সড়ক দূর্ঘটনা আমাদের জাতীয় জীবনের একটি ভয়াবহ অভিশাপ। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় দেশের সড়ক পথগুলো এক একটি মৃত্যুপুরিতে পরিনত হয়েছে। এ মৃত্যুপরির ফাঁদে পড়ে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ অকালে পরপারে পাড়ি দিতে বাধ্য হচ্ছে। দুঃখ-কষ্ট, অভাব-অনটন আর অসুস্থ রাজনীতির বিভীষিকাময় পরিবেশের মাঝে বসবাস করেও সবাই জীবনকে নিয়ে কম বেশি স্বপ্নের ঝাল বুনে। আর আমাদের এ সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা দেশের স্বপ্নের কারিগরদের অকালে পৌছে দিচ্ছে পরপারে। মনে হয় মানুষদেরকে পরপারে পাড়ানোর জন্য দেশের সড়ক বিভাগকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এ সড়ক দূর্ঘটনা আমাদের জাতীয় জীবনে সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নকে তিলে তিলে ধ্বংস করে দিচ্ছে। বাংলাদেশের মত এমন অনাকাঙ্খিত সড়ক দূর্ঘটনা পৃথিবীর খুব কম দেশেই সংগঠিত হয়।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রতিঘন্টায় ৪০জন লোক সড়ক দূর্ঘটনায় নিহিত হয়। বাংলাদেশে এ মৃতের হার ১৪ শতাংশ। এ সড়ক দূর্ঘটনা আমাদের জাতীয় জীবনে চরম দুঃখ কষ্টের সমাবেশ ঘটিয়েছে। একটি সড়ক দূর্ঘটনা শুধু একটি প্রাণের শেষ নয় একটি পরিবারের ধ্বংসের কারণও। আর একটি স্বপ্নের অকাল মৃত্যুর অন্যতম ঘাতকও। অসুস্থ রাজনীতির বিষাক্ত থাবায় দেশের অন্যান্য সেক্টরের মতো পরিহন সেক্টরেও বিরাজ করছে ভয়াবহ নৈরাজ্য যা সড়ক দূর্ঘটনার বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ।বাংলাদেশে বছরে প্রায় ১০ হাজার মানুষ দূর্ঘটনায় নিহিত হয় বলে একটি বেসরকারী সুত্রে প্রকাশ যাতে গড় প্রতি দৈনিক মৃতের সংখ্যা দাড়ায় ২৭ দশমিক ৩৯। সড়ক দূর্ঘটনার এ অবাধ হত্যাযজ্ঞ প্রতিরোধের জন্য যথাযথ পদপে নেওয়ার বদলে যখন সরকারের স্থানীয় সরকার মন্ত্রী বলেন,"সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলে আন্দোলন করার কিছু নেই, অ্যাকসিডেন্ট ইজ অ্যাকসিডেন্ট"!!!!
এটা অবশ্যই সড়ক দূর্ঘটনায় মারা যাওয়া আত্মাদের প্রতি এবং নিহতদের স্বজনদেরর প্রতি 'নিষ্ঠুর" এবং 'নির্মম পরিহাস'। এসব কারণে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির সংখ্যা দিন দিন ভয়াবহ আকারে বেড়েই চলেছে। প্রতিদিনই এ যন্ত্রদানবের দুর্ঘটনার শিকার হয়ে দেশের বহু জ্ঞানী, গুনী, বুদ্ধিজীবি, চলচিত্র নির্মাতা, নিষ্পাপ শিশু থেকে বৃদ্ধ, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীসহ অনেকেই অকালে প্রাণ হারাচ্ছেন। দুর্বল আইন ও সরকারের উপযুক্ত মনিটরিং অভাবের সুযোগ নিয়ে চালক নামের ঘাতকেরা রীতিমত হত্যার লাইসেন্স পেয়েছে এমন অবস্থাই যেন এখন নিত্য দিনের চিত্র। অদ ও আনাড়ি চালকের বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, মালিকের স্বেচ্ছাচারিতা, খামখেয়ালীপানা, জনসচেতনতার অভাব, দায়ী চালকের বিরুদ্ধে উপযুক্ত শাস্তির বিধান না থাকা, চালকের মোবাইল ফোনে কথা বলা- এসব কারণেই সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞ মহল। সড়ক দুর্ঘটনা যেমন একদিকে কেড়ে নিচ্ছে বহু জ্ঞানী-গুনী, বুদ্ধিজীবির প্রাণ তেমনি অন্যদিকে দেশ হারাচ্ছে তার সোনার সন্তান। মাননীয় মন্ত্রী ভুলে গেছেন মিরসরাই ট্রাজেডি, যেখানে অকালে প্রাণ হারায় ৫৩ জন শিশু শিক্ষার্থী, ভুলে গেছেন মানিকগঞ্জ রোডে এক ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রখ্যাত চলচিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ ও সাংবাদিক মিশুক মনির নিহত হওয়ার কথা। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রণহানির সংখ্যা দিন দিন ভয়াবহ আকারে বেড়েই চলেছে। দুর্বল আইন, উপযুক্ত মনিটরিং ও সরকারের দ্বায়িত্বশীল সংস্থাগুলোর কর্তব্যে অবহেলার সুযোগে চালকেরা রীতিমত বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। শুধুমাত্র সরকারি হিসাব অনুযায়ী গত ১৭ বছরে সাড়ে ৭০ হাজার সড়ক দুর্ঘটনায় অর্ধলাধিক মানুষ নিহত হয়েছে। আহতের সংখ্যা আরো বেশি।
* সড়ক দূর্ঘটনার হতাহতের পরিসংখ্যান ঃ
জনাব কে,এম, মনিরুজ্জামান ও জনাব রাকিব মিত্রের এক গভেষণায় দেখা গেছে যে, ১৯৯৮ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত সারা বাংলাদেশে ২৩ হাজার ২৭৩টি দূর্ঘটনা সংগঠিত হয়েছে। যাতে ১৯৯৮ সালে ৩৫৩৩টি, ১৯৯৯ সালে ৩৯৪৮টি, ২০০০ সালে ৩৯৭০টি, ২০০১সালে ২৯২৫টি, ২০০২ সালে ৩৯৪১টি, ২০০৩সালে ৪১১৪টি।প্রতি বছরের তুলনায় পরবর্তী বছরের দূর্ঘটনার সংখ্যা কোন ভাবেই হ্রাস করা যায়নি। শুধু ২০০১ সাল ছাড়া, বরং তা ২০০৩ সালে তা বেড়েছে।১৯৯৮-২০০৩ সালে ২৩ হাজার ২৭৩টি দূর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৭০৮৪ জন, আহত হয়েছেন ১৯৮৪১জন।তাছাড়া শুধু ঢাকা শহরেই ১৯৯৮ থেকে ২০০৩ সালে মোট দূর্ঘটনা ৫হাজার ১৬৮টি। মৃতের সংখ্যা ২১১০জন, আহত হয়েছেন ৩৯২৩জন।
বাংলাদেশ পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বছরে সড়ক দূর্ঘটনায় ৪০০০ প্রাণ বিনাশ হয়, আহত হন ৫০০০জন। এতে আরো দেখা গেছে যে, অধিক সংখ্যক দূর্ঘটনা রুরাল এরিয়ায় সংগঠিত হয়। জাতীয় ও আঞ্চলিক বিশ্বরোডে তুলনামূলক কম সংখ্যক দূর্ঘটনা ঘটে। এতে রাস্তায় কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশও দূর্ঘটনায় কবলিত হয়। মৃতের সংখ্যা সহনশীল পর্যায়ে থাকলেও হাসপাতালে ইমাজেন্সি সহ হসপিটালাইজড্ হয়েছেন অনেকেই।
আসুন দেখি বিগত কয়েকটি বছরের সড়ক দূর্ঘনার ভয়াবহ পরিসংখ্যান:-
১৯৯৪ সালে নিহত ৩০১৩ আহত ২৭৩৫ জন, ১৯৯৫ সালে নিহত ১৬৫৩ আহত ২৮৬৪ জন ১৯৯৬ সালে নিহত ২০৪১ আহত ৪০৭৬ জন ১৯৯৭ সালে নিহত ৩১৬২ আহত ৩৯৯৭, ১৯৯৮ সালে নিহত ৩০৮৫ আহত ৩৪৫৩, ১৯৯৯ সালে নিহত ৩৩১৪ আহত ১৯১১, ২০০০ সালে নিহত ৩৪৩০ আহত ৩১৭২,২০০১ সালে নিহত ৩১০৯ আহত ৩৬০৭ ২০০২ সালে নিহত ৩৩৯৮ আহত ৩০৭০, ২০০৩ সালে নিহত ৩৩৮৯ আহত ৩৮১৮, ২০০৪ সালে নিহত ২৯৬৮ আহত ২৭৫২ ২০০৫ সালে নিহত ৩১৮৭ আহত ৩৭৫৫, ২০০৬ সালে নিহত ৩১৯৩ আহত ২৪০৯, ২০০৭ সালে নিহত ৩৭৪৯ আহত ৩২৭৩, ২০০৮সালে নিহত ৩৭৬৫ আহত ৩২৮৪, ২০০৯ সালে নিহত ২৯৫৮ আহত ২৬৮৬,২০১০ সালে নিহত ৩১৯৫ আহত ২৫৫৭, ২০১১ সালে নিহত ৩৭৯৫ আহত ২৪৯৫ জন। সড়ক দূর্ঘটনার অন্যতম কারণের মধ্যে একটি লাইসেন্সবিহীন ভূয়া ড্রাইভার যা আমাদের দেশে অবাধ প্রচলন রয়েছে। বিআরটিএ সূত্রে প্রকাশ, বাংলাদেশে নিবন্ধনকৃত গাড়ীর সংখ্যা ১৫ লাখ এবং লাইসেন্সধারী চালকের সংখ্যা মাত্র ৯ লাখ ৬০ হাজার। দেশে প্রায় ১০ লাখ লাইসেন্সহীন চালক বা ভূয়া লাইসেন্সধারী রাস্তায় প্রতিনিয়তই গাড়ী চালাচ্ছে বলে পরিবহনখাত পর্যবেকদের ধারনা। এরচেয়ে নৈরাজ্য ও ভীতিকর অবস্থা আর কি হতে পারে?
* সড়ক দুর্ঘটনার কারণ সমূহ ঃ
ভয়াবহ সড়ক দূর্ঘটনার প্রধান কারণ সমুহ- * অদ চালক * ট্রাফিক আইন না মানা * দূর্বল ট্রাফিক আইন *সড়কের বেহাল অবস্থা * ঘুষের মাধ্যমে ড্রাইভিং লাইসেন্স লাভ * পর্যাপ্ত ট্রাফিক পুলিশের/সাইনের অভাব * অপরিকল্পিত/ভাঙ্গা/অপ্রশস্ত রাস্তাঘাট/টার্নিং * অমনযোগী/মদ্যপ/তন্দ্রাযুক্ত অবস্থায় গাড়ি চালানো * হেল্পার দিয়ে গাড়ি চালানো * গাড়ি চালানো অবস্থায় ফোনে কথা বলা * ওভারটেকিং/ ওভার স্পিড/ প্রতিযোগীতা * অসেচতন যাত্রী * যেখানে-সেখানে রাস্তা পারাপার * পর্যাপ্ত ওভারব্রিজের অভাব * ত্রুটিপূর্ণ যানববাহন/যানববাহনের প্রচুরতা * ধারণমতার চেয়ে বেশি যাত্রী পরিবহণ এবং ফিটনেস বিহীন গাড়ী চলাচল ইত্যাদী।
* সড়ক দূর্ঘটনা প্রতিরোধে করণীয় ঃ
নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থার ব্যাপারে চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন জানান, দূর্ঘটনার জন্য চালকদের শাস্তি না হওয়ায় তারা অত্যন্ত বেপোরোয়া হয়ে গাড়ি চালায়। এজন্য দরকার যুগোপযোগী আইন। শুধু আইন করলেই চলবে না আইনের বাস্তবায়নও করতে হবে। এ কারনে জাতীয় ঐক্যমতের ভিত্তিতে নিরাপদ সড়ক ব্যাবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। ড্রাইভাররা মনে করেন দূর্ঘটনা না ঘটলে হাত পাকা হয় না। চালকদের যথাযথ প্রশিণের মাধ্যমে ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদান ও পাঠ্যপুস্তকে ড্রাইভিং বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তিনি বলেন, দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে নিজস্ব অর্থায়নে কাজ করে আসছি। কোন সময়ই সংশ্লিষ্ঠ কোন ব্যক্তিবর্গের সাহায্য পাইনি। এর পরেও রয়েছে সড়ক ব্যাবস্থাপনা এবং মনিটরিংয়ে দুর্নীতি। সড়ক ব্যাবস্থাপনার বেহাল দশা সম্পর্কে বলার আর কিছুই নেই, কারণ যোগাযগ ব্যাবস্থার সাম্প্রতিক দুর্নীতি সম্পর্কে আমরা সবাই অবগত। অধিকাংশ সড়কে ডিরেকশন ইন্ডিকেটর এর বদলে দেখতে পাই বিভিন্ন কোম্পানির বিজ্ঞাপন, যার অর্ধেক টাকাও আবার যায় সংশ্লিষ্ট বিভাগের দুর্নীতিবাজদের পকেটে। সড়ক পরিবহন সেক্টরে দূর্নীতি আর রাজনৈতিক প্রভাব দর করা দরকার। বিআরটিএ-এর এক সূত্র থেকে জানা যায়, কো-অর্ডিনেশন এন্ড মনিটরিং অফ ন্যাশনাল রোড সেফটি স্ট্রাটেজি এ্যাকশন প্লেন ২০০২-০৪ শুধু মাত্র যথাযথ অর্থায়নের অভাবে বাদ পড়ে। বিআরটিএ আরো জানায়, ১৯৯৫ সালের জুলাইয়ে ন্যাশনাল রোড সেফটি কাউন্সিল গঠন করা হলেও এই কাউন্সিলের গৃহীত সুপারিশ মালা এখন পর্যন্ত ৩০ শতাংশও কার্যকর হয়নি। দেশে প্রতি বছর সড়ক উন্নয়ন খাতে ১ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হলেও সড়কের নিরাপত্ত্বার জন্য কোন বরাদ্দ দেয়া হয়নি। সভ্যতায় গণ যোগাযোগ ব্যবস্থা নির্মান ও উন্নয়ন গুরুত্বপূর্ণ একটি অবকাঠামো। যান্ত্রিক সভাতার যুগে তাল মিলিয়ে চলতে হলে অবকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে যত্নশীল হতে হবে। অবকাঠমোগত উন্নয়নের পাশাপাশি এর বিপরীতমুখী হিংস্র, মানব অকল্যানমূলক দিকগুলো প্রাধান্য দিয়ে এর প্রতিরোধমুলক শক্ত প্রাচীর গড়ে তুলতে হবে। অন্যথায় মুহুর্তে হাজার জীবনের ধ্বংসলীলা ঘটে যেতে পারে।
তৃতীয় বিশ্বে রাস্তায় প্রযুক্তির ব্যবহার এতটা প্রসারিত হয়নি। ফলে এনালগ পদ্ধতিতেই চলছে সড়ক ও রেলপথ। মানুষ সবচেয়ে ভয়াবহ প্রতিহিংসার শিকার সড়ক পথেই। তাই দেশের সড়ক পথকে প্রযুক্তির আওতায় আনতে হবে,তাহলে অনেকাংশেই সড়ক দূর্ঘটনা কমে যাবে। আমরা কি পারব আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটা নিরাপদ সড়ক ব্যাবস্থাপনা রেখে যেতে??? আমাদের মন্ত্রী-আমলাদের কি সুহৃদয় বা সুদৃষ্টি হবে এই বিষয়ে নজর দিতে??? না আবার আমাদেরও সড়ক দুর্ঘটনায় জীবন দিয়ে 'নির্মম পরিহাসের' বিষয়-বস্তু হতে হবে মন্ত্রী-আমলাদের বিবৃতি দেওয়ার জন্য???
লেখক: মুহাম্মদ ছানাউল্লাহ
সাংবাদিক,কলামিস্ট ও ইউটিউভার
sanaullahcoxs62@gmail.com
সম্পাদক ও প্রকাশক: রফিকুল ইসলাম
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-১৩১০