"আমার সাধনা অরূপের সাধনা,
সাত সমুদ্দুর তের নদী পারে যে রাজকুমারী বন্দিনী, সেই রুপকথার অরূপাকে মায়া-নিদ্রা হতে জাগাবার দুঃসাহসী রাজকুমার আমি।"
কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ছোটবেলায় গল্প, কবিতা কিংবা সংক্ষিপ্ত জীবনী থেকে পরিচয় ঘটলেও নজরুলকে নতুন করে চিনতে শিখেছি কবিতা, গান এবং তার কিছুর কথার মাধ্যমে। প্রেম, সংগ্রাম, বিদ্রোহ যার চেতনায় গাথা সেই নজরুল মাঝে খুঁজে পেয়েছি এমন কিছু কথা যা আমার দৃষ্টিভঙ্গির অনেক পরিবর্তন ঘটে ফেলছে।
নজরুল প্রেমের কবি। বিদ্রোহ, ভালোবাসা, সাম্য একসঙ্গে তাল মিলিয়ে চালিয়ে গিয়েছেন তিনি। প্রেমিকা প্রতি অসীম মমত্ববোধ তার গানেই দেখা মেলে। যে প্রেমের গান কবিকে অমর করে রেখেছে
হাজারো প্রেমিকের স্বপ্ন জাগে তার মত করে প্রেমিকাকে সাজাতে।
নজরুলের জীবনে প্রেম এসেছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। নারীর প্রেম তাঁর কাব্যে ফেলেছে প্রভাব। হয়ে উঠেছেন একাধারে দ্রোহ ও প্রেমের কবি। কবি তাঁর জীবনে আসা প্রেমিকাদের নিয়ে লিখেছেন অজস্র গান, কবিতা। তাঁর জীবনের নানা ঘটনার জন্ম হয়েছে তাঁর প্রেমিকাদের ঘিরে, এসব প্রেমে ছিল মোহমুগ্ধতা অনবদ্য সৌন্দর্য, বিরহ, যাতনা। কবি নজরুলের দুঃখ-দারিদ্র্য তাঁর নিত্যসঙ্গী হলেও তাঁর হৃদয়ে বার বার প্রেমে এসেছে। দুটোই জীবনকে দিয়েছে যন্ত্রণা।
হারানো প্রেমিকাকে নিয়ে রয়েছে কত গল্প, কবিতা গান৷ নার্গিসকে ভালবেসে নজরুল লিখেছিলেন ১৫৭টি গান ও ১২০টি কবিতা। নার্গিসকে নিয়ে নজরুলের লেখা সেই বিখ্যাত গানটি হলো-
'পথ চলিতে যদি চকিতে
কভু দেখা হয়, পরান-প্রিয়!
চাহিতে যেমন আগের দিনে
তেমনই মদির-চোখে চাহিয়ো।'
নজরুল জীবনের উপলব্ধি করিয়ে দিয়েছেন তার গানের মাধ্যমে। জীবনকে তুলনা করে বুঝিয়ে দিয়েছেন জীবনের অর্থ কি৷ মানুষ কি চায়। কিসের পানে ছোটে।
"আমায় নহে গো ভালবাস শুধু ভালবাস মোর গান " গানে বিশ্লেষণ করেছেন জীবনের মর্মকথা।
"যে কাঁটা-লতার আঁখিজল, হায়
ফুল হয়ে ওঠে ফুটে
ফুল নিয়ে তার দিয়েছ কি কিছু
ফুল নিয়ে তার দিয়েছ কি কিছু
শূন্য পত্র-পুটে
ফুল হয়ে ওঠে ফুটে"
জীবনের চাওয়া পাওয়া, অন্যের আনন্দে ছোটা এমনকি অন্যরজন্য স্বার্থ বলি কিংবা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ফুটে উঠেছে তার গানে। এজন্য হয়ত কবি বলে গেছেন
'রাধা ভালোবেসেছিল কৃষ্ণকে নয়, কৃষ্ণের বাঁশিকে। তোমরাও ঠিক ভালোবাসো আমাকে নয়, আমার সুরকে, আমার কাব্যকে।'
কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন বিদ্রোহী। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল তাঁর কণ্ঠস্বর। এ কারণেই তিনি ভূষিত হন ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে। আজীবন সংগ্রাম করেছেন শোষিত মানুষের মুক্তির জন্য। সোচ্চার ছিলেন সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার ও কূপমণ্ডুকতার বিরুদ্ধে। তরুণদের কাছে তিনি বিদ্রোহের অনন্ত প্রতীক। চির উন্নত শির কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর মাত্র দুই যুগের সৃষ্টিকর্মজুড়ে পরাধীন দেশের মানুষকে মুক্তির পথ দেখিয়ে গেছেন। তাই তো ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় তিনি বলেছেন,
‘আমি দুর্বার,আমি ভেঙে করি সব চুরমার!
আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,
আমি দলে যাই যত বন্ধন,
যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল!’
তিনি ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে মানবতাকে সবচেয়ে বড় করে দেখার জন্য ‘মানুষ’ কবিতায় আরও বলেছেন,
‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান। নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি, সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।’
নজরুল শোষিতের পক্ষ অবলম্বনে কোনো রাখঢাক রাখেননি। তিনি তাঁর সৃষ্টিশীলতার প্রায় সব প্রয়াস মনুষ্যত্ব, মানব ধর্মের বিকাশ এবং প্রগতির পথের বাধা দূর করার জন্য নিবেদন করেছিলেন।
কাজী নজরুল ইসলাম সমাজের সব স্তরের, শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে গেছেন। দুখু মিয়া জানতেন, গরিব কৃষক মুটে-মজুর আর দৌলতবান মানুষের ঈদ-আনন্দ কেমন। তাই তো ‘কৃষকের ঈদ’ কবিতায় ক্ষুব্ধ নজরুল লিখেছিলে
‘বেলাল! বেলাল! হেলাল উঠেছে পশ্চিম আসমানে, লুকাইয়া আছ লজ্জায় কোন মরুর গোরস্তানে! জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিদ, মুমূর্ষু সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?’
তিনি আজীবন অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন, শোষণমুক্ত ও শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছেন, দেখিয়েছেন। তাঁর জীবনাদর্শ অনুসরণ করে একটি অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন, শান্তিপূর্ণ, সুখী-সমৃদ্ধ একটি পৃথিবী গড়ে উঠুক।
১৮৯৯ সালে আসানসোলে আজকের দিনে জন্ম নেওয়া নজরুলের সৃষ্টিকর্ম ১২৫ বছর পর আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। নজরুল চিরকাল বাঙালী মনে রবে। বাঙ্গালী চিরকাল স্মরণ করবে।
সম্পাদক ও প্রকাশক: রফিকুল ইসলাম
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-১৩১০