উপ-সম্পাদকীয়ঃ
মোহাম্মদ মন্জুরুল আলম চৌধুরী।
প্রতিদিন খবরের কাগজ উল্টালেই চোখে পড়ে পানিতে ডুবে শিশুদের করুন মর্মান্তিক হৃদয় বিদারক অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু। অথচ পরিবার পরিজনসহ সবাই সচেতন সতর্ক এবং সজাগ হলে এ ধরণের অপ মৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব। “দেশে পানিতে ডুবে প্রতিদিন গড়ে পাঁচ বছরের কম বয়সী ৩০টি শিশু মারা যায়। এসব মৃত্যুর ৮০ শতাংশই বাড়ি থেকে ২০ মিটারের মধ্যে ঘটে। এর মধ্যে ৭৫ শতাংশ শিশুর মৃত্যু হয় পুকুর, ডোবা ও বালতির পানিতে। শিশুদের একটু দেখভাল করে রাখাসহ তিন কৌশলে এসব মৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব। গতকাল রোববার সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) ও প্রথম আলো আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়”{সুত্রঃ প্র/ আলো, ২৫ জুলাই’২২}। কৌশলগুলো হচ্ছে, “সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি, শিশুদের সাঁতার শেখানো, অভিভাবকদের তত্ত্বাবধানে এলাকাভিত্তিক দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপন এবং গ্রামে মায়েরা গৃহস্থালি কাজে ব্যস্ত থাকার সময় শিশুদের নজরে রেখে পানিতে ডোবা প্রতিরোধে সম্মিলিত উদ্যোগ নেওয়া”। গত ২৫ জুলাই’২২ তারিখ ছিল বিশ্ব পানিতে ডোবা প্রতিরোধ দিবস। দিবসটি বিশ্বজুড়ে দ্বিতীয়বারের মতো পালিত হচ্ছে। বিভিন্ন জরিপের তথ্য থেকে জানা যায়, “দেশে বছরে পানিতে ডুবে ১৯ হাজার মানুষ মারা যায়। এর মধ্যে ১৮ বছরের নিচে শিশু প্রায় ১৪ হাজার ৫০০। এদের মধ্যে আবার ১০ হাজারের বয়স পাঁচ বছরের নিচে। এক থেকে পাঁচ বছর বয়সী মোট শিশুমৃত্যুর ৫৮ শতাংশই পানিতে ডুবে হয়। সকাল নয়টা থেকে বেলা একটা পর্যন্ত মায়েদের কাজের ব্যস্ততার সময় ৬০ শতাংশ মৃত্যু ঘটে”। বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে, জনসংখ্যার অনুপাতে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি শিশু পানিতে ডুবে মারা যায় বাংলাদেশে। গবেষকদের মতে রোগে ভুগে মৃত্যুর চেয়ে আমাদের দেশে পানিতে ডুবে মৃত্যুর হারই বেশি।
আমাদের দেশে পুকুর ডোবা জলাশয়গুলো সাধারণত উন্মুক্ত থাকে। এমনকি ঘরের পাশের পুকুর ডোবাগুলোতেও কোনো ধরণের ঘেরা দেয়া থাকে না। গ্রামাঞ্চলের গৃহিণীরা সাধারণত সকালের দিকে ঘরের বিভিন্ন কাজ কর্মে ব্যস্ত থাকে। পুরুষেরা চাষাবাদ বা বিভিন্ন কায়িক পরিশ্রমে ব্যস্ত থাকে। ভাই বোনেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বা বিভিন্ন কাজকর্মে ব্যস্ত থাকে। পাশাপাশি ছোট শিশুরা খেলাধুলায় মগ্ন থেকে অবাধে এদিক সেদিক ছুটোছুটি করতে গিয়ে পুকুর ডোবা জলাশয়ে অবাধে চলে যায় এবং মায়েদের এবং অন্যদের অসতর্কতায় বা নজরদারীর অভাবে শিশুরা পানিতে ডুবে মারা যায়। এখানে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের অবহেলা উদাসীনতা খামখেয়ালীও কম দায়ী নয়। আমাদের দেশে প্রতি বছর কক্সবাজার এবং ইনানী সৈকতে গোসল করতে নেমে বিভিন্ন বয়সের মানুষের সলিল সমাধি ঘটে থাকে। পাশাপাশি নৌকা ভ্রমণ, নৌকায় যাতায়াত এবং নদী ও পুকুরে গোসল করতে নেমে অসাবধানতাবশত এবং সাঁতার না জানার কারণে অনেকেই মৃত্যু বরণ করে। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ হলেও দখল দূষণে ভরাট হয়ে যাওয়ায় বা নাব্যতা কমে যাওয়ায় বেশিরভাগ নদী শুকিয়ে গেছে। পাশাপাশি পুকুর দীঘি ডোবা জলাশয় খাল বিল মাঠ প্রান্তর দখল করে অপরিকল্পিত আবাসস্থলসহ বিভিন্ন ধরণের স্থাপনা গড়ে উঠছে। ফলশ্রুতিতে সাঁতার শেখার ক্ষেত্র ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। পাশাপাশি বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেই খেলার মাঠ এবং পুকুর। এমতাবস্থায় মাধ্যমিক স্কুলে শরীরচর্চার সঙ্গে সাঁতার শেখানো বাধ্যতামূলক করা এখন খুবই জরুরি । শহর ও মফস্বলে সাঁতার শেখানোর জন্য উন্মুক্ত সুইমিংপুল নির্মাণ করা জরুরি। পাশাপাশি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠাগুলোর মধ্যে সাঁতার প্রতিযোগীতা আয়োজন করা উচিৎ যাতে সাঁতার শেখার জন্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে আগ্রহ উৎসাহ এবং উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়।
আমাদের দেশে শিশুমৃত্যু রোধ, পুষ্টি ইত্যাদি খাতে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বড় বিনিয়োগ থাকলেও পানিতে ডুবে মৃত্যু রোধে তৎপরতা একেবারেই কম। এক তথ্য থেকে জানা যায়,“পানিতে ডোবার পর পর ২–৩ সেকেন্ড অক্সিজেনের অভাব শিশুদের ওপর বেশ নেতিবাচক প্রভাব ফেলে”। এ বিষয়ে অভিভাবকদের স্বাস্থ্য সচেতনতার জন্য স্থানীয় কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে অভিভবাকদের করণীয় সম্পর্কে ধারণা দেয়ার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে এলাকাভিত্তিক কমিটি করা, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে প্রচার প্রচারণা চালানো, স্থানীয় বিভিন্ন সামাজিক ও ক্রীড়া সংঘটন এবং মসজিদের ইমামদেরকে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট করা,পাড়া মহল্লায় পোষ্টার ফেস্টুনের মাধ্যমে এবং ইলেকট্রনিক ও প্রিন্টিং মিডিয়ার মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা সময়ের দাবী। সর্বোপরি অভিভাবকদের তত্ত্বাবধানে এলাকাভিত্তিক দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপন এবং গ্রামে মায়েরা গৃহস্থালি কাজে ব্যস্ত থাকার সময় শিশুদের নজরে রেখে পানিতে ডোবা প্রতিরোধে সম্মিলিত উদ্যোগ নেওয়ার ওপর জোর দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। কেননা “মানুষের মনে একবার যদি গেঁথে যায় প্রতিরোধের কাজটি তাঁরও দায়িত্ব, তাহলে এলাকার শিশুদের দেখভাল করে নিরাপদে রাখতে সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেবেন”{সূত্রঃ প্র/ আলো, ২৫ জুলাই’২২}। একজন মানব শিশুর সুন্দরভাবে নির্ভয়ে এবং নিরাপদে গড়ে উঠার জন্য তার জীবনের জন্য প্রতিটি মুহূর্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একথা অনস্বীকার্য যে, শিশুদের পানিতে ডুবে মৃত্যু ক্রমশ একটা নীরব মহামারি মতো সমস্যায় পরিণত হচ্ছে।
একজন চিকিৎসা বিশেষজ্ঞের বরাতে জানা যায়, “পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যুকে এখনো বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় না। ফলে এ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে কোন মন্ত্রণালয় কী কাজ করবে, তা নিয়ে জটিলতায় পড়তে হয়েছে”। ফলশ্রুতিতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, তথ্য সম্প্রচার মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সকল সরকারী প্রশাসনের মাধ্যমে একটি সুষ্ঠু এবং কার্যকরী নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে স্থানীয় জনগোষ্ঠিকে সম্পৃক্ত করে জনসচেতনতা এবং শিক্ষার মাধ্যমে দুর্ভাগ্যজনক অনাকাঙ্ক্ষিত অনভিপ্রেত পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে। আজকের শিশু দেশের আগামীর ভবিষ্যৎ কান্ডারী তাদের এহেন অপমৃত্যু দেশ জাতি এবং রাষ্ট্রের জন্য সুখকর নয়। বরং তা উদ্বেগ আতঙ্ক এবং শঙ্কার।
সম্পাদক ও প্রকাশক: রফিকুল ইসলাম
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-১৩১০