মাদকাসক্তি এটি শুধু বাংলাদেশ নয় সমগ্র বিশ্বের প্রধান সমস্যাগুলোর অন্যতম একটি। বর্তমানে সমগ্র মানব জাতির জীবন ও সভ্যতার জন্য অত্যন্ত বড় হুমকি হিসাবে দেখা হচ্ছে মাদকাসক্তিকে। এটি একটি অভ্যাসগত রোগ এবং তা ধিরে ধিরে মানুষকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়। ড্রাগের কারণে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিঃশেষ হয়ে যায়। ক্রমশ ভোতা হয়ে পড়ে মননশক্তি। ক্ষিধে পায় না,ঘুম হয় না,হাসি কান্নার বোধ থাকে না,ওজন কমে যায় এবং অবশেষে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। ড্রাগ পৃথিবী বিধ্বংসী নিরাময়ের অযোগ্য জীবন হননকারী এইডস রোগ উৎপত্তির অন্যমত প্রধান কারণ। সুন্দর পৃথিবী গড়ার কারিগর,সম্ভবনাময় যুব সম্প্রদায়কে ধ্বংসের দিকে ধাবিত করছে এ ড্রাগ। দেশে বর্তমানে মোট জনসংখ্যার ৪ ভাগের ১ ভাগ এখন তরুণ, যাঁদের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে। সংখ্যায় ৪ কোটি ৭৪ লাখ অথ্যাৎ পৌনে ৫ কোটি। এর মধ্যে ২ কোটিরও বেশি তরুণ মাদকাসক্ত। যা খুবই আশংকার বিষয়। সবচেয়ে আশংকার বিষয় হচ্ছে, প্রতিবেশি দেশ সমূহ থেকে বানের জলের মত মাদক বাংলাদেশে ঢুকছে। বাংলাদেশের তরুণ সমাজকে ধ্বংস করার জন্য মায়ানমার ও ভারত সীমান্তে মাদকের কারখানা খোলা হয়েছে। এসব কারখানায় উৎপাদিত মাদক ভারতের তিন দিকের সীমান্ত দিয়ে এবং মায়ানমার সীমান্ত দিয়ে অবাধে বাংলাদেশে ঢুকছে।
ড্রাগের কারণে আজ বুকফাটা কান্নায় পৃথিবীর আকাশ বাতাস ভারি হয়ে যায়,আর্ত হাহাকারে রাতের অন্ধকার আরো নিঃসঙ্গ ও বেদনার্থ হয়ে ওঠে,পরিবার গুলোতে আজ অকালে শোকের ছায়া,শ্মশানের হাহাকার। কি সেই ভয়াবহ নেশা যা মায়ের বুক থেকে সন্তানকে ছিনিয়ে নেয় চিরতরে। আজ অধিকাংশ পরিবারেই এক ভয়ংকর আতংক ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা আজ এমনই এক রুঢ় নিষ্টুর সময়ের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছি। শিকার হয়েছি এক গভীর ষড়যন্ত্রের। যুদ্ধ পৃথিবীকে করেছে ধ্বংসস্তুপে। জীবানু যুদ্ধ,রাসায়নিক যুদ্দের পর এবার ড্রাগ বা নেশার যুদ্ধ। এই নেশাযুদ্ধের কবলে পড়েছে লক্ষ লক্ষ তরুণ প্রজন্ম। মৃতকল্প করে চলেছে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে। অসার করে দিচ্ছে আমাদের প্ল্যান পরিকল্পনা। যুব সমাজই দেশ ও পৃথিবীর প্রাণ। কিন্তু তারা নেশার ঘোরে ঢলে পড়ছে মৃত্যুর কোলে। বিশ্বের সাথে পাল্লা দিয়ে ড্রাগ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশের শহরে,নগরে,গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। যা রীতি মত আতঁকে উঠার মতো। ভাবিয়ে তুলেছে দেশের অভিভাবক সহ সচেতন জনসাধারণকে। বাংলাদেশে বর্তমানে সরকারী হিসাবে প্রায় ১ কোটি মাদকাসক্ত লোক বসবাস করে। কিন্তু বেসরকারী নানা পরিসংখ্যানে এ সংখ্যা ২ কোটির উপরে। ধুমপায়ীসহ এসংখ্যা আরো কয়েকগুন হতে পারে। তারাই দেশের উন্নতি ও অগ্রগতির মূল অন্তরায়। নীচে সাম্প্রতিক জরিপে প্রাপ্ত কিছু তথ্য দেয়া হলঃ-
# বাংলাদেশে বর্তমানে ২ কোটি লোক মাদকাসক্ত। এর মধ্যে ৭৫ ইয়াবা আসক্ত। আর ২৫ ভাগ গাজা, ফেন্সিডিলসহ অন্যান্য মাদকে আসক্ত।
# দেশে মাদকাসক্ত অন্তত ১ কোটি, বেড়েছে নারী মাদকসেবীর সংখ্যা: পরিসংখ্যান
বেসরকারি সংস্থা মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থার (মানস) হিসেবে দেশে মাদকাসক্ত অন্তত এক কোটি। ৫ বছরে এই সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৩০ লাখ। গবেষকরা জানিয়েছেন, জিরো টলারেন্সের কথা বলা হলেও আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে মাদকাসক্তের সংখ্যা। অভিযোগ আছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যোগসাজশেই চলছে মাদক ব্যবসা। খুব সহজেই পাওয়া যাচ্ছে ইয়াবা, কোকেন ও ক্রিস্টালের মতো ভয়ংকর মাদক।
পাড়া-মহল্লা সবখানেই মাদকব্যবসায়ীদের বিস্তৃত নেটওয়ার্ক। ফেনসিডিল, ইয়াবা, কোকেন কিংবা হালের ক্রিস্টাল মেথ-আইস, সব ধরনের মাদকই মিলছে দেশজুড়ে। চাইলে মিলছে হোম ডেলিভারিও।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের বার্ষিক প্রতিবেদন বলছে, ২০২২ থেকে ২০২৩-এর জুলাই পর্যন্ত মাদকাসক্ত হয়ে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে (রিহ্যাব) গেছেন অন্তত ৫০ হাজার মাদকসেবী। ৫ বছরে রিহ্যাবে চিকিৎসা নেওয়া নারী মাদকাসক্ত বেড়েছে ৫ গুণ। আর ১৫ ও তার কম বয়সী মাদকাসক্ত বেড়ে হয়েছে তিনগুণ, সংখ্যায় যা ৪৭ হাজার ৩৭৬ জন।
মানসের চেয়ারম্যান ও জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের উপদেষ্টা সদস্য ডা. অরূপরতন চৌধুরী বলেন, ‘করোনার সময় যখন সবকিছু বন্ধ ছিল, তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মাদকের কেনা-বেচা প্রচুর হারে বেড়েছে। এখন এক কোটি মাদকসেবী। একেকজন বছরে ৫৬ হাজার টাকা খরচ করে। সব মিলিয়ে ৮০ হাজার কোটি টাকা খরচ মাদকের পেছনে।’
মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের ঘোষণার ভেতরেই আশংকাজনক হারে বাড়ছে মাদকসেবীর সংখ্যা।
# কত প্রকার মাদক আছে দেশে?
দেশে এখন পর্যন্ত উদ্ধার হয়েছে ২৭ ধরনের মাদক। নিয়মিত সেবনের তালিকায় ১৮ ধরনের মাদকই বেশি। সবচেয়ে বেশি সেবন হচ্ছে ইয়াবা ও গাঁজা। নতুন আইন করেও কমানো যায়নি মাদকের ব্যাপকতা। অভিযান চালিয়ে সরবরাহ চ্যানেল কিছু সময়ের জন্য আটকানো গেলেও আসক্তরা মাদক পাচ্ছে নিয়মিতই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিবেশী দেশগুলোতে মাদকের প্রসার না কমলে বাংলাদেশেও এর ভয়াবহতা নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না। এ নিয়ে নীতিনির্ধারকদের একযোগে পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
২৭ রকম মাদক
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গবেষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নতুন চার ধরনের মাদকসহ বাংলাদেশে ২৭ ধরনের মাদক উদ্ধার হয়েছে। এগুলো হলো- ম্যাজিক মাশরুম, ডায়মিথাইলট্রিপ্টামাইন (ডিএমটি), লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইইথ্যালামাইড (এলএসডি), ক্রিস্টাল মেথ বা আইস বা মেথামফিটামিন, এস্কাফ সিরাপ, ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজা, হেরোইন, প্যাথিডিন, চোলাই মদ, দেশি মদ, বিদেশি মদ, বিয়ার, রেক্টিফায়েড স্পিরিট, ডিনেচার্ড স্পিরিট, তাড়ি, বুপ্রেনরফিন (টি.ডি. জেসিক ইঞ্জেকশন), ভাং, কোডিন ট্যাবলেট, ফার্মেন্টেড ওয়াশ (জাওয়া), বুপ্রেনরফিন (বনোজেসিক ইনজেকশন), মরফিন, ভায়াগ্রা, সানাগ্রা, টলুইন, পটাশিয়াম পারম্যাংগানেট ও মিথাইল-ইথাইল কিটোন।
এ ছাড়াও বিভিন্ন বৈধ ড্রাগ একসঙ্গে মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে মাদক। এসবও সেবন হচ্ছে দেদার।
# আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালান চক্রের নজর বাংলাদেশে:
মাদকাসক্তি বিষয়ক গবেষক ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. এমদাদুল হক বলেন, ‘ভৌগোলিকভাবেই বাংলাদেশ বিশ্বের তিনটি বৃহত্তম মাদক উৎপাদনকারী অঞ্চলের মাঝে পড়েছে। এটি একটি ‘স্যান্ডউইচ’ অবস্থা। গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গলে আছে মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড, গোল্ডেন ওয়েজ অঞ্চলের শীর্ষস্থানীয় দেশ ভারত এবং গোল্ডেন ক্রিসেন্ট অঞ্চলে আছে পাকিস্তান, ইরান ও আফগানিস্তান।’
তিনি আরও বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালানে তাই বাংলাদেশের ভূকৌশলগত গুরুত্ব অনেক। এ চক্রের সঙ্গে বাংলাদেশের মাদক কারবারিদের যোগাযোগটাও এ কারণে শক্তিশালী। শ্রীলঙ্কায় এর আগে মাদক নিয়ে বাংলাদেশি নারী-পুরুষ গ্রেফতার হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে ইয়াবা মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত পৌঁছে যায়। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও পাঠানোর চেষ্টা হয়েছে। বিমানবন্দরে অনেকেই গ্রেফতার হয়েছে ও হচ্ছে।
চলবে.........
ছানাউল্লাহ
সাংকবাদিক ও কলামিস্ট
সম্পাদক ও প্রকাশক: রফিকুল ইসলাম
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-১৩১০