( ২য় পর্ব )
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী :
২৬ মার্চের পর থেকে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আমাদের আত্মীয় স্বজন আমাদের গ্রামের বাড়ীতে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য আসতে থাকেন। আওয়ামী লীগ সীতাকুণ্ড থানার তখনকার সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা আমার ছোট ফুফা জনাব ডাঃ এখলাস উদ্দিনের পরিবার উনি ভারতে চলে যাওয়ায় আমাদের বাড়ীতে চলে আসেন। আমার ফুফাতো বোন চট্টগ্রাম কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ রওশন আক্তার হানিফ, তাঁর ছোট ভাই বর্তমান মা ও শিশু হাসপাতালের অধ্যাপক ডাঃ মাহমুদ আহমেদ আরজুসহ তাঁর বোনেরা, আমার আরেক ফুফা তৎকালীন পিএইডি কর্মকর্তা ও লেখক সাংবাদিক খালেদ বেলালের পরিবার, আমার বড় ভাইয়ের মেঝভায়রা হামেদ শফিউল ইসলাম (প্রয়াত এডিশনাল সেক্রেটারি, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ সরকার)’র পরিবার, আমার চাচাতো ভাইয়ের খালাতো বোনের স্বামী বোয়ালখালী থানা আওয়ামী লীগের নেতা বদরুদ্দোজা দুলাভাই সহ আরও অনেকেই আমাদের বাড়ীতে আশ্রয় নেন। আমরা একঝাক শিশু কিশোর মিলে সারাদিন নানান ধরণের খেলায় মত্ত ছিলাম। একদিন সকাল সম্ভবত দশটার দিকে পাক আর্মি আসছে বলে সবাই বাড়ির পূর্ব দিকে অর্থাৎ সমিতির হাটের দিকে দৌড়াতে থাকি। পরে জানা যায় তা মিথ্যা। আমাদের বাড়ীর বিশাল উঠোন রাত পৌণে আটটা বাজলে সবাই বিবিসি রেডিও’র খবর শুনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন আশেপাশের বাড়ীর ছোটবড় সবাই। আবার রাত দশটায় ভোয়া বা ভয়েস অব আমেরিকার খবর শুনতেন তবে এখানে শুধু পাকিস্তানের খবরই বেশি প্রাধান্য পেতো। কিন্তু বিবিসি রেডিও ছিল মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের এবং সকল খবর জানার মূল কেন্দ্রবিন্দু। এদিকে অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, আমার ছোট ফুফার সীতাকুণ্ড থানার বহরপুরস্থ গ্রামের বাড়ী পাক বাহিনী এবং এদেশীয় দোসর রাজাকার আলবদররা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেয়।
মার্চের ২য় সপ্তাহ থেকে গুল মোহাম্মদ চৌধুরী বাড়ীর নুরুল আবছার চৌধুরী ও পূর্ব ফরহাদাবাদের দবিরুল আলম চৌধুরী প্রত্যেকদিন আমাদের বাড়ীতে আসতেন এবং বাবু দাদা ও জয়নুলের সঙ্গে অনেক রাত পর্যন্ত আলাপ করতে দেখতাম। আমাদের বাড়ীর কাছারি ঘরে রক্ষিত পথিকদের জন্য রক্ষিত ডাল ভাত চারজনে মিলে খেয়ে বের হয়ে যেতেন। বাবু দাদা আর জয়নুল কখন ফিরতেন জানতাম না তবে তাঁদেরকে সকালে দেখা যেতো বাড়ীতে। এভাবে মে-জুন পর্যন্ত কেটে যায়। এরই মধ্যে আমাদের এলাকার বিভিন্ন বাড়ীতে সশস্ত্র বুক্তিবাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নিতে শুরু করে। আমার ভাই বাবু স্থানীয় যুবকদেরকে সংঘটিত এবং উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য। আমাদের গ্রাম ফটিকছড়ি থানার সাবেক রোসাংগিরি ইউনিয়নের বি ওয়ার্ড এবং বর্তমান সমিতিরহাট ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড থেকে সর্বোচ্চ সংখ্যক ৩৩ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন । যা আমাদের এলাকার জন্য গর্ব, অহংকার এবং গৌরবের বিষয়। বিগত ২৪ আগষ্ট ১৯৭১ তারিখে আমার ভাই মোহাম্মদ আকতারুল আলম বাবুর নেতৃত্বে ১৩ জন যুবককে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ভারতে রওয়ানা দেন তাঁর দলের অন্যন্য সদস্যরা হলেন –সম্প্রতি প্রয়াত আব্দুল মান্নান, অতি সম্প্রতি প্রয়াত জহুর, আবুল কালাম, জয়নুল আলম ( ম্যানেজার), আহমেদ হোসেন বাবুল, আবুল হোসেন, নুরুল ইসলাম, ছালেহ জহুর, মোহাম্মদ মুসা, মরহুম সাইফুল আলম, রাশেদ এবং সোলায়মান। ভারতে গিয়ে আমার ফুফা ডাঃ এখলাস উদ্দিনের সঙ্গে দেখা করেন তাঁরা। পরে তিনি আমার ভাই প্রতিবেশী সাইফুল আলম, রাশেদ, জয়নুল আলম এবং ফুফার ছোট ভাই সরোয়ার কামাল দুলাল মামাকে শেখ ফজলুল হক মণির বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সে (বিএলএফ) বা মুজিব বাহিনীতে যুক্ত করে ভারতের উত্তর প্রদেশে অবস্থিত টান্ডুয়া ক্যান্টনমেন্টে প্রশিক্ষ্ণের জন্যে পাঠিয়ে দেন। বাকীদেরকে আসামের লোহার ক্যান্টনমেন্ট এবং লায়লপুর ক্যান্টনমেন্টে প্রশিক্ষণের জন্য প্রেরণ করা হয়। কিছুদিন আগে আমার ফুফা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে বলেন, যখন আমি বাবু আর দুলুকে বিদায় দিচ্ছিলাম তখন আমার পকেটে ছিল ভারতীয় মাত্র ১৪ টাকা। তাঁদের দুইজনকে ৬ টাকা করে দেয়ার পরে আমার কাছে অবশিষ্ট ছিল মাত্র ২ টাকা। আমার অন্তরে খুব দুঃখবোধ হচ্ছিল আমার ছোট ভাই আর ভাগ্নেকে আর্থিকভাবে কিছু সাহায্য করতে পারছিলাম না বলে। আমার ভাইদের ভারতে গমনের পরে আমাদের পরিবারের কিছু অংশ শহরে চলে আসে। পাশাপাশি আগষ্ট মাসের শেষের দিকে একদিন খুব ভোরে আমাদের বাড়ী পাক আর্মিরা হালদার পাড় থেকে চারিদিকে এক মাইল ব্যাসার্ধে ঘিরে ফেলে। ফজরের নামাজের জন্য মসজিদে যাওয়ার সময় এলাকার কিছু মানুষকে বাঁধা দেয়া হয়। অত্যন্ত সৌভাগ্যের বিষয় হচ্ছে আমার ভাইসহ এসব যুবকদের যদি পাক বাহিনী ধরে ফেলতো তাহলে সেদিন তাঁরা আদৌ জীবিত থাকতো কিনা সেটা সবার ভাবনার এবং আলোচনার বিষয় ছিল। প্রকৃতপক্ষে আমাদের বাড়ী ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রানজিট পয়েন্ট এবং আস্তানাও বটে। পাশাপাশি পেশায় শিক্ষক সূচি বাবু নামক মুক্তিযোদ্ধের এক সংঘটক আমাদের বাড়ীতে শিক্ষকতা করতে আসতেন এবং আমাদের বাড়ীতে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান, এলাকার কোথায় কি ধরণের অপারেশন হবে, মুক্তিযোদ্ধাদের কোন দল রাত্রি যাপন করবে, রাতে তাঁদের কত জনের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে সবকিছু আমার মেঝবাবার সঙ্গে প্রতিদিন আলাপ করে যেতেন। আমার মেঝবাবার দাড়ি / চুল কাটার জন্য রায়মোহন শীল নামে একজন নাপিত সপ্তাহে ২/১ বার আমাদের বাড়ীতে আসতেন। রায়মোহন শীল একজন সনাতন ধর্মাবলী ছিলেন সে কারণে হয়তবা অনেক সময় কিছু আলাপ তাঁর সম্মুখে হতো। আমার মেঝ চাচা চেয়ারম্যান পদে ইস্তফা দিলে নুরুল ইসলাম চৌধুরী চেয়ারম্যান হন। আবার তিনি ছিলেন মুসলিম লীগের সমর্থক। আমাদের আত্মীয় হলেও এলাকার প্রভাবশালী দানা মিয়াঁ চৌধুরী এবং ইসলাম চৌধুরী আমার বাবাদেরকে প্রতিপক্ষ মনে করতেন। এই সুযোগে চেয়ারম্যান ইসলাম চৌধুরী মুসলিম লীগ নেতা ফজল কাদের চৌধুরীর কাছে আমাদের বাড়ীর সকল তথ্য-উপাথ্য জানান। রায়মোহন শীল সূচী বাবুর আমাদের বাড়ীতে আগমন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কথা ইসলাম চৌধুরীকে জানান। আমার দাদা ১৯৫২ সালের ৮ আগষ্ট মৃত্যুবরণ করেন। সে হিসেবে একাত্তরের আগষ্টের সুবিধাজনক এক রাতে আমরা বাবারা দাদার একটা ছোট ইছালে ছওয়াবের আয়োজন করেন যেখানে আমার বড় ভাই, মেঝ ভাই ফুফাতো ভাইয়েরাসহ শহর থেকে অনেক আত্মীয় স্বজন, বাড়ীতেঅবস্থানরত আত্মীয়রাসহ মুক্তিবাহিনীর কিছু সদস্যও রাতে উপস্থিত ছিলেন। রায়মোহন শীল সেটা ইসলাম চৌধুরীর কানে পৌঁছিয়ে দেয় আর ইসলাম চৌধুরী ফজল কাদের চৌধুরী জানায় আপনার বন্ধু আব্দুল লতিফ চৌধুরী মুক্তিবাহিনীকে মেজবান প্রকাশ্যে মেজবান খাওয়াচ্ছেন। সঙ্গত কারণে বিপুল সংখ্যক আর্মি বিপুল পরিমাণ অস্ত্র আর গোলা বারুদে সুসজ্জিত হয়ে বিরাট এবং দীর্ঘস্থায়ী একটি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে পাক আর্মিরা এসেছিল। মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিনের ইচ্ছা, ঐদিন রাতে কোনো মুক্তিযোদ্ধা আর অস্ত্র বা গোলা বারুদ আমাদের বাড়ীতে ছিল না এবং আগের দিন রাতে আমাদের বাড়ীতে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের অস্ত্র এবং গ্র্যানেড নিয়ে যায়। শিশু এবং নারী ছাড়া আমার বাবা এবং আশেপাশের সকল পুরুষদেরকে হালদা নদীর চরে নিয়ে যায়। সবাইকে জিজ্ঞেস করতে থাকে মুক্তি কাহা হ্যাঁয় ? আব্দুল লতিফচৌধুরী এবং শহীদুল আলম চৌধুরী বেবি কোন হ্যাঁয় ? এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, আমার মেঝবাবা সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ চৌধুরী মুসলিম লীগের ফজলুল কাদের চৌধুরীর বন্ধু এবং বেবি হচ্ছেন আমার মেঝভাই। আমাদের পুরো পরিবারটাই হল আওয়ামী লীগের সমর্থক। পাশাপাশি ১৯৭০ এর নির্বাচনে আমার ছোট বাবা হালদা নদীর উপরে একটা নৌকা বানিয়ে ঝুলিয়েছিলেন। গ্রামের জামাতা জনাব হানিফ ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত ইপিআর সদস্য। তিনি প্রাণে বাঁচার জন্য নিজেকে ইপিআর সদস্য পরিচয় দিতে থাকেন এবং পাকিস্তানের কোথায় ছিলেন তার বর্ণনাও দিতে থাকেন বারবার যা তাঁর জন্য পরবর্তীতে হিতে বিপরীত হয়ে দাঁড়ায়। মরহুম জলিল মিয়াঁর এক পুত্র মাহাবুব আলম চট্টগ্রাম ওয়াসায় কর্মরত ছিলেন। তাঁর অপ্রকৃতিস্থ ভাই আগের দিন ঝগড়ার এক পর্যায়ে বসার পিঁড়ি দিয়ে তাঁর নাকে আঘাত করে যাতে পাক আর্মিরা তাঁকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সন্দেহ করতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের নাম জানতে চায় তাঁর কাছ থেকে। পাশাপাশি জনাব হানিফের কাছে জানতে চায় কয়জন মুক্তিযোদ্ধাকে তিনি প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এদিকে দশটার দিকে আমার বাবাসহ গ্রামবাসীদেরকে হাতে মোটা দড়ি দিয়ে বেঁধে প্রায় ৭ মাইল পায়ে হাটিয়ে ফটিকছড়ির সেনা ক্যাম্পে নেয়া হয়। সেখানে দুপুরে সবাইকে মোটা দুইটা রুটি এবং ডাল দেয়া হয় দুপুরের খাবার হিসেব। পাশাপাশি আমার বড় দাদা মোহাম্মদ ফরিদুল আলম চৌধুরী তৎকালীন ইউনাইটেড ব্যাংকের অফিসার ছিলেন। সে কারণে তাঁর সঙ্গে পাকিস্তানীদের যোগাযোগ ছিল। পাশাপাশি শিক্ষানুরাগী মরহুম বাদশাহ মিয়া চৌধুরীর বড় ছেলে আমার ফুফাতো ভাই আবুল হাসনাত চৌধুরী খসরু তখন হাবিব ব্যাংক লিমিটেডে কর্মরত ছিলেন এবং তিনি ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের ছাত্র হওয়ায় তাঁর সঙ্গে বেশ কিছু পাক আর্মির কিছু অফিসারের পরিচয় ছিল। আরেক ফুফাতো ভাই চট্টগ্রাম নিউ মার্কেটে অবস্থিত ফটোরমার মালিক বিশিষ্ট ফটোগ্রাফার মর্তুজা তৌফিকুল ইসলাম সেনাবাহিনীর ফটোগ্রাফার নিয়োজিত ছিলেন তিনি এবং আমার বড় দাদার বাসা বশর বিল্ডিংয়ের ৩য় তলায় বসবাস করতেন অবাঙ্গালী জনাব হাসেমি সাহেব যিনি ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের কে সি দে রোড শাখার ম্যানেজার ছিলেন। তাঁদের সকলের আন্তরিক প্রচেষ্টায় আমার বাবা এবং গ্রামবাসীরা সন্ধ্যায় ছাড়া পান। শুধু মাত্র সবেক ইপিআর সদস্য হানিফ এবং মাহবুব আলম ছাড়া পাননি। তাঁদেরকে কোথায় কিভাবে হত্যা করা হয়েছে অদ্যাবধি তা কেউই জানেনা।
সম্পাদক ও প্রকাশক: রফিকুল ইসলাম
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-১৩১০