আশফা খানম
ইসলাম নারীদের মানুষ হিসেবে যে সব পবিত্ৰ অধিকার প্রদান করেছে তার মধ্যে মতামত প্রদানের স্বাধীনতা অন্যতম।এছাড়াও রয়েছে জ্ঞানার্জনের অধিকার, সম্পদের অধিকার, পেশা গ্রহনের স্বাধীনতা ঘরে বাইরে কাজের অধিকার, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ইত্যাদি।ইসলামে অধিকার বিষয়ে মুসলিম নারী ও পুরুষ সমান।
কুরআন তাক্ওয়া বা খোদাভিরুতাকে শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাটি বানিয়েছে।লিঙ্গ, বংশ, শ্রেণী ইত্যাদি শ্রেষ্টত্বের তথা নেতৃত্বের মাপকাটি হিসেবে গ্রহনযোগ্য নয়।(সূরা হুজুরাত, আয়াত- ১৩) দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম তথা প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে আল্লাহ্ তায়ালা ব্যবহারিক প্রভেদ অনুমোদন করেননি।(সূরা আল ইমরান- আয়াত ১৯৫)।
কুরআন আমাদের সামনে বিলকিসের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে, যিনি ছিলেন পুরুষের উপর নেতৃত্বশীল এক নারী।অবিশ্বাসী জনগনের জীবন ধারা পরিত্যাগ করে তিনি যখন মুসলমান হলেন, তখন কিন্তু তিনি শাসনভার পরিত্যাগ করেন নি।(সূরা আন-নামল- আয়াত ২৩-৪৪)।কোন দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যাবে না, যার দ্বারা প্রমান হয় যে, মুসলমান হওয়ার পর বিলকিস শাসন ক্ষমতা ত্যাগ করেছিলেন।ইতিহাসের আলোকে ইসলাম প্রতিষ্ঠায় নারীর অবদানের কথা আলোচনা করলেই বুঝা যাবে ইসলাম নারীর মতামতের প্রতি কতটুকু শ্রদ্ধাশীল।
বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর নিকট কলেমা পাঠে সর্বপ্রথম যিনি ইসলাম কবুল করেন তিনি ছিলেন নারীকুল শিরোমনি বিবি খাদিজাতুল কুবরা (রাঃ)।মূল কুরআনের হিফাজত কারিনী ছিলেন একজন নারী।তিনি ছিলেন হযরত উমর (রাঃ) এর কন্যা বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর অন্যতমা স্ত্রী বিবি হাফসা (রাঃ)।ইসলামের ইতিহাসের সর্বপ্রথম শহীদ ছিলেন একজন নারী হযরত সুমাইয়া বিনতে খাবাত (রাঃ)।বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর হিজরতের কয়েক বছর আগে শাহাদাৎ বরন করেন।মুমিনদের শিক্ষক ও মাতা হযরত বিবি আয়েশা (রাঃ) উস্ট্রের যুদ্ধে সরাসরি সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
তখন তাঁর বাহিনীতে ছিলেন হযরত তাল্হা এবং যুবায়ের (রাঃ) মতো সহাবাগন।ষষ্ঠ হিযরির জিলকদ মাসে হুদাইবিয়ার সন্ধি চুক্তির প্রাক্কালে ইসলামের ইতিহাসের এক দুঃসহ মুহুর্তে বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) একজন নারীর মতামত বা পরামর্শকে অনুসরন করেছিলেন।
ঘটনাটির থেকে সুস্পষ্ট ভাবে প্রমানিত হয় যে, ইসলামে নারীর মতামত ও পরামর্শের গুরুত্ব অপরিসীম।
হুদাইরিয়ার সন্ধি চুক্তির প্রাক্কালে মহানবী (সাঃ) তার স্ত্রী উম্মে সালমা (রাঃ) এর পরামর্শে তাঁর পশু কুরবানী করেন এবং নিজ মস্তক মুন্ডন করেন।ফলে সকল শঙ্কা, নিরবতা ভঙ্গ করে সাহাবীরা বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) কে অনুসরন করেন।
এ অবস্থায় বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) একথা বলেন নি যে, আমাকে কি করতে হবে তা একজন নারী কি করে আমাকে বলতে পারে? তিনি একজন নারীর পরামর্শ জরুরী ঘুহুর্তে পুরোপুরি গ্রহন করেছেন।কুরানের ভাষায় তারাই মুসলমান: যারা তাদের কাজ কর্ম পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে পরিচালনা করে থাকে (৪২:২৮), মতপার্থক্য নিষিদ্ধ হয়নি বরং কিভাবে সেগুলোর নিরসন করতে হবে, তার উপায় পরিষ্কারভাবে ইংগিত করা হয়েছে।
যদি কোন ব্যাপারে তোমাদের মধ্যে মত বিরোধ দেখা দেয় তাহলে তা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুল বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর উপর সোপর্দ কর (৪:৬৯)।সঠিক ভূমিকা পালনের উদ্দ্যেশে মুসলমান পরিবারে শুরা অর্থাৎ পারস্পরিক পরামর্শ সম্পর্কিত কুরানের নির্দেশ অনুসরন করা উচিৎ।সন্তানের শিক্ষা-দিক্ষা, বিয়ে-শাদী, শারিরীক ও মানসিক উন্নতির ব্যাপারে স্বামী ও স্ত্রী উভয়েরই দায়িত্ব রয়েছে।সাংসারিক কাজ কর্মের প্রতি দৃষ্টি দেওয়াও উভয়ের দায়িত্ব।
ইসলামে সাক্ষী হিসাবে ও নারীর মতামতের গুরুত্ব অপরিসীম।সাক্ষ্যদানে একজন পুরুষ কিংবা দু'জন নারী বক্তব্য দিলে তবেই তা গ্রহনযোগ্য কথাটি সর্বক্ষেত্রে প্রামান্য নয়।সূরা বাকারার যে আয়াতটি সাক্ষী হিসাবে দু'জন মহিলা কিংবা একজন পুরুষের কথা বলা হয়েছে সে আয়াতটি শুধুমাত্র ব্যবসা বানিজ্যের সাথে সংশ্লিষ্ট।কুরআনে আরো পাঁচ রকমের সাক্ষ্যের উল্লেখ রয়েছে।যাতে একজন পুরুষের স্থলে দু'জন মহিলার শর্ত উল্লিখিত হয়নি।তাছাড়া নারী বিষয়ে ঐ আয়াতটি চূড়ান্ত আয়াত নয়।এমন সময় আয়াতটি নাজিল হয় যখন পুরুষদের সাথে মুসলিম নারীদের ক্রমন্বয়ে সমতার স্থরে পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছিল।আয়াতটি নও মুসলিম মহিলার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যেতে পারে, কিন্তু চুড়ান্ত পর্যায়ে আমাদের সূরা তাওবার ৭১নং আয়াতটি বিবেচনায় আনতে হবে যা মুসলমান নারী পুরুষকে পরস্পরের আউলিয়া (সংরক্ষনকারী বন্ধু ও অভিভাবক) ঘোষনা করে।সেই সম্পর্কটা নিশ্চয়ই দুই এর স্থলে এক এর সম্পর্ক নয়।
আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে, ইসলামের দ্বিতীয় উৎসঃ আর হাদীসের ব্যাপারে একজন মহিলার বর্ণিত হাদিস গ্রহণযোগ্য হয়।তাহলে এমন কোন অধিকতর সংবেদনশীল ব্যাপার নেই, যা একজন নারীর নিকট থেকে গ্রহণ করা যায় না।মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) একজন মহিলা কর্তৃক একটি ধর্মীয় ব্যাপারে অপর একজন মহিলার কাছ থেকে বিধান চাচ্ছেন তা বর্ণনার ব্যাপারে একজন মহিলার সাক্ষ্য অনুমোদন করেছেন।জীবন সঙ্গী পছন্দের ব্যাপারেও পাত্রীর মতামত নেয়ার বিধান ইসলামে রয়েছে।শাস্ত্রীয় মতামতকে উপেক্ষা করে কোন নারীকে জোর পূর্বক কারো সাথে বিয়ে দেয়ার বিধান ইসলাম সমর্থন করেনা।মোহরানা নির্ধারণের ক্ষেত্রে ও নারীর সংগে পরামর্শ করতে হয়।
ইসলামে নারীর মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা সুস্পষ্ট ভাবে স্বীকৃত।কুরআন ও হাদীসের নির্ভুল জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমেই একজন মুসলিম নারী জানতে পারে ইসলাম প্রদত্ত নারী স্বাধীনতার স্বরপ সম্পর্কে।
প্রবন্ধকারঃ প্রিন্সিপ্যাল সিভিএনএস, কলামিস্ট, লেখক ও নারী উন্নয়নকর্মী।
সম্পাদক ও প্রকাশক: রফিকুল ইসলাম
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-১৩১০