
-মোহাম্মদ মাহাবুবুর রহমান ঃ
.
জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন, মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও আইন সংক্রান্ত বিভিন্ন মৌলিক ধারণার সুতিকাগার হল প্রাচীন গ্রীস। এটা অবাক করার মত বিষয় যে আইন পেশার চর্চাও শুরু হয় প্রাচীন গ্রীক নগররাষ্ট্র এথেন্সে।তবে বর্তমানে এই মহৎ পেশাটি যে অবস্থায় আছে ঠিক সেভাবে চর্চা হতো না । শুরুতে কারো পক্ষ হয়ে আইনগত সহায়তা প্রদান করা টা আদালতে মেনে নেয়া হত না ।নিজের মামলা নিজকেই পরিচালনা করতে হতো। কিন্তু ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠ জন ও বন্ধু-বান্ধবদের সহায়তা নেয়াটা রীতিতে পরিণত হয় ।যারা বন্ধু হয়ে আদালতে আইনগত সহায়তা প্রদান করতেন তাঁদেরকে ওর্যাটর বলা হতো। পবিত্র কর্ম বিবেচনায় ওর্যাটররা কোন রকম ফি নিতে পারতেন না । ওর্যাটররা কোন প্রকার পারিশ্রমিক বা ফি ছাড়াই বন্ধু-বান্ধব ও পরিচিতজনদেরকে আইনগত সহায়তা দিতে পারতেন । এই রীতি বা নিয়ম কখনো বিলুপ্ত করা না হলেও বাস্তবতার নিরীখে তা সব সময় কঠোরভাবে পালন করা হত না ।
প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যেই আইনজীবীদেরকে অ্যাডভোকেট বলে সম্বোধন করা হতো। তাঁরা আইনের উপর পড়াশুনা করতেন না । বরং রিটরিক-এর উপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতেন । রিটরিক হল আদালত কিংবা শ্রোতাকে যুক্তি দ্বারা বুঝানোর বিশেষ কৌশল। তবে বিচারকার্যে সহায়তার জন্য আইনের ব্যাখ্যা -বিশ্লেষণে পারদর্শী জুরিস্কনসাল্ট নামক একটি বিশেষ শ্রেণী সৃষ্টি করা হয়। রোমের সম্পদশালী ব্যক্তিরা নিজেরা শখের বশে এই বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা করতেন। তাঁরা এই কাজকে কখনোই নিজেদের জীবিকা অর্জনের পন্থা হিসেবে ব্যবহার করতেন না । প্রাথমিক অবস্থায় অ্যাডভোকেটরা ওর্যাটরদের মত কোন ফি নিতে পারতেন না ।সম্রাট ক্লদিয়াস খ্রিঃ পূ ২০৪ সনে আইন পেশাকে আইনগত স্বীকৃতি দেন ।একই সাথে আইন জীবীদের ফি নেয়াটাকে বৈধতা প্রদান করেন। তবে তিনি দশ হাজার সেসটেররেস-এর একটি সিলিং আরোপ করেন। এটা ঐ সময়ে পরিমাণে খুব বেশি অর্থ নয় । তৎকালীন রোমান কবি জুভেনাল তাঁর স্যাটায়ারে উল্লেখ করেন যে অ্যাডভোকেট হিসেবে কাজ করতে গেলে কোন টাকা পাওয়া যায় না । রোমে রিপাবলিকানদের শাসনের সময় এবং প্রাচীন রোমান সম্রাটদের রাজত্বকালে প্রাথমিকভাবে জুরিস্কনসাল্ট ও অ্যাডভোকেটগণ আইনী কাঠামোর আওতায় ছিলেন না । কারণ জুরিস্কনসাল্টগণ ছিলেন সৌখিন পেশাজীবী ।আর অ্যাডভোকেটগণের পেশা আইনগত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল না ।
বাইজানটাইন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রারম্ভে আইন পেশা সুদৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড়ানোর সুযোগ পায়। সম্রাট হাদ্রিয়ানের সময় অ্যাডভোকেটগণের পেশাগত চর্চা অনেকখানি এগিয়ে যায় । এই সময় অ্যাডভোকেটরা রিটরিকের পাশাপাশি আইন বিষয়ে অধ্যয়ন করতে থাকে। ফলে আলাদা শ্রেণী হিসেবে জুরিস্কনসাল্টদের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমতে থাকে । চতুর্থ শতাব্দীতে অ্যাডভোকেটগণের এনরোলমেন্টের বিধান চালু হয়।একজন অ্যাডভোকেট কেবলমাত্র একটি আদালতের বারে এনরোলমেন্ট করতে পারতেন। ৪৬০ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট লিউ আইন প্রণয়ন করেন যে , আইনজীবী হিসেবে কাজ করতে চাইলে নব্য অ্যাডভোকেটগনকে তাঁদের শিক্ষক কর্তৃক প্রদত্ত প্রশংসাপত্র জমা দিতে হবে । ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যে নিয়ম চালু হয় যে, আইন পেশায় নিযুক্ত হওয়ার জন্য চার বছরের কোর্স সম্পন্ন করতে হবে।
বর্তমানে যে নোটারিয়ানরা নিরলসভাবে মানবসেবা করে যাচ্ছেন তাঁদের পূর্বসূরিদের যাত্রাও শুরু হয় প্রাচীন রোমে।তাঁদেরকে ট্যাবেলিয়নও বলা হতো। প্রতিটি এলাকাতে অন্ততঃ একজন নোটারিয়ানের দেখা পাওয়া যেত। আধুনিক উত্তরসূরিদের মত তাঁরা উইল,চুক্তি ও অন্যান্য দলিলাদি মুসাবিদা ও প্রত্যয়ন করতেন। পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর ইউরোপে আইন চর্চা এবং আইনপেশায় ধ্বস নামে । ১১৪০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রকৃত অর্থে কোন আইনজীবী আর পরিলক্ষিত হয় না।১১৫০খ্রিস্টাব্দের পর থেকে কিছু কিছু লোক ক্যানন ল –এর উপর অধ্যয়ন করা শুরু করে । কেউ কেউ যথেষ্ট ব্যুৎপত্তিও লাভ করেন।১১৯০ খ্রিস্টাব্দ থেকে শুরু ১২৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়টা ইউরোপের আইন চর্চায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । রাষ্ট্র এবং গির্জার পৃষ্ঠপোষকতায় আইনপেশা আবার ঘুরে দাঁড়ায় ।১২৩১ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের দুটি কাউঞ্চিল বিশপের আদালতে আইনজীবী হিসেবে কাজ করার আগে শপথ নেয়াটা বাধ্যতামূলক করে । ইংল্যান্ডে ১২৭২ -১৩০৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রাজা এডওয়ার্ড প্রথম- এর রাজত্বকালে আইনপেশার উৎপত্তি হয়।১৬৭২ খ্রিস্টাব্দে বোম্বেতে আদালত প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে উপমহাদেশে আইনপেশার শুভসুচনা হয় । তবে ১৭২৬ খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাজ এবং কলকাতায় মেয়র কোর্ট স্থাপনের পূর্বে সত্যিকাররের লিগ্যাল প্র্যাকটিস বলতে যা বুঝায় তা চালু হয় নি ।
এই ভারতীয় উপমহাদেশে ১৮৪১ সনে বানারসে সর্ব প্রথম আইনজীবী সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয় । ঐ সময়ে চট্টগ্রাম বারের অস্তীত্ব না থাকলেও আইনজীবীগণ উকিল এবং মোক্তার হিসেবে আলাদা আলাদা পেশাজীবী সংগঠন গড়ে তোলেন। এই সংগঠনগুলোকে ১৮৯৩ সালে জন্ম নেয়া চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির পূর্ববর্তী প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত করা যায় । বোস্টন বার ,নিউ ইয়র্ক সিটি বার , পুয়ের্তো রিকো বার ও অন্যান্য কয়েকটি বার ব্যতীত যুক্তরাষ্ট্রের বেশির ভাগ বার চট্টগ্রাম বারের তুলনায় একেবারেই নতুন। এমন কি অস্ট্রেলিয়া,আফ্রিকা ইউরোপ ও ল্যাতিন আমেকিার প্রায় সব বারই চট্টগ্রাম বারের পরে প্রতিষ্ঠিত। এই বিষয়টি গর্ব করার মত। আর এই বার যেন চট্টগ্রামের বুদ্ধিবৃত্তিক আভিজাত্য ও প্রাগ্রসর চিন্তা-চেতনার প্রতীক। যুক্তরাষ্ট্রের ফাওন্ডিঙ ফাদারদের একজন হলেন জন এডামস্। তাঁর নেতৃত্বে অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বোস্টনে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে পুরনো বার প্রতিষ্ঠিত হয়। কাজেই যে সতের মহান ব্যক্তি চট্টগ্রাম বারের সুচনা করেন তাঁরা যেন অন্যতম ফাওন্ডিঙ ফাদার জন এডামস্-এরই উত্তরসূরি।
যুক্তরাষ্ট্রের সাত জন ফাওন্ডিঙ ফাদারদের মধ্যে জন এডামস্ , আলেকজান্ডার হ্যামিলটন ও টমাস জেফারসন আইনজীবী ছিলেন । যে সতের মহান ব্যক্তি নিয়ে চট্টগ্রাম বারের জন্ম হয় যুক্তরাষ্ট্রের ফাওন্ডিঙ ফাদারদের তুলনায় তাঁদের অবদানকে খাটো করার সুযোগ নেই।বরং উদ্দেশ্য বিবেচনায় সতের জন আইনজীবীকে এগিয়ে রাখতে হয় ।কারণ ফাওন্ডিঙ ফাদারদের মূল লক্ষ্য ছিল ব্যবসায়িক সুবিধা । কিন্তু বার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল ন্যায়বিচার সমাজে নিশ্চিত করা । প্রতিষ্ঠা লাভের পর থেকে একে একে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন,ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধে এই বারে সদস্যরা গৌরবময় ভূমিকা পালন করেছেন। শুধু তাই নয় পরবর্তীতে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনসহ জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতিটি লড়াইয়ে চট্টগ্রামের আইনজীবীরা বীরত্বপূর্ণ সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। যা চট্টগ্রামবাসীর ভবিষ্যৎ- প্রেরণা আর পুরো জাতির জন্য অহংকার ।
সিসেরোকে সারাবিশ্ব একজন রোমান দার্শনিক বলেই জানে বেশি। উনি যে একজন দক্ষ আইনজীবী ছিলেন সেই দিকটি খুব বেশি আলোচিত হয় না । প্রাচীন রোমে একজন সৎ ,দৃঢ়চেতা ও দক্ষ প্রসিকিউটর প্রভূত সুনাম অর্জন করেন। জুলিয়াস সিজারের উইল সংক্রান্তে ভুল ব্যাখ্যা দেয়ায় মার্ক এন্টনীর তীব্র বিরোধিত করেন।ঐ সময়ের প্রেক্ষিতে এটা ছিল রীতিমত দুঃসাহস। প্রাচীন রোমের শাসন ব্যবস্থায় গভর্নরগণ ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করতেন। সিসিলির গভর্নর কাম ম্যাজিস্ট্রেট গেইয়াস ভেরেস –এর দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার জন্য দায়েরকৃত মামলায় প্রসিকিউটরের কাজ করতে গিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন।এবং সেই মামলায় প্রচণ্ড চাপের মুখেও কোন রূপ ছাড় দেননি কিংবা নতি স্বীকার করেননি। সিভিল ওয়ার চলা কালীন সময়ে সাংবিধানিক,সামরিক ও নৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র ভয়াবহ সংকটে পতিত হয় । ঠিক সেই সময় প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন সঠিক পথে দেশকে পরিচালিত করেন। পেশাগত জীবনে আইনজীবী ছিলেন বলেই তাঁর জন্য অনেক কাজ সহজ হয়ে যায়।
মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে চার বছরের বেশি কাল চট্টগ্রামে কাটিয়েছি। ফলে এই বারের সম্মানিত আইনজীবীদের সাথে কাজ করার সৌভাগ্য সুযোগ হয়েছে। আদালতের প্রতি চট্টগ্রামের সম্মানিত আইনজীবীর অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল। আদালতের আদেশ যাই হোক না কেন তাঁদের চেহারা বা অভিব্যক্তিতে কখনো কোন নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া চোখে পড়েনি । বিজ্ঞ আইনজীবীদের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি , সহযোগিতামূলক মনো ভাব, সহিঞ্চুতা , পেশাদারিত্ব, ও সম্মানবোধ সত্যি প্রশংসনীয়। মেধা, মনন, চিন্তা,চেতনা, জ্ঞান, প্রজ্ঞা , ম্যানার্স ,ইটিকেট, নৈতিক মূল্যবোধ ,ও বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মে চট্টগ্রাম বারের আইনজীবীরা অসাধারণ ।মানবাধিকার রক্ষা,পরিবেশ সং রক্ষণ ও আইনের শাসনের ব্যাপারে এই বারের সম্মানিত সদস্যগণকে সদা জাগ্রত মনে হয়েছে। যে কোন ভালো কাজে এই মহৎ মানুষগুলো নির্দ্বিধায় বুক চিতিয়ে এগিয়ে আসেন। বাড়িয়ে দেন সহযোগিতার হাত । বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন কালে বারের বেশ কয়েকটি কমিটির কার্যক্রম দেখার সুযোগ পেয়েছি। প্রত্যেকটি কমিটিকে প্রো-পিপল মনে হয়েছে। বারের কমিটির কথা আলাদা ভাবে বলাটা কিছুটা বাহুল্য হয়ে যায় । কারণ সামগ্রিক বিবেচনায় চট্টগ্রামের বিজ্ঞ আইনজীবীগণ সাধারণ মানুষের প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিপরায়ণ। তাঁরা গরীব-দুঃখী মানুষের চোখের পানি মুছে দেয়ার জন্য আন্তরিকভাবে চেষ্ঠা করেন । আইনের শাসন, সততা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার সুকঠিন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে কখনো পিছপা হননি। এটা সারা পৃথিবীর জন্য অনুকরণীয় হতে পারে ।
চট্টগ্রাম আদালত থেকে বিদায় নেয়ার পর অনেক দিন হয়ে গেল। মহাকালের কাছে এই সময় অতীব নগণ্য। পড়ন্ত বিকেলে চেঙ্গী নদীর স্রোতে ভেসে যাওয়া সূর্যালোকে তাকালে পরীর পাহাড়ের কথা মনে পড়ে যায়। এখানকার মহৎ সুন্দর মানুষগুলোর স্নেহ-মমতা হৃদয়কে আলোড়িত করে ।নয়নকে প্লাবিত করে । এই প্লাবন আনন্দের ,এই অশ্রু ভালোবাসার। কোন কিছু করতে না পারা সত্বেও আমার মত তুচ্ছ মানুষের প্রতি তাঁদের সুগভীর ভালোবাসা আমাকে আড়ষ্ট করে দেয়।পরম দয়ালু অসীম করুণার আধার মহান স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা- “ সিসেরো , আব্রাহাম লিংকন, জন এডামস্ ও মহাত্মা গান্ধীদের উত্তরসূরি এই চমৎকার মানুষগুলোর সবকিছু যেন সফল হয়। এথেন্স থেকে শুরু হওয়া মঙ্গলময় যাত্রা যেন উত্তরোত্তর উৎকর্ষতার পানে ধাবিত হয়। হে মহাপ্রভু , পবিত্র এই অঙ্গনের সাথে সম্পর্কিত সুন্দর মানুষগুলোর ইহকাল ও পরকালকে মঙ্গলময় করে দিন।”
লেখক-
চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট, বান্দরবান পার্বত্য জেলা, বান্দরবান।
সম্পাদক ও প্রকাশক: রফিকুল ইসলাম
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-১৩১০