——–
ভোলাগঞ্জ :
পূণ্য ভূমি সিলেটের প্রকৃতির রাজ্যে হারানোর ইচ্ছে বেশ আগে থেকেই। ইতিপূর্বে সিলেট গেলেও ঘুরার সুযোগ হয়নি। এবার পলিসি ক্যাম্প ২০১৯ এ অংশ গ্রহণের মাধ্যমে সেই বাসনা পূরণ হল। পাঁচ দিনের আবাসিক ক্যাম্প শেষে ৩০ আগস্ট ভোর ৬ টা ৩০ মিনিটে ১২ জন পলিসি এয়াডভকেট বেরিয়ে পড়ি সিলেট ব্রাক লার্নিং সেন্টার থেকে। গন্তব্য ভোলাগঞ্জ।
৮ টা না বাজতেই পৌঁছে গেলাম ভোলাগঞ্জে। ভোলাগঞ্জের পাহাড়ের মনোলোভা দৃশ্য দেখে মুহূর্তেই সবাই মনের অজান্তেই চিৎকার করলাম। পাহাড় আর মেঘের মাঝে কি অপূর্ব মিতালি। নিচে আছে জলাধার। তার মাঝের পাথরগুলো যেন কোন শিল্পী নিজ হাতে সাজিয়েছেন। এ যেন প্রকৃতির রূপের আধার। স্মৃতি ধরে রাখার প্রয়াসে সম্মিলিত ছবি, সেলফি সবই চলছে। প্রকৃতির মাঝে বুঁধ হয়ে রইলাম দীর্ঘক্ষণ। তবে বেশি সময় কাটানোর অবকাশ নেই। যেতে হবে বাংলার আমাজন রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট।
রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট:
ছোট্ট একটি হোটেলে নাস্তা করে ভোলাগঞ্জ থেকে রওনা হলাম সিলেটের গোয়াইনঘাটের উদ্দেশ্যে। সেখানেই রাতারগুল অবস্থিত। আনুমানিক সাড়ে দশটার দিকে বাংলাদেশের একমাত্র স্বীকৃত জলাবনে পৌঁছলাম। নৌকা আগে থেকেই আশরুপা আপু ঠিক করে রেখেছিলেন। একটু বড় নৌকাই ভাড়া করা হয়েছিল কারণ আমরা ১২ জন ছিলাম। বনের ভিতর প্রবেশ করতেই চোখে পড়ল হিজল আর তমাল গাছ। সাথে সাথে মনে পড়ে গেল জীবনানন্দের রূপসী বাংলা কবিতার কথা ।
সামনে এগতেই নজর আটকে গেল সুবিশাল জালি বেতের বাগান। এ বিশাল বন বছরের ৪ থেকে পাঁচ মাস ডুবে থাকে পানির নিচে। কোমর ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলোই এ বনকে অনন্য করেছে। মাঝে মাঝেই কানে ভেসে আসছে পাখির ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ। দিনের বেলাতেই শুনতে পেলাম ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। ঘন গাছ গাছালির কারণে সূর্যের এলো ভাল পৌঁছে না । তাই সারাক্ষণ কেমন জানি সন্ধ্যা নেমে থাকে রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্টে। হঠাৎ একটি বানর দেখে চিৎকার করে উঠলেন তাসমিয়া আপু। বানর আগেও দেখেছি চিড়িয়া খানায়। তবে রাতারগুলের জলা অরণ্যে মুক্ত বানর দেখে যে আনন্দ পেয়েছি তার স্বাদ ছিল ভিন্নতর। গভীর বন থেকে ফিরে কাঁদা মাড়িয়ে ওয়াচ টাওয়ারে উঠলাম। উঁচু টাওয়ার থেকে সম্পূর্ণ বনই দেখা যায়। ঘন গাছগুলোর মধ্যে দিয়ে নদী বয়ে চলেছে সর্পের ন্যায়। তার মাঝে শোভা পাচ্ছে পর্যটকদের বর্নিল নৌকা। আমরা ছবি তুলতে ভুললাম না। আমি চার পাশের দৃশ্য ভিডিও করে নিলাম । কি মনোরম দৃশ্য! যেন শিল্পের তুলিতে আঁকা বন।
প্রকৃতি কন্যা জাফলং
নয়নাভিরাম এই দৃশ্যের মায়া ত্যাগ করে লেগুনা যোগে যাত্রা শুরু করলাম আমাদের শেষ স্পট প্রকৃতি কন্যা জাফলং এর উদ্দেশ্যে। তামাবিল মহাসড়ক অতিক্রম করে দুপুর তিনটা নাগাদ জাফলং গিয়ে থামল আমাদের লেগুনা। রাতারগুল থেকে জাফলং পর্যন্ত এ দীর্ঘ সময়টা বেশ আনন্দে কেটেছে। গান, আড্ডা কখনো বা পলিসি ক্যাম্পের স্মৃতিচারণ এসবই প্রাণবন্ত করে রেখেছিল আমাদের ভ্রমণকে। তবে শাহানাজ আপু সারাক্ষণই ঘুমিয়ে কাটিয়েছেন। প্রকৃতি কন্যা হিসেবে পরিচিত খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত জাফলং প্রাকৃতিক সৌন্দার্যের অপরূপ লীলাভূমি। নদীর তীরে বিছানো পাথরের স্থূপ জাফলং এর সৌন্দার্যকে বহুগুনে বৃদ্ধি করেছে। পাথরের অপর নীলাভ পানি দেখে গোসল করার ইচ্ছা সংবরণ করতে পারলাম না। কেমন জানি শিশুসুলভ আচরণ শুরু করেছিলাম সবাই। কি শীতল পানি! মনে হচ্ছে হিমাগার থেকে পানি নামিয়ে রাখা হয়েছে। হাসিব ভাই আর আমি নেমে পড়লাম পানিতে। তারপর একে একে সবাই পানিতে নেমে গোসল শুরু করলাম। যত ভঙ্গিতে ছবি তোলা যায় তুললাম । এর মধ্যেই বিএসএফের বাঁশি! আমরা নাকি ভারতে সীমানায় চলে গেছি? শুনে ভালোই লাগল বিনা ভিসায় ভারতে প্রবেশ করলাম। এভাবে পানিতে আনন্দ হৈহুল্লোড় চলতে থাকল। কিভাবে ২ ঘন্টা সময় পার করে ফেললাম বুঝতেই পারলাম না।ইতিমধ্যেই সূর্যমামা পশ্চিম আকাশে ঢুলে পড়ে ফেরার সময়কে ইঙ্গিত করল। প্রকৃতি প্রেমী হৃদয়গুলো প্রকৃতি কন্যাকে ছেড়ে যেতে চাচ্ছিল না কোনভাবেই। তবুও অতৃপ্ত দিলে বিদায় জানালাম গোধূলি বেলার প্রকৃতি কন্যাকে।
প্রকৃতির রাজ্যের এ ভ্রমণ আমার স্মৃতিপটে স্থান করে থাকবে আজীবন। এটি শুধু ভ্রমণই ছিল না , এটি ছিল একটি সাংস্কৃতিক মিলন মেলা। কারণ আমরা সেদিন খুলনা, ঢাকা, রংপুর, বরিশাল, রাজশাহী, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বিভিন্ন বিভাগ ও জেলা থেকে মোট ১২ জন ছিলাম। ভিন্ন ভিন্ন স্থান থেকে আগত মানুষগুলোর হৃদয়ের সুর সেদিন মিলিত হয়েছিল জীবনানন্দ দাসের রূপসী বাংলার প্রকৃতি প্রেমে।
———
জসীম উদ্দীন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।