পর্ব-০২
প্রশ্নঃ বৈবাহিক প্রতারণার শাস্তি কি ?
উত্তরঃ কাবিননামা সম্পন্ন না করে বিয়ে করে পরে তা অস্বীকার করলে সংক্ষুব্ধ পক্ষ দণ্ডবিধির অধীনে ফৌজদারি আদালতেরও আশ্রয় নিতে পারে ।
বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৪৯৩ ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি যদি কোনো নারীকে প্রতারণামূলকভাবে আইনসম্মত বিবাহিত বলে বিশ্বাস করান, কিন্তু আদৌ ওই বিয়ে আইনসম্মতভাবে না হয় এবং ওই নারীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করেন, তবে অপরাধী ১০ বছর পযর্ন্ত যে কোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং অথদণ্ডে দণ্ডিত হবে ।
বাংলাদেশ দন্ডবিধি আইনের ৪৯৬ ধারায় বলা অছে, আইনত বিবাহ নয় জেনেও প্রতারণার উদ্দেশ্যে বিবাহের অনুষ্ঠান উদযাপন করা তাহলে অপরাধী সাত বছর পর্যন্ত সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদন্ডে দন্ডিত হবেন । তবে জামিন যোগ্য ধারার অপরাধ।
বাংলাদেশ দন্ডবিধি আইনের ৪৯৮ ধারায় বলা আছে, অপরাধজনক উদ্দেশ্যে বিবাহিত নারীকে ফুসলিয়ে নিয়ে যাওয়া বা আটক রাখা হলে অপরাধী ব্যক্তি দুই বছর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ড এবং অর্থদণ্ডসহ উভয় ধরণের শাস্তি পাবে । তবে জামিন যোগ্য ধারার অপরাধ । যদি অন্য কোন ধর্মের ব্যক্তি নিজেকে মিথ্যা ধর্মের পরিচয় দিয়ে ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির মাধ্যমে অন্য ধর্মের কোন মেয়েকে বিবাহ করে, পরে তা প্রকাশ পায় যে, সে অন্য ধর্মের । এইসব ক্ষেত্রে উক্ত ধারায় অপরাধ সংঘটিত হবে ।
প্রশ্নঃ ধর্ষণের শাস্তি কি?
উত্তরঃ ১৬ বছরের কম বয়সী কোন মেয়ের সাথে তার সম্মতিতে বা সম্মতি ছাড়া বিয়ে ছাড়া যেকোন ভাবে শারীরিক সম্পর্ক (যৌন সম্পর্ক) স্থাপণ করেছে, প্রমাণিত হলে তা ধর্ষণ বলে গণ্য হবে । ১৬ বছরের নীচে বয়সের কোন মেয়ের অনুমতি বা সম্মতি প্রদানের কোন ক্ষমতা নেই ।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ২০১০ এর ৯(১) উপধারাতে বলা আছে যদি কোন পুরুষ কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তাহা হইলে তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবে এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবে ৷ ৯(২) উপধারাতে বলা আছে যদি কোন ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ষণ বা উক্ত ধর্ষণ পরবর্তী তার অন্যবিধ কার্যকলাপের ফলে ধর্ষিতা নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে, তাহলে উক্ত ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অন্যুন এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবে ৷ যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষন করে এবং ধর্ষণের ফলে উক্ত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে বা তিনি আহত হন, তাহলে ৯ (৩) উপধারা মতে ঐ দলের প্রত্যেক ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবে এবং ইহার অতিরিক্ত অন্যুন এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবে ৷ যদি কোন ব্যক্তি কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করিয়া মৃত্যু ঘটানোর বা আহত করার চেষ্টা করে, তাহলে ৪(ক) উপধারা মতে উক্ত ব্যক্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবে এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবে । আর ধর্ষণের চেষ্টা করলে তাহলে উক্ত ব্যক্তি ৪(খ) উপধারা মতে অনধিক দশ বৎসর কিন্তু অন্যুন পাঁচ বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবে এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবে ৷ এছাড়া কোন মেয়ের বয়স চৌদ্দ বছরের নিচে হলে তার অনুমতি না নিয়ে যৌন সম্পর্কে গেলে একজন পুরুষকে বাংলাদেশ দন্ডবিধির ১৮৬০ সালের ৩৭৫ ধারা অনুসারে- ‘ধর্ষণকারী ’ হিসেবে গণ্য করা হবে ।
প্রশ্নঃ তালাকের নোটিশের নিয়ম কি ?
উত্তরঃ মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশ ১৯৬১-এর আইন অনুযায়ী তালাক কার্যকর করার ক্ষেত্রে মুখে উচ্চারণের পাশাপাশি চেয়ারম্যান (ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, পৌরসভার চেয়ারম্যান, সিটি কর্পোরেশনের মেয়র বা প্রশাসক, সেনানিবাস এলাকায় এই অধ্যাদেশের অধীনে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনের জন্য সরকারের নিয়োগ করা) বরাবর লিখিত নোটিশ পাঠাতে হয় । চেয়ারম্যানের কাছে পাঠানো তালাক নোটিশের একটি অনুলিপি তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকে পাঠাতে হবে । তারপর এই নোটিশ পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে দুই পক্ষের পুনঃমিলনের উদ্দেশ্যে চেয়ারম্যান সালিশি কাউন্সিল তৈরি করে দুই পক্ষের পুনঃমিলনের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে । যদি দুই পক্ষের মধ্যে কোনোভাবেই পুনঃমিলন সম্ভব না হয় তবে তালাক নোটিশ প্রদানের তারিখ হতে ৯০ দিনের মধ্যে তালাক কার্যকর হয়ে যাবে । এই ৯০ দিন পর্যন্ত স্ত্রীর ভরণপোষণ ও অন্যান্য খরচাপাতি বহন করবেন স্বামী । তালাকের ক্ষেত্রে একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে যে, যদি তালাক দেওয়ার সময় স্ত্রী গর্ভবতী হয়ে থাকে তবে তার গর্ভাবস্থার পরিসমাপ্তি না হওয়া পর্যন্ত অর্থাৎ সন্তান ভূমিষ্ঠ না হওয়া পর্যন্ত তালাক কার্যকর হবে না ।
প্রশ্নঃ তালাকের পর নারী নির্যাতনের অভিযোগ কি চলে?
উত্তরঃ নারী নির্যাতনের ঘটনার পর তালাক দিলে নারী নির্যাতন আইনে মামলা চলবে । তবে তালাকের পর ঘটনা হলে যৌতুকের জন্য নির্যাতনের মামলা চলবে না, বাংলাদেশ দন্ড বিধিতে চলবে । স্ত্রীর সম্পদ, সমস্ত মালামাল, সারটিফিকেট ইত্যাদি আটকিয়ে রাখলে তালাকের পরেও পারিবারিক সহিংসতা আইনে মামলা হবে ।
প্রশ্নঃ ব্যভিচার করলে ও অপরাধজনক উদ্দেশ্যে বিবাহিত নারীকে ফুসলিয়ে নিয়ে যাওয়া বা আটকিয়ে রাখার শাস্তি কি?
উত্তরঃ বাংলাদেশ দন্ডবিধি আইনের ৪৯৭ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি এমন কোনো নারীর সঙ্গে স্বামীর সম্মতি ব্যতীত যৌন করেন এবং অনুরূপ যৌনসঙ্গম যদি র্ধষণের অপরাধ না হয়, তাহলে সে ব্যক্তি ব্যভিচারের দায়ে দায়ী হবেন, যার শাস্তি সাত বছর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ড-সহ উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে । এই ধারায় ব্যভিচারী নারীর কোন শাস্তি নেই । দন্ডবিধি ৪৯৮ ধারায় বলা অছে, অপরাধজনক উদ্দেশ্যে বিবাহিত নারীকে ফুসলিয়ে নিয়ে যাওয়া বা আটক রাখা হলে অপরাধী ব্যক্তি দুই বছর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ড এবং অর্থদণ্ডসহ উভয় ধরণের শাস্তি পাবেন । তবে জামিন যোগ্য ধারার অপরাধ । যদি কোন ব্যক্তি যেকোন বয়সের কোন নারীকে তার সম্মতিতে অথবা সম্মতি ছাড়া আইনানুগ অভিভাবক অর্থাৎ বাবা, ভাই, স্বামীর অধীন থেকে ভালবেসে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে নিয়ে যায়, তবে সেক্ষেত্রে উক্ত ব্যক্তি উক্ত নারীকে অপহরণ করেছে বলে গণ্য হবে এরূপ অপরাধের জন্য মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন ২০১২ এর ১০(১) উপধারার মতে উক্ত ব্যক্তি অনধিক ১০ (দশ) বৎসর এবং অন্যূন ৫ (পাঁচ) বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডে এবং অন্যূন ২০ (বিশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে । দন্ডবিধির ৩৬৬ ধারায় বলা হয়েছে যদি কোন ব্যক্তি নারীকে অপহরণ করে বা অপহরণ করার উদ্দেশ্য হয় অথবা অপহরণ করার ফলে জানা যায় যে, সে নারীকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন ব্যক্তিকে বিবাহ করতে বাধ্য করা অথবা তাকে অবৈধ সহবাসে জোরপূর্বক বা ফুসলিয়ে অথবা ক্ষমতার অপব্যবহার দ্বারা বাধ্য করিলে উক্ত ব্যক্তি দশ বছর পর্যন্ত যেকোন মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হবে এবং তদপুরি অর্থদন্ডেও দন্ডিত হবে ।
প্রশ্নঃ পারিবারিক সহিংসতার শিকার নারী ও শিশুর নিরাপত্তা বা আইনী প্রতিকার কোথায় পাওয়া যাবে?
উত্তরঃ সরকারী হাসপাতালে ও.সি.সি ওয়ার্ডে ভর্তি হলে চিকিৎসা-সহ সরাসরি মামলা / এজাহার দায়ের করার ব্যবস্থা রয়েছে, ভিকটিম বা সংবাদদাতাকে থানায় যেতে হবে না । একজন পুলিশ অফিসার, মানবাধিকারকর্মী চিকিৎসা সেবার সনদপত্র নিয়ে মামলার উদ্যোগ নিবেন । যেখানে ও.সি.সি নেই সেখানে সরাসরি থানায় মামলা দায়ের করতে হবে। থানায় মামলা না নিলে সরাসরি মিডিয়াকর্মী, বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অথবা সোশ্যালমিডিয়ার সাহায্য নিতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে হটলাইন ১০৯ ও পুলিশি সহায়তার জন্য ৯৯৯ আরও বেশি কার্যকর করতে হবে এবং ইমেইল এর মাধ্যমে জি.ডি করার বিধানও রয়েছে । পারিবারিক সহিংসতার অপরাধের বিচার হবে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট অথবা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে । উক্ত আইনের অধীন আদালত ভিকটিমকে সুরক্ষা আদেশ অথবা নিরাপদ হেফাজতে রাখার আদেশ দিতে পারেন । সুরক্ষার আদেশ লঙ্ঘন করলে কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে । পারিবারিক সহিংসতা আইনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ভিকটিমকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিধান যার ফলে এই আইনকে নারী ও শিশুবান্ধব আইন বলা অযৌক্তিক হবে না । ক্ষতিপূরণের পরিমাণ কেমন হবে তা আইনে নির্দিষ্ট না করে ম্যাজিস্ট্রেটের সুবিবেচনার ওপর অর্পণ করেছে । ম্যাজিস্ট্রেট যা ন্যায়সঙ্গত মনে করবেন সে পরিমাণ ক্ষতিপূরণ প্রদানের আদেশ প্রদান করতে পারবেন ।
প্রশ্নঃ মোহরানা ও যৌতুকের পার্থক্য কি?
উত্তরঃ একজন নারীর সবকিছু আপনার জন্য বৈধ বা হালাল হওয়ার অন্যতম একটি শর্ত হচ্ছে মোহর। যা পরিশোধ করা আপনার ওপর ফরজ। সংসার জীবন পবিত্র ও সুখময় না হওয়ার অন্যতম একটি কারণ স্ত্রীকে তার প্রাপ্য মোহর পরিশোধ না করা ।যৌতুক হলো সেই ব্যবস্থা যার মাধ্যমে কন্যাদের পাত্রস্ত করার জন্য অভিভাবকদের স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় বিপুল পরিমাণ অর্থ বা তার সমমূল্যের সামগ্রী উপঢৌকন হিসেবে পাত্র পক্ষকে প্রদান করতে হয়। এতে কন্যা পক্ষের আর্থিক বিনষ্ঠ হয়। এটাই হলো যৌতুক।
প্রশ্নঃ মোহরানা খোরপোষ ও সন্তানের অভিভাবকত্বের মামলা কোথায় করতে হয়?
উত্তরঃ পারিবারিক আদালতে মামলা করতে হয় । পারিবারিক আদালতে ১) মোহরানা, ২) খোরপোষ, ৩) সন্তানের অভিভাকত্ত্ব, ৪) সন্তানের অভিভাকত্ত্ব, ৫) দাম্পত্য পুনঃরুদ্ধার সম্পর্কের অধিকার ৬) বিবাহ বিচ্ছেদ ।
প্রশ্নঃ পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ আইন ২০১০ এ কে কে প্রতিকার পাবেন?
উত্তরঃ যৌতুক দাবি, দ্বিতীয় বিবাহের অনুমতি না পাওয়া, স্বামী ছাড়া পরিবারের অন্য কোনো পুরুষ সদস্য কর্তৃক কুপ্রস্তাবে রাজি না হওয়া, ছেলেসন্তান লাভের প্রত্যাশা, মাদকাসক্ত স্বামী ইত্যাদি কারণে একজন নারী পারিবারিকভাবে মারাত্মক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হলে ।স্বামী-স্ত্রীর বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটলেও অনেক সময় সৎ মা অথবা সৎ বাবা কর্তৃক শিশু নির্যাতনের শিকার হলে, বয়ঃসন্ধিকালীন শিশুরা তাদের পরিবারের প্রাপ্তবয়স্কদের দ্বারা মানসিক নির্যাতনের শিকার হলে । পিতা-মাতা সন্তানের কাছ থেকে ভরণ-পোষণ না পেলে, রক্তের সম্পর্ক, বৈবাহিক সম্পর্ক অথবা যৌথ পরিবারে একসঙ্গে থাকা হয় এরকম কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে পারিবারিক সহিংসতার প্রতিকার চেয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।
লেখকঃ আইনজীবী, কলামিস্ট, মানবাধিকার ও সুশাসনকর্মী।