নিজস্ব প্রতিবেদক :
বিআরটিসি’র কর্মকর্তার নেতৃত্বে সাংবাদিকদের ওপর হামলা, মোবাইল কেড়ে নিয়ে মুছে ফেলেন হামলার ভিডিও।
আসন্ন ঈদুল ফিতর উপলক্ষে বিআরটিসি’র প্রস্তুতি সংক্রান্ত সংবাদ সংগ্রহে গিয়ে হামলার শিকার হয়েছেন দুই সাংবাদিক। অনলাইন নিউজ পোর্টাল ঢাকা মেইলের মাল্টিমিডিয়া রিপোর্টার মো. ইলিয়াস ও শরিফুল ইসলামকে বিআরটিসির মতিঝিল ডিপোর ম্যানেজার (অপারেশন) ওমর ফারুক মেহেদীর সামনে মারধর করা হয়। এ সময় তাদের দুজনের কাছ থেকে মোবাইল কেড়ে নিয়ে মারধরের ভিডিও ডিলিট করা হয়েছে। এছাড়া কেড়ে নেওয়া হয়েছে তাদের অফিসের আইডি কার্ড, ও মানিব্যাগ ও পাওয়ার ব্যাংক।
বৃহস্পতিবার (২০ মার্চ) দুপুরে মতিঝিলের বিআরটিসি’র ডিপোতে এই ঘটনা ঘটে।
বিআরটিসি’র এই ডিপোর একাধিক কর্মী ও নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা লোকজনের মারধরে আহত সাংবাদিক ইলিয়াস ও শরিফুল প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন।
হামলায় ইলিয়াসের হাত-পায়ের কয়েক জায়গায় কেটে গেছে এবং বুকে প্রচন্ড আঘাত লাগায় শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। অন্যদিকে শরিফুল ইসলামের বুকে কিল-ঘুষি মারায় তার বুকেও প্রচন্ড ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।
এ বিষয়ে বিআরটিসি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ড. অনুপম বাবুর সঙ্গে কথা বলতে একাধিকবার চেষ্টা করলেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।
পরে বিআরটিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা মোস্তাকিম ভূঞা বলেন, পেশাগত কাজ করতে গিয়ে সাংবাদিকদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বিষয়টি ইতোমধ্যে ঊর্ধ্বতন স্যারদের অবহিত করা হয়েছে। এই ঘটনায় যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কী ঘটেছিল সাংবাদিকদের সঙ্গে?
মারধরের শিকার দুই সাংবাদিক জানান, বেলা দেড়টার দিকে অফিসের অ্যাসাইনমেন্টে ইলিয়াস হোসেন ও শরিফুল ইসলাম বিআরটিসির যাত্রীসেবা সংক্রান্ত একটি সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য মতিঝিল বাস ডিপোতে যান। সেখানে বিআরটিসির ডিপোর অপারেশন ম্যানেজার ওমর ফারুক মেহেদীর রুমের সামনে দাঁড়ালে পাশের কক্ষ থেকে হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা ইসরাত উম্মে সালমা বলে ওঠেন, এই আপনারা কারা, এখানে অনুমতি ছাড়া আসলেন কেন, কীভাবে আসলেন। এছাড়া তিনি বাজেভাবে গালিগালাজ করেন।
এ সময় গলায় অফিস আইডিকার্ড থাকার পরও এমন আচরণের বিষয়ে জানতে চাইলে পাশ থেকে ইকবাল নামে একজন তেড়ে আসেন। তিনি দুই সাংবাদিককে টেনে ইসরাত উম্মে সালমার রুমে নিয়ে যান।
মারধরের শিকার সাংবাদিক ইলিয়াস বলেন, এমন পরিস্থিতিতে আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। তখন তাদের বলি আমরা সাংবাদিক, আমাদের গলায় আইডি কার্ড রয়েছে, তারপরও আমাদের সঙ্গে এরকম আচরণ কেন করছেন? তখন তার রুমে ইকবালসহ আরেকজন নারী ও ইসরাত উম্মে সালমা বাজে ব্যবহার করতে থাকেন এবং ইকবাল ও সেই নারী বলতে থাকেন একজন ‘ফার্স্টক্লাস’ অফিসার সে তোদের সঙ্গে এর চেয়ে আর কেমন আচরণ করবে?
ইলিয়াস বলেন, তখন আমরা বলি, ঈদ উপলক্ষে যাত্রীসেবা সংক্রান্ত একটি সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য আপনাদের ম্যানেজারের কাছে এসেছিলাম। কিন্তু আপনারা এরকম কেন করছেন?
একপর্যায়ে সাক্ষাৎকার না নিয়েই নিচে মূল গেইটের কাছে চলে যান দুই সাংবাদিক।
হামলার শিকার আরেক সাংবাদিক শরিফুল ইসলাম বলেন, নিচে নেমে আমরা অন্য একটি অ্যাসাইনমেন্টের ভিডিও অফিসকে পাঠাচ্ছিলাম এমন সময় ইকবাল এসে আমাদের দুইজনকে ধাক্কাধাক্কি করে এবং বের হয়ে যাওয়ার জন্য বলে। আমরা তখন প্রশ্ন করি আমাদেরকে ধাক্কাচ্ছেন কেন এবং এখানে দাঁড়িয়ে আছি আমরা; কোনো ভিডিও তো করছি না বা কিছু করছি না, তাতে সমস্যা কোথায়?— কিন্তু তিনি কোনো কথা না শুনে আবারও ধাক্কাধাক্কি করতে থাকে। তখন আমরা ভিডিও ক্যামেরা অন করে জানতে চাই আমাদের অপরাধটা কী বলেন, আমাদের সঙ্গে এরকম আচরণ কেন করছেন? তখনই আরও আট দশজন এসে আমাদের ওপর হামলে পড়ে। আমাদেরকে টানাহেঁচড়া শুরু করে, অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে, কেউ বলে তাদেরকে বেঁধে রাখো।
শরিফুল বলেন, এরপর কয়েকজন মিলে জোর জবরদস্তি করে আমাদের মোবাইল কেড়ে নিতে চায়। তখনই আমাদের অফিসে কল দেই, অফিসের সঙ্গে কথা বলতে বলি এবং বারবার বলতে থাকি আমাদের অফিসের সঙ্গে একটু কথা বলেন, আমরা ঢাকা মেইলে কাজ করি, আমাদের নিবন্ধিত মিডিয়া; কিন্তু কেউ কোনো কথা শোনেনি। জোর-জবরদস্তি, কিলঘুষি মেরে আমাদের মোবাইল এবং পকেটে যা যা ছিল সব কেড়ে নেয়। তাদের আঘাতে ইলিয়াসের হাত ও পায়ের কয়েক জায়গায় কেটে গেছে এবং বুকে প্রচন্ড আঘাত লাগায় শ্বাসকষ্ট হচ্ছে এবং আমারও বুকে কিলঘুষি মারায় বুকে প্রচন্ড ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। আমাদের আবারও টেনে উপরে নিয়ে যাওয়া হয়।
ইলিয়াস বলেন, পরে আমাদেরকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে তারা একবার হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার অফিসে ঢোকায়, একবার আনসারের কাছে তুলে দেয়, এরকম হেনস্তা করতে করতে পরবর্তীতে ম্যানেজারের কক্ষে নিয়ে যায় এবং তার সামনে তার নির্দেশে জোরপূর্বক আমাদের আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে মোবাইলের লক খুলে ফোন থেকে আমাদের উপর হামলার ভিডিও মো. রাকিবুল আলমসহ (সহকারী প্রশাসনিক কর্মকর্তা) অপরিচিত আট থেকে দশজন মিলে ডিলিট করে দেয়।
হামলায় আহত দুই সাংবাদিক বলেন, আজকের ঘটনার পুরো ভিডিও সিসিটিভি ফুটেজে আছে। যাচাই করলে সকল তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যাবে। আমরা এর সুষ্ঠু বিচার চাই।
সাংবাদিকদের মারধর ও ভিডিও ডিলিট করার ঘটনায় জড়িত ডিপোর সহকারী প্রশাসনিক কর্মকর্তা রাকিবুল আলম বলেন, ‘সাংবাদিকরা অনুমতি না নিয়ে ভেতরে যাওয়া নিয়ে সমস্যা হয়েছে৷ সরকারি অফিসে ঢুকতে অনুমতি নিতে হয়। বিআরটিসির ডিপোতেও অনুমতি ছাড়া ঢোকা যায় না। সেটা জানতে চাওয়া নিয়ে সমস্যা হয়েছে।’
শুরুর দিকে ঘটনাস্থলে ছিলেন না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সাংবাদিকরা নিচে এসে ভিডিও করায় আমাদের সিকিউরিটির লোকজন তাদের বাধা দেয়। পরে আমরা ফোন নিয়ে ভিডিও ডিলিট করে দিয়েছি। আমাদের স্যার যারা সাংবাদিকদের সাথে ঝামেলা করেছে তাদের সঙ্গে কোলাকুলি করিয়ে মিলমিশ করে দিছে।’