জি. এম সাইফুল ইসলাম
ভাসমান তরকারি বিক্রেতা মো. শাহজাহান (২৮) যখন কোভিড টিকা গ্রহণ করে বাসার পথ ধরেছে তখন তার চোখে-মুখে ভেসে উঠেছিল স্বস্তির আবেশ। এক ধরণের আত্মতৃপ্তি অনুভব করছে সে। নিজকে কিছুটা ভাগ্যবানও ভাবা শুরু করেছে। কেননা, সকাল থেকে দীর্ঘ সারিতে রোদ ছাঁয়ায় দাঁড়িয়ে অবশেষে টিকা নিতে পেরেছে। তাইতো তার চোখে মুখে খুশির আভা। একই অভিব্যক্তি ফুটে ওঠেছে ছুটা কাজের বুয়া জাহিদের মা’র মধ্যে। নাম একটা তার আছে। কিন্তু সে নাম এখন আর সচরাচর ব্যবহার হয় না। আট বছর বয়সী ছেলে জাহিদই এখন তার পরিচয়ের মাধ্যম। সে নামে ডেকেই কথা বলে তার খুশির মাত্রা বুঝা গেল। সু-শৃংখলভাবে লাইনে দাড়িয়ে সরকার প্রদত্ত বিনামূলে টিকা নিতে পেরে সে যারপরনাই আনন্দিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষাই খুজে পাচ্ছেনা। বার বার কথার খেই হারিয়ে ফেলছে।
এমনই সব খন্ড খন্ড চিত্র দেখা গেল আজ (২৬ ফেব্রæয়ারি) চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ সরকারি কলোনি উচ্চ বিদ্যালয়ের বালিকা শাখার অস্থায়ী কোভিড টিকা কেন্দ্রে। অসংখ্য নারী-পুরষকে দেখা গেছে সুন্দরভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে টিকার জন্য অপেক্ষা করতে।
নিবন্ধন ছাড়া টিকা দিতে পারার সুযোগ পাওয়ায় কেন্দ্রে কেন্দ্রে ব্যাপক সাড়া পড়েছে। কোথাও কোথাও খুব ভোরে টিকা গ্রহীতাগণ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে গেছেন। বাসার বয়োবৃদ্ধদের নিয়ে এসেছেন অনেকে। পুুরুষের তুলনায় নারী টিকা গ্রহীতাও ছিল পর্যাপ্ত। তাদেরও দীর্ঘ সারি দেখা গেছে। লাইনে দাঁড়িয়ে অনায়াসে পানও চিবিয়েছেন অনেকে। দিয়েছেন অন্যদের। হয়েছে সংসারের টুকটাক কথাবার্তা। অনেকে আবার এ সুযোগে দেখা সাক্ষাতের কাজটিও সেরেছেন। এ যেন এক প্রাণের উৎসব। স্বেচ্ছাসেবকগণ সর্বাত্বক সহযোগিতা করছেন তাদের।
সরকার ঘোষিত ১ কোটি মানুষকে গণটিকা দেওয়ার বিশেষ ক্যাম্পেইন এর অংশ হিসেবে ২৬ ফেব্রæয়ারি চট্টগ্রামের বিভিন্ন কেন্দ্রে গণটিকা সফলভাবে প্রদান করা হয়। সারাদেশে গণমানুষের ব্যাপক আগ্রহ ও সাড়া পেয়ে সরকার এ গণটিকা ক্যাম্পেইন আরো দু’ুদিন বৃদ্ধি করে। অর্থাৎ ২৭ ও ২৮ ফেব্রæয়ারিও গণটিকা দেওয়া হয়। তবে মূল গণটিকা ক্যাম্পেইন ২৬ তারিখেই সম্পন্ন হয়। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে শুরু হয় এ কার্যক্রম। চলেছে একটানা সন্ধ্যা পর্যন্ত।
চট্টগ্রামে প্রথম দিন টিকা প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত ছিল ৪ লাখ। সিটি কর্পোরেশন এলাকায় লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লক্ষ ৮৪ হাজার ৫ শত। প্রথম দিন ২৬ ফেব্রæয়ারি তারিখে মহানগরসহ চট্টগ্রাম জেলায় টিকা দেওয়া হয়েছে ৭ লাখ ৫৪ হাজার ২৯৪ ডোজ। এর মধ্যে মহানগরে ৩ লাখ ২৫ হাজার ও উপজেলায় ৪ লাখ ২৯ হাজার ২৯৪ ডোজ। উপজেলাগুলোতে বয়স ১২-১৭ বছরের টিকা গ্রহীতা ছিল ৩৪ হাজার ৮৭৪ জন। মোট টিকা গ্রহীতার সংখ্যা ছিল নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার দ্বিগুণ, কোথাও আড়াই গুণ।
নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডের প্রতিটি ওয়ার্ডে ৫টি অস্থায়ী কেন্দ্রে টিকা প্রদান করা হয়। প্রায় ১৫২ এর অধিক অস্থায়ী কেন্দ্রে দেওয়া হয়েছে টিকা। এছাড়া স্থায়ী কেন্দ্রগুলোতে টিকাদান অব্যাহত ছিল। এর বাইরে সিটি কর্পোরেশন এলাকায় অতিরিক্ত ২৫টি ভ্রাম্যমাণ দল কাজ করেছে। প্রতিটি দলে ৫ শত জনকে টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সিটি এলাকার গড়ে প্রতিটি ওয়ার্ডে ৪ হাজার ৫ শত টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বড় ওয়ার্ডগুলোতে এ সংখ্যা আরো বেশি। এছাড়া ১২টি কেন্দ্রে বুস্টার ডোজ প্রদান কার্যক্রম চলমান ছিল।
প্রতিটি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর, সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর, জোনাল মেডিকেল অফিসার, মেডিকেল অফিসার, ইপিআই কর্মসূচিতে নিযুক্ত সরকারি বেসরকারি স্বায়ত্তশাসিত এবং স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় সম্পৃক্ত সকল কর্মকর্তা, স্বাস্থ্য সহকারী, স্বাস্থ্যকর্মী, সিটি কর্পোরেশনে কর্মরত সংশ্লিষ্ট ইপিআই টেকনিশিয়ান, সুপারভাইজার, স্বাস্থ্য সহকারী, টিকাদান কর্মী, ও স্বাস্থ্যকর্মীগণ এ কাজে নিয়োজিত ছিলেন।
চট্টগ্রামের ১৪টি উপজেলায় প্রায় ৬ শতাধিক কেন্দ্রে সিভিল সার্জন কার্যালয়ের ব্যবস্থাপনায় গণটিকা কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা হয়েছে। ইউনিয়নের প্রতি ওয়ার্ডে পর্যাপ্ত পরিমাণ অস্থায়ী কেন্দ্রে টিকা দেওয়া হয়েছে। পৌরসভাগুলোর প্রতিটি ওয়ার্ডে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অস্থায়ী কেন্দ্র স্থাপন করে টিকা দেওয়া হয়। এছাড়া নির্ধারিত কেন্দ্রের বাইরে প্রতি উপজেলায় ৫টি এবং জেলায় ২০টি ভ্রাম্যমাণ দল টিকা কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। প্রতিটি দলের জন্য ইউনিয়ন ও পৌরসভায় ৩ শত জনকে টিকা প্রদান করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
প্রথম দিন ২৬ ফেব্রæয়ারি তারিখে চট্টগ্রামের ১৪ উপজেলার মধ্যে দক্ষিণ চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় ৯ ইউনিয়নে ২১ হাজার ৭৫৪ জন, আনোয়ারার ১১ ইউনিয়নে ২৪ হাজার ৫৭১ জনকে, বাঁশখালীর ১৫ ইউনিয়নে ৩৬ হাজার ৪৪০ জনকে, সাতকানিয়ায় ১৭ ইউনিয়নে ৪৬ হাজার ২৮৪ জনকে, চন্দনাইশের ১০ ইউনিয়নে ৩০ হাজার ২৮০ জনকে, বোয়ালখালীর ১০ ইউনিয়নের ৮ হাজার ৭১৪ জনকে, পটিয়ার ২২ ইউনিয়নের ৬৯ হাজার ৫৩০ জনকে প্রথম ডোজ দেওয়া হয়। এছাড়া উত্তর চট্টগ্রামের স›দ্বীপের ১৫ ইউনিয়নের ২০ হাজার ৪৩৮ জনকে, হাটহাজারীর ১৫ ইউনিয়নে ৩১ হাজার ৩৯০ জনকে, মিরসরাইয়ে ১৬ ইউনিয়নের ২১ হাজার ৩৮২ জনকে, রাউজানে ১৫ ইউনিয়নের ১৬ হাজার ২৬৪ জনকে, সীতাকুন্ডে ১০ ইউনিয়নে ৫০ হাজার ৩৭৬ জনকে, ফটিকছড়ির ২০ ইউনিয়নের ২১ হাজার ২৫৪ জনকে ও রাঙ্গুনিয়ার ১৫ ইউনিয়নের ৩০ হাজার ৬১৭ জনকে টিকার প্রথম ডোজ দেওয়া হয়।
এ বিশেষ গণটিকা ক্যাম্পেইনে ১২ বছর ও তদুর্ধ সকল নাগরিককে টিকা প্রদান করা হয়েছে। জাতীয় পরিচয় পত্র ও নিবন্ধন ছাড়াই দেওয়া হয়েছে টিকা। এছাড়া যারা নিবন্ধন করে টিকা নিতে পারেননি, তাদেরকেও এসময়ে টিকা প্রদান করা হয়। মোবাইল ফোন নাম্বারে টিকা গ্রহীতার তথ্য নথিভূক্ত করে টিকা প্রদানের ব্যবস্থা ছিল। কেন্দ্রে টিকা নিতে আসা ব্যক্তিদের নাম বয়স মোবাইল নম্বর নির্দিষ্ট ট্র্যাকে রাখা হয়েছে। এসব তথ্যের ভিত্তিতে ঐ ব্যক্তিকে পরবর্তীতে দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হবে। অনেক স্থানে টিকা দেওয়ার পর গ্রহীতাদের একটি কার্ড দেওয়া হয়েছে যা পরবর্তীতে টিকা গ্রহণের প্রমাণক হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।
যারা বিভিন্ন কারনে নিবন্ধন করতে পারছিল না এবং এর কারনে টিকাও নিতে পারছিল না এমন জনগোষ্ঠিকে টিকার আওতায় আনা হয়েছে। কোন জনগোষ্ঠিই টিকার বাইরে যাবে না - এ ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে সরকার এমন ব্যবস্থা করেছে। এ ক্যাম্পেইনে কেন্দ্রে হাজির হওয়া কোন ব্যক্তিই টিকা না নিয়ে ফেরত যায় নি। নির্দিষ্ট সময় পরেও টিকা দেওয়া হয়েছে। এসব কারনে কেন্দ্রে কেন্দ্রে অভাবনীয় সাড়া পড়েছে। সরকারের টিকা পলিসি ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে।
সিটি মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী নগরীর কাট্টলি ওয়ার্ডের মোস্তফা হাকিম মাতৃসদন কেন্দ্রে টিকাদান কার্যক্রম পরিদর্শন করেন। তিনি টিকা গ্রহীতাদের সাথে কথা বলেন। সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে টিকা দেওয়ার জন্য তিনি এসময় সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন। এছাড়া তিনি নগরীর আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডের লালদীঘি পার্কে গণটিকাদান উৎসবে যোগ দেন। বিশেষ এ গণটিকা প্রদান কার্যক্রম পরিদর্শন করতে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) সাবিনা ইয়াসমিন ও অতিরিক্ত সচিব (বাজেট) রাশেদা আক্তার ২৫ ফেব্রæয়ারি চট্টগ্রামে এসেছেন। তাঁরা প্রথম দিন বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার কবীর, সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরীর সাথে বিভিন্ন টিকা কেন্দ্র পরিদর্শন করেন। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান প্রথম দিন সকালে নগরীর অফিসার্স ক্লাব টিকা কেন্দ্র পরিদর্শন করেন।
কোভিড বিশেষ এ গণটিকা ক্যাম্পেইনে টিকা প্রদানের দিক দিয়ে চট্টগ্রাম জেলা সমগ্র বাংলাদেশের মধ্যে ৫ম হয়েছে। আর চট্টগ্রাম বিভাগের মধ্যে প্রথম ।
(পিআইডি ফিচার)
লেখক- সহকারী তথ্য অফিসার, পিআইডি, চট্টগ্রাম।
সম্পাদক ও প্রকাশক: রফিকুল ইসলাম
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-১৩১০