাগরিতে পড়ে সেটা আমি বলতে চাই।এমনও দেখা যায় মেজবান আর জেয়াফতের নামে যে সব খাবার ও দাওয়াতের ব্যবস্থা করা হয় সেখানে দুস্থ, অনাথ, এতীম, গরীব মানুষদের সংখ্যা খুবই কম।বেশীর ভাগ আয়োজকগন মেহমানদারিতে সামর্থবান মানুষের মধ্যে জেয়াফতের খাবার খাওয়ানোর দৃশ্য দেখা যায়।গরীব মানুষগুলো কখন মেজবান আর জেয়াফত হবে তাকিয়ে থাকে।ভালো খাবার তাদের ভাগ্যে তেমন জুটেনা, তাই তারা এ ধরনের আয়োজনের সংবাদ পেলে দৌঁড়ে ছোটা-ছুটি করতে দেখা যায়।এটা তাদের জন্য প্রাপ্য ও অধিকার।ধনীদের সম্পদ ও অর্থে ঐসব মানুষের অধিকার আছে যারা মিসকিন ও অসহায় এতিম।সে অধিকার ধর্মের দিক দিয়ে বলেন অথবা সামাজিক দৃষ্টিকোনে বলেন, প্রজা না থাকলে রাজার কোনো প্রয়োজন হয়না।গরীব মানুষ না থাকলে ধনী মানুষের সম্মান আর ইজ্জত থাকেনা।এসব চিন্তা করলে সব পর্যায়ের মানুষ ও পেশা নিয়ে সমাজ। জেয়াফত আর মেজবান সামাজিক অনুষ্ঠান। এসব অনুষ্ঠান যখন হয়, তখন দুর্বল মানুষগুলো একবেলা খাবার খেতে দৌঁড়াতে থাকে।এরপর গিয়ে যখন দেখে সেখানে তাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা নেই।তাদের খাবার সামর্থবান মানুষগুলো গিলে ফেলছে।আয়োজকগন পরিস্কার পরিস্কার মানুষদের আমন্ত্রণ করে টেবিল সাজিয়ে রেখেছে, তখন ওই ভুবুক্ষ মানুষগুলো খুবই কষ্ট পায়। ক্ষুধার যন্ত্রনা তারা ধরে রাখতে পারেনা।তাদের অন্তরের ফরিয়াদ আরশ পর্যন্ত পৌঁছে যায়।বর্তমান সমাজে জেয়াফত আর মেজবানীর আয়োজনে এমন ধরনের অনুষ্ঠান বেশী হচ্ছে। এ ধরনের অভ্যাস হতে সমাজকে বিরত থাকা দরকার।খাবারের জন্য যারাই উপযুক্ত তাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মেহমানদারি করা দরকার।আয়োজকগন তাদের ব্যবস্থাপনায় এ ধরনের চিন্তা মাথায় রেখে কাজ করলে সব ধরনের মানুষ সুশৃংখলভাবে জেয়াফত ও মেজবানীর খাবার গ্রহণ করতে পরে।আয়োজকগন যদি রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন, তাহলে সেখানে এ অনুষ্ঠানগুলো রাজনৈতিক কর্মীদের ভোজনে পরিণত হয়।যদিও বা মেজবান জেয়াফত নাম করণ করা হয়, সেখানে এ খাবারের জন্য যারাই উপযুক্ত তারা এসব খাবারের কাছে কিনারায় পৌছাঁতে পারেনা।ফলে মেজবান আর জেয়াফতের আসল উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য গুরুত্ব এসব আয়োজনে নেই বল্লেই চলে।এসব অনুষ্ঠানের মূল টার্গেটে গিয়ে আমাদের অনুষ্ঠানগুলো বাস্তবায়ন হলে তাহলে কোনো ধরনের শৃংখলা নষ্ট হবে বলে মনে হয়না।জেয়াফত আর মেজবানী সমাজের দুস্থ অনাথ শ্রেণীর মানুষের জন্য যেনো থাকে, সে দিকে সামর্থবানদের দৃষ্টি থাকা দরকার।এসব অনুষ্ঠানে যারাই মেহমান হবেন, যারাই অংশ নিবেন তারা আয়োজকদের অতীব গুরুত্বপূর্ণ মেহমান।তাদের ইজ্জত, সম্মান আদর আপ্যায়ন গুরুত্ব সহকারে থাকা চাই।কোনো অবস্থায় মেহমানদারির মধ্যে ত্রুটি গ্রহণযোগ্য নয়।সমস্ত অনুষ্ঠান সামর্থের মধ্যে করা চাই।সামর্থ না থাকলে এসব অনুষ্ঠান করতে বলা হয় নাই।পূন্যের জন্য এসব আয়োজন হওয়া চাই।লোক ও সমাজ দেখানোর উদ্দেশ্যে হলে তার আসল উদ্দেশ্য পাওয়া যাবেনা।এসব অনুষ্ঠান অবশ্যই পরিচ্ছন্ন অর্থ দিয়ে করা বাঞ্চনীয়।তাহলেই পূর্ণভাবে এর প্রতিদান সৃষ্টিকর্তা প্রদান করবেন।সমস্ত ভালো কর্ম নিয়তের উপর নির্ভরশীল।নিয়ত বিশুদ্ধ না হলে উদ্দেশ্য সফল হবেনা।লোক দেখানো কর্ম ও অনুষ্ঠান না করে প্রকৃতভাবে আল্লাহ্র সন্তুষ্টি ও মানব কল্যানে করা হলে সেখানে শৃংখলা ও প্রতিদান থাকে।সচেতন মহল ও সমাজের উচিৎ মেজবান আর জেয়াফত যেনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যর বাইরে থাকে। তাহলেই সমস্ত বিশৃংখলা আর ক্ষমতার অহমিকা থাকবেনা। আসুন আমরা সকলেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে জেয়াফত আর মেজবানীর সঠিক উদ্দেশ্য উপলব্ধি করি।
মহানবী (সা.) এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য দুনিয়াতে মানুষকে খাদ্য দান করেছে, কেয়ামতের দিন তাকে খাদ্য দান করা হবে।যে আল্লাহ্কে খুশি করার জন্য মানুষকে পানি পান করিয়েছে, তাকে কেয়ামতের দিন পানি পান করানো হবে।(আবু দাউদ, হাদিস : ১৩৪৬)। মেজবান ও মেহমান এ দুটি ইসলামি পরিভাষা হঠাৎ করে সৃষ্টি হয়নি। মেজবানির বা জেয়াফতের সঠিক মর্মার্থ না বুঝে বা ইচ্ছাকৃতভাবে নানাভাবে এর ভুল ব্যাখ্যা করে অহেতুক মতানৈক্য সৃষ্টির অবকাশ নেই।
লেখক:আইনজীবী,কলামিস্ট, মানবাধিকার ও সুশাসন কর্মী ।
সম্পাদক ও প্রকাশক: রফিকুল ইসলাম
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-১৩১০