মুহাম্মদ রমিজ উদ্দিনঃ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে 'খ' ইউনিটে প্রথম হওয়া জাকারিয়াকে নিয়ে কোচিং সেন্টারের টানাহেঁচড়া করার ঘটনা ইতোমধ্যে প্রচার হয়ে গেছে। দেশের শীর্ষ স্থানীয় পত্রিকা প্রতিবেদন করেছে। এ নিয়ে বেশ কদিন আলোচনা চলবে। আমাদের জন্য কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জন্য এটি আলোচনার দাবিও রাখে। কিন্তু মূল সমস্যা কিংবা এর থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে আলোচনা তেমন একটা হয় না। হবে বলেও মনে হয় না।
ভর্তি পরীক্ষায় টপটেনে থাকা শিক্ষার্থীদের নিয়ে কোচিং সেন্টারের টানাহেঁচড়া কিন্তু নতুন নয়। প্রতিবছর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল, বুয়েট, চুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হওয়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে টানাহেঁচড়া চলে। অন্যদিকে প্রথম হওয়া শিক্ষার্থীরাও এসব টানাহেঁচড়া পছন্দ করে। কোচিং সেন্টারের টানাহেঁচড়া মানে একটা ল্যাপটপ উপহার পাওয়া, হাজারি নোটের বান্ডিলের বড় একটা এমাউন্ট চকচকে প্যাকেটবন্দী হয়ে পকেটে ঢোকা! অনেকটা 'মেঘ না চাইতে বৃষ্টি'র মতন সহজ একটা ইনকাম। এ ইনকাম হাতছাড়া কয়জনে করে! সোজা বাংলায় বললে এ দেশের মেধাবীরা মেধার উন্মেষ ঘটানোর সাথে সাথে বিক্রি হয়ে যায়। কেউ কম্পিটার ল্যাপটপ, কেউ টাকা আর কেউ খ্যাতির কাছে বিক্রি হয়। খ্যাতির কাছে বিক্রি হওয়া মানে বুঝেন তো! মেডিক্যালে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্স্ট হওয়া বা টপটেনে থাকার খবরটা ছবিসহ কয়েকটি কোচিং সেন্টারের রঙিন পোস্টারে দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে। এ খ্যাতি কম কীসের!
হয়তো জাকারিয়া ভালো ছিল বলে বিক্রি হয়নি। সৎ ছিল বলে প্রতিবাদ করে সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে। প্রতিবাদ না করে চুক্তিতে গেলে কজন জানতে পারতো! আমি আপনিই বা কি বলতাম! হ্যাঁ, প্রতিবছর ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হবার পর প্রথম হওয়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে টানাহেঁচড়া চলে। মেধাবীদের বেচাবিক্রি চলে। মেডিক্যালের ভর্তি পরীক্ষায় ফার্স্ট হওয়া ছেলেটা কয়েকটি কোচিং সেন্টারের পেইজ থেকে লাইভ করে বলেছে আমি একমাত্র এ কোচিং সেন্টারে পড়েছি। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, তার একমাত্র কোচিং সেন্টারের ঘোষণাটা একটা মাত্র কোচিং সেন্টারের লাইভ প্রোগ্রাম থেকে আসেনি। ভাগ্য ভালো জাকারিয়া বিক্রি হয়নি। একের অধিক কোচিং সেন্টারের নাম বলেনি।
এই যে মেধাবীরা বিক্রি হয়, এর জন্য কিন্তু কোচিং বানিজ্যের শিক্ষা ব্যবসায়ীরা দায়ী। এরা তাদের মার্কেটিং বিভাগকে চাঙা করে ব্যবসায় বাম্পার ফলানোর নিমিত্তে মেধাবীদের কিনে নেয়। সেই সাথে নষ্ট করে দেয় মেধাবীদের নৈতিক, রুচিসম্মত সুস্থ মানসিকতাকেও। কারণ মেধাবীরা টাকার লোভের কাছে আত্নসমর্পণ করে নৈতিকতা রক্ষার লড়াইয়ে হেরে যায়। অভাবে জর্জরিত এ মেধাবীরা নিজের বিবেক, নৈতিকতা ইত্যাদি টাকার কাছে বিক্রি করে দেয়। মোটা অঙ্কের টাকার লোভে ফেলে বিক্রি হওয়ার জন্য ধাবিত করার জন্য কোচিং বাণিজ্যরাই দায়ী নয় কি!
কোচিং বাণিজ্য যারা করে তারা যদি সত্যিকারের শিক্ষা প্রদান করে থাকে তাহলে তাদের পক্ষে এমন গর্হিত কাজ করা সম্ভব হতো না। তারা শিক্ষার্থীদের যতো না শিক্ষা প্রদান করে, তারচেয়ে বেশি শেখায় কলাকৌশল। যতো না নৈতিকতার শিক্ষা দেয়, তারচেয়ে বেশি প্রদান করে শর্টকাট কষ্টে অধিক অর্জনের কূটনীতিক কৌশল। আর তারাই দিনশেষে টাকার বিনিময়ে প্রথম হওয়া শিক্ষার্থীদের কিনে শর্টকাটভাবে কোচিং সেন্টারের সফল প্রচারণা চালায়।
একজন শিক্ষার্থী প্রথম হলে প্রথম আলোচিত হওয়ার দরকার ছিল তার মা-বাবার। আলোচিত হওয়ার কথা প্রাইমারি, হাইস্কুলের শিক্ষকগণের। প্রশংসায় ভাসার কথা তার অভিভাবকদের। আর এখন আলোচিত হয়ে যায় ব্যবসায়ীরা। এটা লজ্জার বিষয় বৈকি! আর লজ্জার বিষয়টি সগৌরবে প্রচার করে কোচিং বাণিজ্যের শিক্ষা ব্যবসায়ীরা। এদের হাতে যেখানে একজন মেধাবী শিক্ষার্থী নিরাপদ নয়, সেখানে শিক্ষার্থীদের নৈতিকতা কীভাবে নিরাপদ হবে!
কোচিং বাণিজ্য বন্ধ থাকলেও ইউনিভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষা হবে। ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীরা পাস করবে। কেউ না কেউ প্রথম হবে। সুতরাং কোচিং এর জন্য শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশ নয়, বরং মেধাবীদের ব্যবহার করে কোচিং বাণিজ্যের শিক্ষা ব্যবসায়ীরা ব্যবসার বিস্তার ঘটায়।
কোচিং বাণিজ্য বন্ধ হওয়া সময়ের দাবি। কোচিং বাণিজ্য চললেও একটা নিয়মের আওতাভুক্ত হোক। ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হওয়া মেধাবী শিক্ষার্থীদের নৈতিকতা বিক্রির সংস্কৃতিও বন্ধ হোক। এবং প্রথম হওয়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে টানাহেঁচড়া করার মতো, নির্লজ্জ, ন্যক্কারজনক ঘটনা না ঘটুক।
সম্পাদক ও প্রকাশক: রফিকুল ইসলাম
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-১৩১০