কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী হিন্দু ধর্ম ছেড়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। ওই ছাত্রীর নাম সুপ্রিতী দত্ত তমা (২৪)। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী।
ইসলাম ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে স্বেচ্ছায় গত পাঁচ বছর আগে কালেমা পড়ে ধর্মান্তরিত হন তিনি। এরপর থেকে পরিবার, বন্ধু-বান্ধব ও স্বজনদের অগোচরে গোপনে ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করে আসছিলেন। অবশেষে গত ১৯শে অক্টোবর তিনি ঝিনাইদহের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে উপস্থিত হয়ে হলফনামায় স্বাক্ষর করে ধর্ম পরিবর্তনের ঘোষণা দেন।
পরদিন ২০শে অক্টোবর ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে তিনি বিষয়টি প্রকাশ্যে আনেন। হলফনামায় স্বাক্ষরকারী আইনজীবী আলমামুন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। ধর্মান্তরিত হয়ে তিনি নিজের নাম রেখেছেন ত্বহিরা তাসনিম আয়াত। তবে নওমুসলিম ওই ছাত্রী এখন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বলে তিনি নিজেই অভিযোগ করেছেন।
https://youtu.be/fgXYSoA9O70
সূত্র জানায়, নওমুসলিম ওই ছাত্রীর বাড়ি চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা পৌরসভার গোবিন্দপুরে। বাবার নাম শ্যামল দত্ত আর মায়ের নাম বন্ধনা দত্ত। ছোটবেলা থেকেই খুব ধর্মপ্রাণ ছিলেন তমা (আয়াত)। স্কুল থেকে ফেরার পথে নিয়মিত মন্দিরে গিয়ে প্রণাম করতেন তিনি। পরিবারের বিভিন্ন পূজার দায়িত্ব তাকেই পালন করতে হতো। স্কুল-কলেজে থাকা অবস্থায় ফ্যাশনেবল লাইফ লিড করতেন। বন্ধু-বান্ধবদের সংখ্যাও ছিলো প্রচুর। সেসময় মুসলিম সহপাঠীদের সাহচর্যে থেকে ইসলামের বিভিন্ন রীতিনীতি দেখে তিনি মুগ্ধ হতেন। এজন্য তিনি গোপনে ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন বিষয়াদি সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে শুরু করেন। স্কুলে থাকা অবস্থায় এলাকারই একটা মুসলিম ছেলে তার সহপাঠী ছিলো। সেই ছেলের মাধ্যমে তার মুসলিম পরিবারের সঙ্গে পরিচয় হয় তমার। তমার ভাষ্যমতে, ‘ওই ছেলের পরিবারটা খুবই দ্বীনি পরিবার। তার বাবা একটি মসজিদের খতিব, এলাকায় ভালো সুনাম আছে।’
সেই মুসলিম পরিবারের ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে চলার পরিবেশ দেখে ভালো লাগতো তমার। পরে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ইসলাম সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়াবলি পড়া এবং ওয়াজ শোনা শুরু করেন। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে তিনি ইসলাম ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন। একপর্যায়ে ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন বিষয়গুলো নিয়ে হিন্দু ধর্মের সঙ্গে তুলনা করা শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর মূর্তি ভেঙে দেয়ার ঘটনা আমার জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে। তিনি সব ছোট মূর্তিগুলো ভেঙে বড় মূর্তির হাতে কুঠার ধরিয়ে দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে কাফেররা এসে যখন জিজ্ঞাসা করলো মূর্তিগুলো কে ভেঙেছে, তখন ইব্রাহীম (আঃ)-বলেছিলেন বড় মূর্তির হাতে যেহেতু কুঠার আছে তাহলে মূর্তিগুলো সেই ভেঙেছে। পরে কাফেররা বললো সে তো মূর্তি, সে কীভাবে ভাঙবে? তখন ইব্রাহীম (আঃ)-বলেছিলেন, মূর্তির যখন ক্ষমতাই নেই, তাহলে কেন তাকে পূজা করতে হবে?’
এই ব্যাপারটা মারাত্মক প্রভাব ফেলে তমার উপর। যার ফলে হিন্দু ধর্মের প্রতি তার ভক্তি আর শ্রদ্ধা দিনের পর দিন কমতে শুরু করে। তিনি জানান, ‘কোন পূজা করতে গেলে আগের মতো পারতাম না। পূজা ঠিকই করতাম, কিন্তু মন থেকে ফিলিংস আসতো না। মূর্তি গুলোর দিকে একটানা তাকিয়ে থাকতাম। ভাবতাম, সৃষ্টি কীভাবে স্রষ্টাকে তৈরী করতে পারে আর একেকটা ঠাকুর দেখতে একেক রকম কেন?’ ধীরে ধীরে মুসলিমদের আচার-আচরণে আকৃষ্ট হন তমা। তিনি জানান, ‘যতটুকু ইসলাম সম্পর্কে জানতাম তা আমার ধর্মের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতাম। কত সুন্দর আবরণের মধ্যে থাকে মুসলিম নারীরা। এই বিষয়গুলো আমাকে খুব আকর্ষণ করতো। একটা সময় বুঝতে পারি ইসলামই শ্রেষ্ঠ ও সত্য ধর্ম। পরে ইন্টারমিডিয়েট পড়া অবস্থায় মসজিদের খতিবের মাধ্যমে কালেমা পড়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করি। তবে ভয়ে বাড়ির কাউকে কিছু জানাইনি তখন।’
ইসলাম গ্রহণের পর নানা পরিবর্তন শুরু হয় তমার মধ্যে। তিনি বলেন, ‘ইসলামী দ্বীনের বুঝটা আসার পর ধীরে ধীরে আমার মধ্যে পরিবর্তন শুরু হয়। তখন মাঝেমধ্যে সালাম দেয়া ও মাথায় কাপড় দেয়াসহ ইসলামী বিধান মানার চেষ্টা করতাম। এমনকি ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখা শুরু করি। স্কুল লাইফের সেই মুসলিম ছেলেটির প্রতি এক সময় দুর্বল হয়ে পড়ি। যখন বুঝতে পারলাম এটা হারাম সম্পর্কের দিতে যেতে পারে, তখন ওই ছেলের সঙ্গেও দূরত্ব বাড়িয়ে দিই।’
তমার মধ্যে পরিবর্তন দেখতে পেয়ে একসময় তার পরিবার সন্দেহ করতে শুরু করে। তমা বলেন, ‘পূজাতে ঠিকমতো উপস্থিত হই না, অঞ্জলির দিন অঞ্জলি দিতে চাই না এরকম বেশকিছু বিষয় পরিবারের লোকজন আমার মধ্যে লক্ষ্য করে। পরে তারা বিষয়টা নিয়ে সন্দেহ করা শুরু করে। একপর্যায়ে কোন একটা মাধ্যমে ২০১৭ সালের দিকে তারা বিষয়টি জেনে যায়। পরিবার তখন ভাবে হয়তো ওই ছেলের সঙ্গে আমার রিলেশন আছে আর সেজন্য আমি এতকিছু করতেছি। তারা বরাবরই ব্যাপারটা এভাবেই হাইলাইটস করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু আমি পরিবারের মুখের উপর বলেছিলাম আমি এক আল্লাহকে বিশ্বাস করি এবং তার ইবাদাত ছাড়া অন্যকিছু করবো না। সেসময় কিছু ক্ষমতাধর ব্যক্তিকেও আমার বাসায় আনা হয়। তারা বিভিন্ন মাধ্যমে আমাকে ব্রেন ওয়াশ করার চেষ্টা করে। আমি তাদের বলেছিলাম কোনোভাবে ইসলাম ধর্মকে ছাড়া থাকতে পারবো না। সে সময় তারা আমার কাছে বিভিন্ন সূরা-দোয়া-জিজ্ঞাসা করে। আমি সেসময় তাদের তাশাহুদ শুনিয়েছিলাম। আর বাড়িতে লুকিয়ে নামাজ-কালাম পড়ার কথা তাদের জানিয়েছিলাম। পরে আমাকে প্রচণ্ডভাবে মারধর করে রক্তাক্ত করে দেয়া হয়। মুখের মধ্যে ফেটে গেছিলো। খাবার খেতেও পারতাম না। তখন ওই ছেলের সঙ্গে আমার কোনরকম যোগাযোগ হতো না। তবুও পরিবার এই বিষয়টাই বারবার বলতো।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর গোপনে ইবাদাত করা শুরু করেন তমা। তিনি জানান, 'খোলামেলা জীবন যাপন একদমই ভালো লাগতো না। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর মানসিক শান্তি পেতাম না। মন চাইতো পর্দার মধ্যে থাকি এবং দ্বীনি কথা বার্তা শুনতে খুবই ভালো লাগতো। বিশ্ববিদ্যালয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে আবার কখনও ইশারায় সালাত সহ ইসলামের অন্যান্য বিধান আদায়ের চেষ্টা করতাম।'
ইসলাম সম্পর্কে জানতে মাদ্রাসায়ও ভর্তি হন তমা। তিনি জানান, ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে ইসলামিক অনলাইন মাদ্রাসায় ভর্তি হই। ভর্তির পর আরও ব্যাপকভাবে আমার মধ্যে পরিবর্তন আসতে শুরু করে। এই মাদ্রাসার মাধ্যমে সারা দেশের অসংখ্য দ্বীনি বোনের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। ক্লাসে ইসলাম সম্পর্কিত বিভিন্ন ঘটনাবলী, কুরআন-হাদিস যখন শুনতাম তখন অন্তরের মধ্যে অন্যরকম অনুভূতির সৃষ্টি হতো। আমি চাচ্ছিলাম আল্লাহ আমার ঈমান এমন মজবুত করে দিক, যেন আমার মধ্যে কোনো দুর্বলতা না কাজ করে। আমি যেন ঈমানী শক্তি নিয়ে প্রকাশ্যে আসতে পারি। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কিছুদিন আগে আমার বাবা মারা যায়। আমার জীবনে একটাই দুর্বলতা আমার মা। আমার আর কোনো ভাই বোনও নাই। প্রকাশ্যে আসা নিয়ে প্রচণ্ড খারাপ লাগা কাজ করতো। ভাবতাম আমার মা এই ধাক্কাটা নিবে কি করে। মা কে ছেড়ে থাকবো এটা ভাবতেই খুব খারাপ লাগতো। এজন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করতাম আমার মা কেও তুমি হেদায়েত দাও।
ধর্মান্তরিত হওয়ার জন্য কয়েকবার হলফনামার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন তমা। তিনি জানান, ‘বেশ কয়েকবার ধর্মান্তরিত হওয়ার জন্য হলফনামা করতে কোর্টে যাই। কিন্তু প্রত্যেকবারই একটা কথা বলা হয় কোন মাহরাম আছে কি না? আমাকে দায়িত্ব নেবে এমন কেউ না থাকায় নিরাপত্তার কথা ভেবে তারা দিতে রাজি হননি। পরে বিয়ের জন্য ভালো ছেলে খুঁজতে ইসলামিক দাওয়া’হ ইন্সটিটিউশনের পরিচালকের কাছে সিভি পাঠিয়ে দিই। বিয়ের জন্য দেখাশুনা খোঁজখবরের প্রয়োজন হয়। কিন্তু আমার একার পক্ষে সেটা খুব কষ্টকর হয়ে উঠে। পরে আমার ওই বন্ধুর পরিবারের কাছে গিয়ে বিষয়টি জানাই। তারা আমার চেনা জানা ছিলো এজন্য তাদেরকে জানিয়েছিলাম যে, সম্ভব হলে ভালো একটা ছেলে দেখতে। কিছুদিন পর তারা আমাকে তাদের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেয়ার ইচ্ছে পোষণ করেন। পরে কিছুদিন সময় নিয়ে ভেবেচিন্তে আমি তাতে মত দিই। আমার সম্মতিতে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে তাদের ছেলের সঙ্গে কালেমা পড়ে প্রাথমিকভাবে বিয়ে পড়িয়ে রাখে। এই বিষয়গুলো আমার বাড়িতে জানাজানি হয় যে, আমি মুসলমান হয়ে গেছি। অনেকেই আমার কাছে জিজ্ঞাসা করলেও নিরাপত্তার কথা ভেবে আমি পরিবাররে কাছে অস্বীকার করি। পরে বিষয়টি প্রকাশ্যে আনার জন্য চূড়ান্তভাবে হলফনামা করার সিদ্ধান্ত নিই। যেহেতু একটা আশ্রয়ের জায়গা দরকার এবং একটা দায়িত্ব নেয়ার মানুষ দরকার এজন্য ১৯শে অক্টোবর পুণরায় রেজিস্ট্রি করে বিয়ে সম্পন্ন করি।
তমা আরও জানান, আমার পরিবার আইনগতভাবে প্রভাবশালী। শুধু হলফনামা করেই নিরাপদ ফিল করছিলাম না। আশ্রয়েরও একটা দরকার ছিলো। সেজন্য আমি ১৯শে অক্টোবর ধর্মান্তরিত হওয়ার বিষয়ে হলফনামা করি। একইসাথে ওইদিনই বিয়ের রেজিস্ট্রি সম্পন্ন করে ফেলি। পরে আমি বাড়িতে বিষয়টি জানিয়ে দেই।
এখন মানসিকভাবে সুস্থ নেই তমা। তিনি জানান, পরিবারের সবাই আমার বিরুদ্ধে। আমি মানসিকভাবে খুব একটা সুস্থ নেই। বিভিন্নভাবে হ্যারাজমেন্ট করা হচ্ছে। আমি একটা পবিত্র কাজ করেছি। আমার তো এরকম ভাবে থাকার কথা না। তিনি আরও জানান, আমি সাধারণত কোনো ক্লাসই মিস করি না। আল্লাহর রহমতে রেজাল্টও ভালো। কিছুদিন পর আমার পরীক্ষা শুরু। কিন্তু ক্লাসে যেতে পারছি না। কবে যেতে পারবো সেটাও বুঝতে পারছি না।
বর্তমানে নানা ভাবে হেনস্তার শিকার হচ্ছেন নওমুসলিম ওই ছাত্রী। তিনি জানান, আমার পরিবার থেকে শ্বশুরবাড়ির লোকদের খুব বাজেভাবে হেনস্তা করা হচ্ছে। তারা ভাবছে আমি প্রেম করে বিয়ে করে পালিয়ে গেছি। তারা বিষয়টি অন্যদিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমি, আমার হাজবেন্ড এবং শ্বশুর বাড়ির লোকজন প্রত্যেকের জীবন এখন হুমকির মুখে। সবাইকে সম্মানহানি করা হচ্ছে। মিথ্যে অভিযোগে শ্বশুর বাড়িতে পুলিশ পাঠানো হচ্ছে এমনকি তাদের ব্যবসায়িক ক্ষতিসাধনসহ ঘর-বাড়ি ভেঙে দেয়ারও হুমকি দেয়া হচ্ছে। যেজন্য আমাদের এখন পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। আমি চাই যেন কাউকে হেনস্তা করা না হোক, আর কেউ যেন আমাকে ভুল না বোঝে। তিনি তার জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে আইনি সহায়তা কামনা করেছেন।
সম্পাদক ও প্রকাশক: রফিকুল ইসলাম
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-১৩১০