রোকনুজ্জামান সবুজ, জামালপুর ঃ
মেলান্দহের মধ্যেরচর গ্রামবাসী তাদের পূর্বপুরুষদের নৌকা বাইচ প্রতিযোগীতার পুরনো ঐতিহ্য ধরে রাখতে গত শুক্রবার একটি নতুন বাইসেল নৌকা বানিয়ে ঝিনাই নদীর পানিতে ভাসিয়ে উল্লাস করেছেন। জামালপুর জেলা শহর থেকে মাত্র ৫কিলোমিটার দুরে অবস্থিত মেলান্দহের চরবানী পাকুরিয়া ইউনিয়নের মধ্যেরচর গ্রাম। গ্রামটির ৪টি পাড়ায় অন্তত: ১০ হাজার মানুষ রয়েছে। এ গ্রামের প্রায় সবাই নৌকা বাইচ প্রতিযোগীতাকে আনন্দের সাথে উপভোগ করেন।
স্থানীয় সুত্রে জানা গেছে, জামালপুরের ঝিনাই নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত মেলান্দহের মধ্যেরচর গ্রামের বর্তমান বাসিন্দাদের পূর্বপূরুষরা তৎকালে নিয়মিত নৌকা বাইচ প্রতিযোগীতায় অংশ গ্রহণ করতেন। তখন থেকেই নৌকা বাইচ প্রতিযোগীতা এ গ্রামের মানুষের কাছে বিনোদনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নৌকা বাইচ প্রতিযোগীতায় ধারাবাহিকভাবে বিজয়ী হওয়ার কৃতিত্বও পূর্বপূরুষদের ছিল বলে জানা গেছে। তাই মধ্যেরচর গ্রামবাসী তাদের পূর্বপুরুষদের নৌকা বাইচ প্রতিযোগীতার পুরনো ঐতিহ্য ধরে রাখতেই গত শুক্রবার নতুন একটি বাইসেল নৌকা বানিয়ে ঝিনাই নদীর পানিতে ভাসিয়েছেন।
মধ্যেরচর গ্রামের একতা সংঘের সাধারণ সম্পাদক মো. তৈয়ব আলী জানান, মধ্যেরচর গ্রামের সামনে ঝিনাই নদীতে আজ থেকে ১০বছর আগেও তাদের অন্তত: একটি দর্শনীয় নৌকা বাঁধা থাকতো। ওই নৌকাকে এলাকাবাসী তাদের প্রাণের বাইসেল নৌকা হিসাবেই জানতেন। তখন নৌকা প্রতিযোগীতায় অংশ গ্রহণকারী জওয়ানদের বাইসেল বলে ডাকা হতো। জামালপুরের সর্বত্রই মধ্যেরচর গ্রামের বাইসেলদের ব্যাপক সুনাম রয়েছে। তবে গত ১০ বছর ধরে বাইসেল নৌকা না থাকায় এ গ্রামের কেউ নিজের নৌকায় চড়ে প্রতিযোগীতায় অংশ গ্রহণ করতে পারছিলেন না। সম্প্রতি মধ্যেরচর গ্রামের যুবকরা তাদের পূর্বপূরুষদের নৌকা বাইচ প্রতিযোগীতার পুরনো ঐতিহ্য ধরে রাখতে সম্প্রতি নিজ গ্রামে একতা সংঘ নামে একটি সামাজিক সংগঠন প্রতিষ্টা করেন। তারা একতা সংঘের উদ্যোগে পুরো গ্রামের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন। এরপর সকলে মিলে নিজেদের টাকায় গড়ে তুলেছেন ৭৯ হাত লম্বা একটি দর্শনীয় বাইসেল নৌকা। এই নৌকাটি বানাতে গ্রামের কেহ দিয়েছেন কাঠ, কেহ দিয়েছেন মিস্ত্রীর বেতন আবার কেহ দিয়েছেন নগদ টাকা অথবা শ্রম সহযোগীতা। মধ্যেরচর গ্রামবাসীদের ৭৯ হাত লম্বা দর্শনীয় বাইসেল নৌকাটি দেড়মাসে তৈরি করেছেন মাদারগঞ্জ উপজেলার ঘুঘুমারী গ্রামের কাঠ মিস্ত্রী জয়নাল আবেদীন ও তার ৫জন সহযোগী মিস্ত্রী।
মাদারগঞ্জের ঘুঘুমারী গ্রামের কাঠ মিস্ত্রী জয়নাল আবেদীন জানান, মধ্যেরচর একতা সংঘের ৭৯ হাত লম্বা বাইসেল নৌকাটির মূল অংশ ৬৮ হাত লম্বা। এই ৬৮ হাতের মধ্যে লাগানো ২৮টি গুড়ের উপর ২৮ জোড়া বাইসেল বসে নৌকা বাইতে পারবে। এছাড়াও নৌকাটির সামনের অংশে ৬হাত লম্বা গল্ইু এবং পিছনের অংশে ৫হাত লম্বা গলুই তৈরি করা হয়েছে। গলুইয়ের পিছনের অংশে দুইজন হালে এবং গলুইয়ের সামনের অংশে নৌকার পরিচালক ও চরনদারগন বসতে পারবেন। নৌকাটির উভয় গলুইয়ে চন্দন পাঁইয়ে কাঠ লাগানো হয়েছে। নৌকাটির তলার টিকুরি অংশে গজারি কাঠ, তলার বাকি দুই অংশে সারকাঠাল ও চন্দন পাঁইয়ে কাঠ এবং নৌকাটির আনারে ও চান্দিতে ইউক্যালিপটাস কাঠ ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়াও নৌকাটির গুছা, বাহা ও গুড়েতে লাগানো হয়েছে চন্দন পাঁইয়ে কাঠ ও বড়ই কাঠ। এই নৌকাটি দ্রুতগামী করতে নৌকার তলায় এন্দা মেরে ও শিরিষ কাগজ ঘসে প্লেন করা হয়েছে। এরপর পুুরো নৌকার তলায় গাবের পানি ও পাট শোলা কয়লার পালিশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও প্রতিযোগীতায় অংশ গ্রহনের আগে নৌকাটির তলায় একটি বিশেষ উপাদানের পালিশ দেওয়ার পরামর্শও দেওয়া হয়েছে।
মধ্যেরচর একতা সংঘের সভাপতি আলাল উদ্দিন জানান, মধ্যেরচর গ্রামবাসীর নৌকা প্রতিযোগীতার পুরনো ্ঐতিহ্য ধরে রাখতে এবং গ্রামের সকলকে ঐক্যবদ্ধ রাখতেই নতুন করে বাইসেল নৌকা তৈরি করা হয়েছে। প্রতিযোগীতার সময় এই নৌকার হাল ধরবেন ইমান আলী মেম্বার ও রহিম উদ্দিন। এই নৌকায় প্রতিযোগীতার সময় ২৮ জোড়া বাইসেলের মধ্যে নিয়মিত থাকবেন ইনছান আলী, তৈয়ব আলী, ইসমাইল হোসেন, আসাদুল, বেলাল হোসেন, রবিউল, আব্দুল লতিফ, জোসনা, লাল মিয়া, সাদেক আলী ও তোতা মিয়া। এছাড়াও নৌকাটি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য সার্বিক সহযোগীতায় থাকবেন মধ্যেরচর গ্রামের মোতালেব হোসেন, হেলাল উদ্দিন, নজরুল ইসলাম ও শাহিনুর রহমান।
মধ্যেরচর গ্রামের সমাজ সেবক খন্দকার মো. ইসমাইল হোসেন জানান, মধ্যেরচর একতা সংঘের উদ্যোগে বাইসেল নৌকা তৈরিকে কেন্দ্র করে মধ্যেরচর গ্রামের ৪টি পাড়ার মানুষ আজ নতুন করে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। এলাকার মানুষের মাঝে সকল প্রকার হিংসা ও প্রতিহিংসার অবসান হয়েছে এবং প্রত্যেকের মাঝে নতুুন করে ভাতৃত্ববোধ জাগ্রত হয়েছে। এছাড়াও নতুন নির্র্মিত বাইসেল নৌকাটি পুরো মধ্যেরচর গ্রামবাসীর বিনোদনের একটি উৎকৃষ্ট বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সম্পাদক ও প্রকাশক: রফিকুল ইসলাম
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-১৩১০