মোহাম্মদ মন্জুরুল আলম চৌধুরী।:
প্রকৃতির বৈরী আচরণের কারণে এ বছর পাঁচটি জো অতিক্রম হলেও ডিম সংগ্রহকারীদের মধ্যে চরম হতাশা এবং শঙ্কা বিরাজ বিরাজ করছিল। অবশেষে হালদার পাড়ের মাছের ডিম সংগ্রহকারীদের মুখে হাসি ফুটেছে। “প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র ও বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ হালদা নদীতে কার্প জাতীয় মা মাছ (রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালিবাউশ) ডিম ছেড়েছে। ২০২০ সালের পর এবার সবচেয়ে বেশি ডিম ছেড়েছে। এবার ১৮ থেকে ২০ হাজার কেজি ডিম ছেড়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন”{সূত্রঃ দৈ/ আজাদী, ২০ জুন’ ২৩}। তীব্র দাবদাহে পানির তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া, বৃষ্টি না থাকা, তাপদাহ ও বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রকোপের কারণে পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বৃদ্ধি এবং পানি প্রবাহ কমে যাওয়াসহ নানা কারণে হালদা নদীতে মৌসুম জুড়েই ডিম ছাড়ার অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়নি। ফলে ডিম সংগ্রহকারীরা নমুনা ডিম ছাড়া পুরোদমে ডিম সংগ্রহ করতে পারেনি। অত্যন্ত আনন্দের বিষয় হচ্ছে, এবার হালদা নদীতে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি ডিম পাওয়ায় অন্তত ৫০ কোটি টাকার পোনার বাণিজ্য হবে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এই রেণু পরবর্তীতে কয়েক হাজার কোটি টাকার মৎস্য সম্পদে পরিণত হবে। যা দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের পাশাপাশি মানুষের খাদ্যে পুষ্টি যোগাতে নিঃসন্দেহে অনন্য ভূমিকা রাখবে। তবে শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, বেশি ডিম পাওয়ার ফলে অব্যবস্থাপনায় অনেক ডিম নষ্ট হয়ে যেতে পারে। জানা যায়, গত ১৮ জুন’২৩ দিবাগত রাতে সবচেয়ে বেশি ডিম ছাড়ে মা মাছ। এবার ৩শ নৌকায় প্রায় সাড়ে ৯শ ডিম সংগ্রহকারী ১৮–২০ হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ করেছেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। ডিম থেকে রেণু ফোটানোর জন্য চারটি সরকারি হ্যাচারি, একটি বেসরকারি হ্যাচারি এবং কিছু মাটির কুয়া রয়েছে। কিন্ত এবার যে পরিমাণ ডিম সংগ্রহ করা হয়েছে তার তুলনায় এই হ্যাচারি ও কুয়া পর্যাপ্ত নয় বলে জানান সংশ্লিষ্টদের অভিমত।
এবার বেশি পরিমাণে ডিম পাওয়া প্রসঙ্গে অধ্যাপক মঞ্জুরুল কিবরিয়া জানান, পানির মান ভালো হওয়ার পাশাপাশি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার ফলে এবার প্রত্যাশার চেয়ে বেশি ডিম পাওয়া গেছে। ফলে হালদা এবার ডিম সংগ্রহকারীদের হতাশ করেনি। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের নিদের্শনা অনুসারে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, নৌ পুলিশের তৎপরতা, হালদা নদীর জীববৈচিত্র্য ও মিঠা পানির ডলফিন রক্ষায় নানামুখী কার্যক্রম এবং নদী দূষণের ব্যাপার অভিযান অব্যাহত ছিল। নদী থেকে মাছ চুরির ঘটনা সনাক্ত করতে মদুনাঘাট থেকে আমতুয়া পর্যন্ত ৮টি পয়েন্টে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। ১৯৮৫ সাল থেকে হালদা নদীতে সারা বছর মাছ ধরা নিষিদ্ধ রয়েছে। নদীতে নির্বিচারে মাছ আহরণ বন্ধের লক্ষ্যে এবং মা মাছের চলাচল নিরাপদ নির্বিঘ্ন এবং নিশ্চিত করতে মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয় ২০০৭ সালে হালদা নদীর সর্তার ঘাট ব্রিজ থেকে মদুনাঘাট ব্রিজ পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার পরবর্তিতে ২০১০ সালে সর্তার ঘাট ব্রিজ থেকে নাজিরহাট পর্যন্ত প্রায় মোট ৪৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এলাকাকে মৎস্য অভয়াশ্রম ঘোষণা করে। অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, এসব ব্যবস্থা নেয়া সত্ত্বেও দিনে ও রাতের আঁধারে কতিপয় লোভী অসাধু মৎস্যদস্যুরা আইন না মেনে সুযোগ বুঝে নদী থেকে প্রতিদিন ভাসা জাল, কারেন্ট জাল, হাত জাল ও বড়শি দিয়ে মা-মাছ শিকার করছে।
দেশের জন্যে ভয়ংকর ভয়াবহ শঙ্কা এবং উদ্বেগের বিষয়, হালদা নদীর জলজ জীব বৈচিত্র্য প্রাকৃতিক পারিপার্শ্বিক মনুষ্যসৃষ্টসহ নানাবিধ কারণে কঠিন হুমকির সম্মুখীন। ফটিকছড়ির ভুজপুর এলাকায় রাবার ড্যাম বসিয়ে চা বাগান ও কৃষি জমিতে পানির জোগান দেয়ার জন্য উজানে বাঁধ দেয়ায় ভাটিতে পর্যাপ্ত পানি যেতে না পারায় শুকনা মৌসুমে হালদা নদীর অন্তত ৫-৬ কিলোমিটার এলাকা শুকিয়ে যায়। পাশাপাশি নদীর পানির স্তর কমে যাওয়ায় বিশাল এলাকা জুড়ে রুই ও কালবাউশের খাদ্য বেনথোস এবং মৃগেল ও কাতলা মাছের খাদ্য প্ল্যাঙ্কটনের উপস্থিতি প্রায় শূন্যের কোঠায় এসে ঠেকেছে। যা মাছের খাদ্য সঙ্কটের পাশাপাশি বিচরণ ক্ষেত্রকে সঙ্কুচিত করে ফেলেছে। সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে ডলফিনের চিরপরিচিত এবং নিরাপদ আশ্রয়স্থল। তাছাড়া নদীর দুই পাড়ের জমিতে বিভিন্ন চাষাবাদ ও তামাক চাষ নদীকে মেরে ফেলছে। কেননা চাষাবাদের এবং তামাকের নির্যাস, সার ও কীটনাশক সরাসরি মিশে যাচ্ছে হালদার পানিতে। পাশাপাশি বর্ষায় পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টির সঙ্গে কৃষিজমির এবং তামাকের পচা পাতা, মূল ও চুল্লির তামাক পাতা পোড়ানোর ফলে উচ্ছিষ্ট বর্জ্য নদীর পানিকে দূষণ করছে। কীট নাশক ও তামাকের বিষ নদীর পানিতে মিশে মাছ ও বিভিন্ন প্রজাতির জলজ প্রাণীর জীবনকে বিপন্ন করে তুলছে।
এছাড়াও বিভিন্ন শিল্পকারখানার বর্জ্য শোধনাগার বা ইটিপি দিয়ে পরিশোধিত না করে বিষাক্ত বর্জ্য এবং ইটভাটায় ব্যবহৃত পানি ও মাটি নদীতে ফেলার কারণে তা পানিতে মিশে পানির স্বাভাবিক রঙ স্বাদ স্বচ্ছতা হারিয়ে ফেলছে। পাশাপাশি বিভিন্ন প্লাস্টিক পণ্য, পলিথিন,বাজার এবং গৃহস্থালির বর্জ্য নির্বিঘ্নে নদীতে ফেলা হচ্ছে। ড্রেজারে বালু উত্তোলন হালদা নদীর অস্তিত্ব এবং মাছের অভয়ারণ্যের জন্য বিরাট হুমকি। ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলনের ফলে নদীর তলদেশের মাটির প্রকৃতি ও গঠন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, বাড়ছে শব্দ দূষণ, ঘোলা হয়ে যাচ্ছে পানি, পানিতে সূর্যের আলো পর্যাপ্তভাবে পৌঁছাচ্ছে না। এমনকি বালুর সঙ্গে বিভিন্ন প্রকারের জলজ প্রাণী উঠে আসছে। পাশাপাশি ড্রেজারের পাখার আঘাতে মা মাছ ও ডলফিন মারা যাচ্ছে।
দুঃখজনক বিষয়, নদীর বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণী এখন বিলুপ্তির পথে। প্রকৃতি, নদীর পরিবেশ এবং জলজ জীববৈচিত্র্য যে হুমকির মধ্যে পড়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। শঙ্কার বিষয় এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক মৎস্যক্ষেত্র হালদা নদী অচিরেই মৎস্যশূণ্য মৃত নদীতে পরিণত হবে দেশের অন্যান্য নদীর মতো। শুধু আর্থিক ক্ষতি নয় পুষ্টি সঙ্কটেরও সম্মুখীন হবে দেশ ও জাতি।
অতএব পুরো হালদা নদীকে অচিরেই মাছের অভয়ারণ্য ঘোষণার পাশাপাশি নদীর ওপর সকল ধরণের অনাচার অবিচার নির্দয় আচরণ ও জুলুম বন্ধে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ এবং দোষীদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করতে হবে।
দেশের বিচার বিভাগ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, নদী রক্ষা কমিশন, পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন, সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রশাসনের সমন্বিত অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে সঠিক সুষ্ঠু কঠোর এবং নির্মোহভাবে আইনের প্রয়োগের পাশাপাশি দূষণের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে বিরাট এবং বিশাল অংকের জরিমানা করার বিকল্প নেই। মনে রাখা উচিৎ, হালদা নদী রাষ্ট্র দেশ এবং জাতির অমূল্য সম্পদ। অতএব, যে কোনো মূল্যে হালদা নদীকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে।
লেখক :
মোহাম্মদ মন্জুরুল আলম চৌধুরী।
দেওয়ান বাজার, চট্টগ্রাম-৪০০০।